অভিমানভূম।। (পুরুলিয়ার ধুলো মাটি নদী আর মানুষদের গল্প-কথা-মিথ)।। শুভদীপ চক্রবর্ত্তী।। সুপ্রকাশ।।

বেলাও যে ভ্যানিশ হয়ে আসছে! গরম হাওয়াটা মরে গিয়ে কেমন একটা হালকা মিঠে গন্ধ ভেসে আসছে রাস্তা পেরিয়ে ওপাশের জঙ্গলটা থেকে। রাত বাড়তে থাকলে নাকি এই গন্ধও বাড়তে থাকবে। নেশা এমনই গন্ধের, সাপখোপও এসে নাকি নাক ঘষে যায় মাঝেমধ্যে খানিক! জঙ্গলের লাগোয়া বাড়ির উঠোনে খলখল হাসির আওয়াজ। লাল প্লাস্টিকের ফুটবলটায় লাথি মেরেই তার পিছনে দৌড়োচ্ছে নিচু চালের বাড়িটার ঝুঁটি বাঁধা বাচ্চা দুটো। চায়ের দোকানে বেশ জমজমাট ভিড়। আর পেটের ভিতর, মাথার উপর মানুষ ভরে নিয়ে বাসটা ধুলো উড়িয়ে চলে যেতেই, অঞ্জনদার দেখা পাওয়া গেল অবশেষে। অনেক দেরি হয়ে গেছে। পাকবিড়রা যাব!

এ এক অদ্ভুত সমাপতন। ধর্ম ধর্ম করে এতকিছু হচ্ছে চারপাশে। হয়েই চলেছে কত কত যুগ ধরে। অথচ এখানে যেন সেই সবকিছু অন্য কোনও পৃথিবীর ঘটনা। শুনেছিলাম, মানভূমে একসময় জৈন ধর্মের প্রভাব ছিল ব্যাপক। তাই বর্তমান পুরুলিয়া জেলার বেশ কিছু জায়গায় নিদর্শন ছড়িয়ে আছে তার। পাকবিড়রাও সেরকম একটা গ্রাম। কাঁকড় মাখা লাল মাটির পথে ধুলো উড়িয়ে চলেছে বাইক। বেশ কয়েক কিলোমিটারের রাস্তা। পাকবিড়রা গ্রাম থেকে পুঞ্চা ব্লক বা বাজার অবধি এই এতটা দূরত্ব প্রায় দিনই পায়ে হেঁটেই যাতায়াত করেন বেশ কিছু মানুষ! ঈশ্বর মাহাত্ম্য থেকে অনেকদূরে সেইসব চলাচল। এত অবধি গিয়েই রাস্তার একটা ফাটলে পড়ে ঝাঁকুনি খেয়ে ওঠে দু’চাকা। যেন বলতে চায়, কী হয় মাঝেমধ্যে? ধর্মস্থানের কথাতেও, সেই মানুষের কথাই উঠে আসে! পৌঁছানোর বেশ আগে থেকেই মন্দিরগুলোর মাথা দেখা যাচ্ছে। অদ্ভুত একটা স্থাপত্য। তবে অবাক হওয়ার বাকি বোধহয় আরও!

‘পুরুলিয়ার জাদুঘর’। একটা গ্রামের নামের সঙ্গে যদি বিশেষণ জুড়ে যায় এমন, তবে তার ব্যাপারে তো আলাদা করে ইচ্ছা জাগাই স্বাভাবিক। গিয়ে বুঝলাম তার কারণটা। ওই যে দূর থেকে দেখতে পাওয়া মন্দিরগুলো, তাদের আসল নাম ‘দেউল’। পুরুলিয়া যে একসময় বেশ গুরুত্বপূর্ণ জৈন তীর্থভূমি ছিল, সেই ইতিহাস লেখা হয়েছে বেশ অনেক জায়গাতেই। কিন্তু ইতিহাসকে বাঁচিয়ে রাখার যে ন্যূনতম চেষ্টা এই দেশে দেখা যায়, রাঢ়বঙ্গের এইসব অঞ্চলে তারও দেখা মেলে ছিঁটেফোঁটা মাত্র। নইলে একসময়ের অন্যতম প্রধান জৈন তীর্থক্ষেত্র ছিল যে পাকবিড়রা, তার বর্তমান অবস্থা এমন হয়? সাকুল্যে অবশিষ্ট আছে তিনটে মাত্র দেউল আর। তবে প্রাকৃতিক কারণে যে নষ্ট হয়েছে সব, সেটা মানতে পারা কষ্টকর। কারণ, বাকিগুলোও কি তাহলে আর থাকতো অবশিষ্ট? চোখে পড়ে জাতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের একটা দায়সারা সাইনবোর্ড। কিন্তু তাতে যে ‘গুরুত্ব’ দেওয়ার কথা লেখা আছে, তা ওই দফতরের লোকেরা নিজেরাই বিশ্বাস করলে, নিদেনপক্ষে প্রাথমিকস্তরের কিছু সুরক্ষার ব্যবস্থা করা হত নিশ্চয়ই। নইলে মানুষের লোভ থেকে ধর্মও যে নিস্তার পায় না, তা খালি চোখেই বোঝা যাচ্ছে বেশ!

.................................................

অভিমানভূম
(পুরুলিয়ার ধুলো মাটি নদী আর মানুষদের গল্প-কথা-মিথ)
শুভদীপ চক্রবর্ত্তী

প্রচ্ছদ : সন্দীপ রায়
অলংকরণ : সুলিপ্ত মণ্ডল

মুদ্রিত মূল্য : ৩৫০ টাকা

সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

প্রতিযাত্রা।। দুর্লভ সূত্রধর।। সুপ্রকাশ।।

লেটারপ্রেসের কম্পোজিটর : এক বিষাদান্ত পরম্পরা।। অনন্ত জানা।। সুপ্রকাশ।।

সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম।। মিহির সেনগুপ্ত।। সুপ্রকাশ।।