বীরেশ্বর সামন্তর হত্যা রহস্য।। শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য।। পাঠপ্রতিক্রিয়া।।

সুপ্রকাশ প্রকাশিত শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যর উপন্যাস ' বীরেশ্বর সামন্তর হত্যা রহস্য ' পড়ে লিখেছেন সায়ন্তন গোস্বামী। আমরা তাঁর অনুমতি নিয়ে নিজেদের টাইমলাইন থেকে শেয়ার করছি। 
................................
বীরেশ্বর সামন্তর হত্যা রহস্য ( শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য / ২০২৪)

আনকোরা নতুন বই, মে মাসে প্রকাশিত। উপন্যাস। বইটা নিয়ে বেশ কয়েকটা কথা বলার আছে। এটা কোনো মার্ডার মিস্ট্রি / ডিটেকটিভ থ্রিলার নয়, যার উল্টোটাই মনে হবে বইয়ের নাম দেখে। বইয়ের ব্লার্বেও সেটা স্পষ্টভাবে লেখা আছে। আমি সাধারণত অনেকগুলো বই একসঙ্গে পড়ি, তাই কমবেশি ৮০ হাজার শব্দের এই নভেলটা পড়তে সময় লেগেছে দিন পাঁচেক। লেখকের একটাই বই পড়েছি এর আগে, শেষ মৃত পাখি (রিভিউ টাইমলাইনেই অনেক তলায় কোথাও আছে, সার্চ করলে পাওয়া যাবে)। সেই বইয়ের সঙ্গে এই বইয়ের ভাষার প্রায় কোনো মিল নেই। না শব্দচয়নে, না কাঠামোয়, না বাক্য গঠনে, আর না বক্তব্য নির্মাণের আঙ্গিকে। এই বই অনেক বেশি chaotic এবং সমান্তরালে একাধিক elements, যথা ভায়লেন্স, ফিউডালিজম ইত্যাদি নভেলের সামগ্রিক বুনিয়াদ তৈরি করেছে। এই বইটি রাজনৈতিক৷ রীতিমতো কাড়া-নাকাড়া বাজিয়ে পলিটিকাল বলতে যা বোঝায়, এই বই ঠিক তাই। 

নভেলের পাতায়-পাতায় গ্রামবাংলার পিতৃতন্ত্র আর সামন্তবাদ আঠার মতো জুড়ে আছে। এসবের ওপর ভিত্তি করে আছে চূড়ান্ত পর্যায়ের ভায়লেন্স, যা উপন্যাসের এক-এক জায়গায় প্রায় লোকাচারের মতো ফর্ম নিয়েছে। ধর্ষণের পূঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা থেকে ডমেস্টিক ভায়লেন্সের কিরকম গ্রাফিক তা বলা, প্লাস পুলিস লক-আপে থার্ড ডিগ্রী টর্চার থেকে মাঠের ধারে ধ্বস্তাধস্তি করে মার্ডার, বিভিন্ন ধরণের ভায়লেন্স বইয়ের অনেক পাতায় জান্তব আগুনের মতো ছড়িয়ে আছে, যেখানে নেই সেখানেও সর্বগ্রাসী কয়লার বিশাল হাঁ-মুখ চল্লির মতো জ্বলজ্বল করছে। কংগ্রেসী অরাজকতা, কম্যুনিস্ট আন্দোলন, বিশেষত পাঁচের দশকের শেষ থেকে সাতাত্তরে বামফ্রন্ট সরকার গঠনের আগে অব্ধি, নির্দিষ্ট কিছু সামাজিক প্রকল্প, আর সর্বোপরি যেকোনো মুহূর্তে ফেটে পড়তে পারে এমন বারুদে ঠাসা গ্রামীণ সমাজব্যবস্থার কথা এই উপন্যাসের রাজনৈতিক terrain-কে ন্যায্যভাবেই যুদ্ধক্ষেত্র বানিয়ে দিয়েছে।

জেনেরিক কথাবার্তা পেরিয়ে আরো একটু গভীরে ঢুকি৷ বীরেশ্বর সামন্তর হত্যা রহস্য একটা খাঁটি intergenerational উপন্যাস, যেখানে দুই পরিবারের তিন পুরুষ আর চার পুরুষের চরিত্রের আর কর্মকাণ্ডের আখ্যান আছে। এই ফিল্ডে বেশ কয়েকজন বিশ্ববন্দিত মহান লেখক আছেন, কিন্তু কে মূল ভগবান তা আমরা অনেকেই জানি। তিনি গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ। বলাই বাহুল্য যে শাক্যজিৎ-এর লেখায় তাঁর প্রভাব খুবই স্পষ্ট, প্লটলাইনে নয়, চিত্রকল্পের বিন্যাসে। উপরন্তু বেশ কিছু জায়গায় শাক্যজিৎ জাদুবাস্তবতার ওপর নির্ভর করেছেন, যা কয়েকটি ক্ষেত্রে সুন্দর অ্যাপ্লিকেশন হওয়া সত্ত্বেও মনে হয়েছে লেখক মার্কেজের কোচিং ক্লাস সেরে বাড়ি ফিরে হোমওয়ার্ক করে পাঠকদের ইম্প্রেস করার জন্যে ডেস্পারেট হয়ে গেছেন। জাদুবাস্তবতা একপ্রকার লিটেরারি ইন্সট্রুমেন্ট বা টুল, সেই হিসেবেই ধরি। এমন ধরনের সব টুলই বহুলব্যবহৃত হলে ভোঁতা হয়ে যায়, সর্বোপরি উপন্যাসের মতো একটা বিস্তৃত ফর্মকে একটা কৌটোর মধ্যে চালান করে দেয়, এখানেও তাই হয়েছে৷ গোটা নভেলজুড়েই কিছু রিপিটেশন আছে, যা আমাকে বিরক্ত করেছে। বিভিন্ন ছোট-ছোট ব্যাকস্টোরি এবং চিত্রকল্প ব্যবহার করা হলেও টেক্সটের বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি ধরা পড়েছে, একজন অনভিজ্ঞ পাঠকও ধরতে পারবে। একপ্রকার self-referential হতে গিয়ে overdo হয়ে গেছে। আরেকটা জিনিস বললে হয়তো এই রিভিউটা খেলো হয়ে যাবে, কিন্তু না বললেই নয়, তবে একটামাত্র লাইনই বলব। বলিউড ফিল্ম গ্যাংস অফ ওয়াসেপুরের প্রভাব এই উপন্যাসে আমি পেয়েছি।

বিগত প্রায় এক দশকে জাপানি আর কোরিয়ান উপন্যাস পৃথিবীব্যাপী জনপ্রিয়তা পেয়েছে, ইংরেজিতে অদম্য অনুবাদের দৌলতে। সেগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি নভেল পার্টিকুলার্লি একটা ন্যারেটিভ স্ট্রাকচার ফলো করেছে, সেটায় বিভিন্ন চরিত্রের অ্যাকাউন্ট বা তাদের প্রেক্ষিতে ঘটনার প্রবাহ বিভিন্ন চ্যাপ্টারে লিপিবদ্ধ থাকে (এই টেকনিক জাপান-কোরিয়ার আবিষ্কার নয়, পুরোনো কিছু পাশ্চাত্য নভেলেও আছে)। সাম্প্রতিক দুটো উদাহরণ হলো - Confessions (Minato / 2014) আর Vegetarian (Han Kang / 2015).    আরো ভালো উদাহরণ গত পাঁচ বছরের বিশ্বসাহিত্যে আর্গুয়েব্লি জনপ্রিয়তম ডিটেকটিভ থ্রিলার The Silent Patient (Michaelides / 2019). ন্যারেশনের এমন টেকনিক শাক্যজিৎ ব্যবহার করেছেন, তবে অ্যাকাউন্টগুলো মূলতঃ থার্ড-পার্সনে, আনলাইক জাপানি-কোরিয়ান নভেলের ফার্স্ট পার্সন ন্যারেশন।

বইয়ের শেষ এক পাতা, মাত্র একটি পাতাই যারপরনাই হতাশ করেছে। সেই একটিমাত্র পাতার মিডিওক্রিটি গোটা বইয়ের ভার আর লেখার পরিশ্রমের ভ্যালু প্রায় হ্যাঁচকা টানে অলমোস্ট নামিয়ে দিয়েছিলো। এই শেষ একপাতার wrapping-up লেখা টিপিকাল ফেসবুক সেলিব্রিটির মোরালিস্ট পোস্টের মতো, ভালো intention-এর মোড়কে যা ফাঁপা আর ঘ্যানঘ্যানে, এবং অন্য এমন যেকোনো পোস্টেরই ক্লোন, যার মূল লক্ষ্য জনপ্রিয়তা,  এবং adulation-এর খিদে মেটানো। শেষ চার-পাঁচশো শব্দে লেখকের সাহিত্যিক হিসেবে ফোকাস সরে গেছে, অনেক যত্নবান হওয়া প্রয়োজন ছিল। 

এই বইতে কয়েকটা lacklustre, irritatingly pretentious, আর overtly predictable দিক থাকলেও মূলতঃ তিনটে কারণে বইটা প্রবলভাবে রেকো করব -

১) হত্যা রহস্য মানেই ট্রেডিশনালি খুনি কে, কীভাবে খুন করলো, তাকে ধরার procedure কিরকম, ইত্যাদি জিনিসপত্রই ডিটেকটিভ বইতে থাকে। কিন্তু rarely কোনো বই মোটিভকে কেন্দ্র করে লেখা হয়; একটা উদাহরণ দিতে পারি - Malice (Higashino / 2014). শাক্যজিৎ এই বইতে হত্যা ও হত্যাকারীকে নিমিত্ত রেখে মূলতঃ এই মোটিভকে নিয়ে intergenerational political ডায়নামিক্সে এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে সুদীর্ঘ কাটাছেঁড়া করেছেন। আমার মনে হয় না বাংলা সাহিত্যে এই ভাবে খেটেখুটে এই জঁরায় কোনো বই লেখা হয়েছে।

২) লেখক পলিটিকাল কারেক্টনেসের ধার ধারেনি, যা পাঠক হিসেবে আমার কাছে একজন সৎ লেখকের বা শিল্পীর একটা গুরুত্বপূর্ণ অ্যাট্রিবিউট। এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য উপন্যাসে প্রান্তিক মানুষের বাঁধভাঙা ভায়লেন্স প্রান্তিক মানুষেরই ওপর, এবং রাজনৈতিক ফ্রেমে তা প্রান্তিক মানুষের ক্ষমতায়ন আর গ্রামসমুন্নয়ন হিসেবে ম্যানিপুলেটেড হওয়া। এই এলিমেন্টের জন্যে উপন্যাসটা আমার মতে ইউনিক। আমার লিখতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই যে শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য একজন অথেন্টিক সাহিত্যিক। 

৩) এই নভেলের একটা শক্তিশালী পয়েন্ট হলো ক্যারেক্টর ডেভেলপমেন্ট। একটা বিশাল টেমপোরাল ক্যানভাসে প্রধান চরিত্রগুলোর কর্মকাণ্ডে ভাবনা-চিন্তা, আর দ্বিধাবিভক্ত হয়ে টানাপোড়েন,  বিশেষত মহিলা চরিত্রদের, এই ক্ষেত্রে লেখকের মুনশিয়ানা জেনুইনলি প্রশংসনীয়।  

উপন্যাসের ভাষা কিছু ক্ষেত্রে অযথা জটিল মনে হয়েছে কিন্তু সেটা আমার ব্যক্তিগত ইস্যু/খামতি হতে পারে, যেহেতু কন্টেমপোরারি, এমনকি পুরনো বাংলা সাহিত্য (কবিতা বাদ দিয়ে) আমি প্রায় পড়িই না (এটা ডিসক্রেডিট), আমার ফোকাস বিদেশি সাহিত্যেই থাকে। তা সত্ত্বেও বলব লেখক বেশ কিছু জায়গায়  brevity-এর ওপর নির্ভর করলে এবং মিনিমালিস্ট অ্যাপ্রোচ নিলে নভেলটা এরকম লাউড টেক্সট-বুকের মতো হতো না, মিস্টিক হতো, সাবলাইম হতো। হয়তো লেখক চাননি একটা epic-প্রচেষ্টা ওরকম কিছু হোক।

(বইটি পাবলিশ করেছে 'সুপ্রকাশ' আর সুন্দর প্রচ্ছদের কাজটি করেছেন সৌজন্য চক্রবর্তী।)

Comments

Popular posts from this blog

প্রতিযাত্রা।। দুর্লভ সূত্রধর।। সুপ্রকাশ।।

লেটারপ্রেসের কম্পোজিটর : এক বিষাদান্ত পরম্পরা।। অনন্ত জানা।। সুপ্রকাশ।।

সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম।। মিহির সেনগুপ্ত।। সুপ্রকাশ।।