অভিমানভূম।। (পুরুলিয়ার ধুলো মাটি নদী আর মানুষদের গল্প-কথা-মিথ)।। শুভদীপ চক্রবর্ত্তী।। সুপ্রকাশ।।
অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে শহর কলকাতায় হেমন্ত দূরঅস্ত্ হলেও, পুরুলিয়াতে ভোরের বেলা তো বটেই, এমনকি সন্ধে পার হলেই শিরশিরানি হাওয়াটা টের পাওয়া যায় বেশ। গ্রামের ভিতরের দিকে আরও একটু বেশি সেই শিরশির। তারই মধ্যে ঘোরাঘুরি চলছে। চলছে শেখাও। মোটামুটি ভাবে পাঁচ দিনের উৎসব সহরায়। আদিবাসী সম্প্রদায়ের অন্যান্য উৎসবের মতোই সহরায়ও একটা আদ্যন্ত কৃষি উৎসব। তার সঙ্গে এখানে পুজো করা হয় গৃহপালিত বা চাষের কাজে সাহায্য করে যে পশুরা, তাদেরও। প্রচলিত ধারণায় কার্তিক মাসের অমাবস্যার পরের দিন থেকে থেকে শুরু হয় ‘হাতি লেকান সহরায়’; অর্থাৎ হাতির মতো বড় উৎসব সহরায়। নতুন ফসল ঘরে উঠে এসেছে ঘরে। পরবর্তী কৃষি মরশুম শুরু হওয়ার প্রস্তুতি পর্বের আগেই তাই এই উদযাপন। যদিও এখানেও দেখা মেলে সনাতন গ্রামীন সমাজের তীব্র একাত্মতার। সব গ্রামে একই দিনে শুরু নাও হতে পারে সহরায় পরব। নির্ধারিত সময়ের প্রায় একমাস আগে গ্রামের সকল পুরুষেরা গ্রাম-প্রধান বা ‘মাঝি’র নেতৃত্বে একত্রিত হয়ে ঠিক করেন পরব শুরুর দিনক্ষণ। গ্রামের একটা পরিবারও যাতে উৎসবের আলো থেকে বাদ না পড়ে, তার জন্যই এই ব্যবস্থা।
সাঁওতালি ভাষা ও সংস্কৃতির উপর নিরলস ভাবে কাজ করেছেন, সেরকম বেশ কিছু গবেষকের মতে ‘সহরায়’ শব্দের অর্থ হল ‘চুক্তির ভিত্তিতে সমর্পণ’। এই ঘটনার ব্যাখ্যা থেকে আমরা আবার পেয়ে যাই হিন্দুদের অন্যতম বড় উৎসব কালীপুজো বা দীপাবলির আরেক অন্যতর উৎসের সন্ধান। এই মতে বলা হয়, বহিরাগতরা আদিবাসী সাঁওতালদের পবিত্র ভূমিতে আক্রমণ করলে, সাঁওতালরা এক দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর পরাস্ত করে বহিরাগতদের। উভয়পক্ষই রাজী হয় অতঃপর একটা সন্ধিতে আসতে। এই সন্ধির জন্য প্রস্তুত করা হয় একটা দীর্ঘ চুক্তিপত্রও। মিলিত সভায় যখন একেকটা চুক্তিতে সহমত হচ্ছে উভয়পক্ষই, তখন জ্বালিয়ে দেওয়া হয় একটা করে মাটির প্রদীপ বা দিয়া। সব অশান্তিকে দূরে রেখে সেইসব দিয়া জ্বলতে থাকে টিমটিম করে। এর থেকেই দীপাবলি উৎসবের সূচনা বলে মনে করা হয়েছে এই মতে। বিভিন্ন সহরায় গীতিও উল্লেখ করে যায় এই যুদ্ধের। ‘আর দিশম সীমারে...’ ঘোরের মতো শোনার পর, সেই গানের মানে বুঝতে চাইলে, কেটে কেটে বুঝিয়ে দেন কেউ—
যুদ্ধ বেঁধেছে দেশের সীমায়
বিনতি চরণে ওগো ঈশ্বর, প্রেমিক আমার যেন অক্ষত ফেরে।
শরীরে এখনও আছে যৌবন,
বঁধুয়ার তরে মন উচাটন
বিনতি চরণে ওগো ঈশ্বর, প্রেমিক আমার যেন অক্ষত ফেরে।
কিন্তু যুদ্ধ তো শেষ কথা বলে না কখনোই। তাই ভিন্ন মতবাদে উঠে আসে পারস্পরিক বেঁধে বেঁধে থাকার গল্প। ‘সহর’ শব্দের অর্থ সমৃদ্ধি এবং ‘আয়’ শব্দের অর্থ উপার্জন। এই উৎসবে গাভী, বলদ, অন্যান্য গৃহপালিত পশু বা কৃষি জমির উপাসনা যেন তাই একটা হুল্লোড়ে মাখা ‘থ্যাংক ইউ’ নোট। প্রকৃতি পাশে না দাঁড়ালে, এই মানুষগুলোও যে হারিয়ে ফেলত ভরসা বা নির্ভরশীলতার প্রাথমিক সাহচর্যটুকুই।
…………………………………………….
অভিমানভূম
(পুরুলিয়ার ধুলো মাটি নদী আর মানুষদের গল্প-কথা-মিথ)
শুভদীপ চক্রবর্ত্তী
প্রচ্ছদ : সন্দীপ রায়
অলংকরণ : সুলিপ্ত মণ্ডল
মুদ্রিত মূল্য : ৩৫০ টাকা
সুপ্রকাশ
Comments
Post a Comment