চলার পথের চলনদার।। মিহির সেনগুপ্ত।। সুপ্রকাশ।।
আমি যেন ছিলাম নিঃসীম নীল আকাশের মতো। ক্রমশ সেখানে বাষ্পের পর বাষ্প জমতে জমতে একসময় একটা পরিপুষ্ট মেঘে তা পরিপূর্ণও হয়েছিল। কিন্তু সেই মেঘ পেল না কোনো চলনদার বায়ু। চলনদার ছাড়া কি কেউ চলতে পারে? সে থাকলো থম মেরে। মেঘ যতই জমুক তার যদি চলনদার বায়ু না জোটে তাহলে কি উপযুক্ত বর্ষণ হয়? আমার ক্ষেত্রেও হয়নি। মেঘের জমাটাইতো ব্যাপার নয়, সেই জমাট মেঘকে উপযুক্তভাবে বর্ষণমুখী করার জন্য তরিবৎ করতে হয়। সেই তরিবৎটা করেন পবনদেব স্বয়ং, তিনিই মেঘের চলনদার। নচেৎ মেঘ ধারাবর্ষণের জন্য পথ খুঁজে পায় না। আমার ক্ষেত্রেও প্রস্তুতিটাকে যথেষ্ট যত্নে লালন করা হয়নি। ফলে অকালে সামান্য বৃষ্টিপাত হয়েই মেঘটা নষ্ট হয়ে গেল। আমার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় এবং তা নিয়ে লেখালেখির ব্যাপারটা এ রকমই। এখন অবেলায় ছেঁড়া-ফাটা স্মৃতি হাতড়ে সেই অতীতচারিতাই করি। বস্তুত বর্তমান ব্যাপারটাকে আমি কখনো ধরতেই পারি না। কারণ তা কখনোই একদণ্ড স্থির থাকে না। কালের অনির্ণেয় অথচ ধ্রুব নিয়মে প্রতিক্ষণেই সে হাত ফসকে বেরিয়ে যায়। থাকে শুধু অতীতটা। ব্যক্তি মানুষের ক্ষেত্রে ক্ষণিকত্ব বড় প্রবল ।
গোটা যৌবন কালটা কেটেছে চলনদারহীন অবস্থায় উদভ্রান্তের মতো পথ খুঁজে। আত্মহননের উন্মত্ততাকেই মনে হয়েছিল পথ। চলনদার কাউকে তখন খুঁজে পাইনি। অথচ জানতাম পথ চলতে গেলে চলনদার দরকার হয়। গোটা জীবনের চলার এক একটা পর্বে এক একজন চলনদার পথের হদিস দেন, চলার সময়ের পথটুকু পার করে তার এক একটা বাঁকে বা প্রান্তে পৌঁছে দিয়ে পরামর্শ দেন, এবার অন্য চলনদার বাকি রাস্তায় তোমার সাথী হবেন। এঁদের মধ্যের কারুর কাছ থেকে আমরা নিজেরাই সরে যাই, হয়তো বা ভিন্ন পথের টানে, কেউ আবার কোনো পথের বাঁকে মিলিয়ে যান। চলা থামে না। তা অব্যাহত থাকেই।
বাংলার পশ্চিম পারে এঁদের বলে ‘সেথো’ আর পূর্বপারে আমরা বলি ‘চলনদার’। কথা হিসাবে চলনদার কথাটি অনেক ভারী। তার মধ্যে একটা অভিভাবকত্বের ব্যাপার আছে। সেথো কথাটির মধ্যে আছে একটা ইয়ারদোস্তি ভাব। সেটাও কিছু খারাপ শব্দ নয়, অনেক মজা আছে তার মধ্যে। কিন্তু সেথো তো অভিভাবক হতে পারে না ৷
কোনো মানুষ যদি কিছু হয়ে উঠতে চায় তার চলনদার দরকার হয়। আমি শৈশবকাল থেকে নির্দিষ্টভাবে কিছু হয়ে উঠতে চাইনি। কালের স্রোতে গা ভাসিয়ে যখন যেমন, তখন তেমন ভাবে জীবনটা প্রৌঢ়কালে পৌঁছোনোর আগের ক্ষণ অবধি গয়ংগচ্ছভাবে কেটেছে। কোনো একটা নান্দনিক প্রবণতার উপস্থিতি কি আমাকে কোনোদিন প্রতিজ্ঞা করিয়েছিল যে আমি সেই প্রবণতাটা অবলম্বন করে কিছু হয়ে ওঠার সাধনা করি? কণ্ঠসঙ্গীত, যন্ত্রসঙ্গীত, চিত্রকলা, সাহিত্যচর্চা, খেলাধুলা কোনোটার দিকেই কি আমার আকর্ষণ ছিল না? কোনো প্রবণতার সামান্যতম ইঙ্গিতও কি আমার চরিত্রে ছিল না? এসব প্রশ্ন আমার মধ্যে জেগেছে অনেক দেরিতে, তখন বেলা প্রায় শেষ। আসলে এইসব আকাঙ্ক্ষা আমার মধ্যে একেবারে ছিল না, বা এরকম প্রবণতাও ছিল না, ব্যাপারটা তেমন নয়। অনুশীলন সাপেক্ষে অনেক কিছুই হয়তো ছিল। কিন্তু অনুশীলন বস্তুটারও যে চলনদার দরকার সেটা জানা ছিল না। যদি জানা থাকত, তাহলে হয়তো জীবনের প্রথম পর্বের চলনদারকে চিহ্নিত করে, তাঁর চলনদারিতে পথ চলতাম।
চলার পথে প্রথম চলনদারকে চিহ্নিত করে যদি ঠিক করে নিতে পারতাম যে ঠিক কী হয়ে ওঠা আমার পক্ষে সম্ভব, তাহলে পরবর্তী চলাটায় হয়তো নিজেই ছন্দটা পেয়ে যেতাম৷ হয়ে উঠতে পারা না পারাটা পরের কথা, অনুশীলনের শিক্ষাটা তো পেতাম। আমি এই মূল শিক্ষাটাই কোনোদিন পাইনি আমার শৈশব কৈশোরে।
এই লেখায় বলতে যাচ্ছি যেসব চলনদারদের পরবর্তী কালে পেয়েছি তাঁদের কারুর কারুর কথা। কিন্তু সেক্ষেত্রে যেমন সবার কথা বলতে পারব না, তেমনি যাঁদের কথা বলব, তাঁদেরও আদ্যন্ত কথা বলা সম্ভব হবে না। আর এ তো সবাই জানেন যে আমাদের চলার পথে চলনদার বা গুরুর শেষ নেই। আমাদের তো ‘অতীত গুরু, পতিতগুরু, গুরু অগণন।' তাঁদের কার কথা ছেড়ে কারটাই বা বিশদে বলি?
চলার পথের চলনদার
মিহির সেনগুপ্ত
প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী
মুদ্রিত মূল্য : ৪৯০ টাকা
সুপ্রকাশ প্রকাশিতব্য
Comments
Post a Comment