চলার পথের চলনদার।। মিহির সেনগুপ্ত।। সুপ্রকাশ।।

সে একেবারে যাকে বলে অন্ধের হস্তী দর্শন। রবিদা, মানে রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্ত মশাই, যাঁর উপর ‘উক্ষতারণীয়’ হুমদো হুমদো অধ্যাপকেরাও পাথরের চাঁই-এর মতো ভারী ভারী নিবন্ধ লিখে, তাঁদের বাঘের থাবার মতো হাতগুলো কচলাতে কচলাতে হেঁ হেঁ করে বলবেন, কাজটা খুব বাড়াবাড়ি হয়ে গেল, আর এমন বেয়াদপি করব না। রবীন্দ্রকুমারকে রবিদা ডাকার অধিকার আমাকে যে কেউ দিয়েছেন, এমনটি ভাবার হেতু নেই। তবে তিনি জাত্যংশে বদ্যি, আম্মো বদ্যি। তিনিও বাকলাই, আম্মো। সুতরাং দাদা ডাকব না তো কী? তাছাড়া রবিদা নিজে ছাপার অক্ষরে ঘোষণা করেছেন, তিনি বরিশালের কুলীন বাঙাল, সেদিক দিয়েও আমার দাদা বলে ডাকাটা সাড়ে ষোলো আনা স্বাধিকার। কারণ ঘোষণাটি তিনি করেছেন আমারই কেতাব বিষয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে, তাই...। আশা করি, এর পর আর কেউ স্বাধিকারভঙ্গ নিয়ে গম্ভীর উপদেশ দিতে আসবেন না। প্রসঙ্গত, এখানে দুটি শব্দ নিয়ে কপিরাইট-এর জবাবদিহি করে রাখি, উক্ষতারণ এবং আম্মো। যাঁদের কাছে ধারলাম তাঁরা মহাশয় ব্যক্তি, ছোটখাটো চুরিচামারির হিসেব ধরেন না। এমত আকাঙ্ক্ষায় লুব্ধ হয়ে ভাবলাম, বেশ একখানা তাবড় পণ্ডিতি ‘ইশে’ লামাইয়া ফ্যালামু। শুধু ধরতাইটা পাচ্ছিলাম না। কান্টকে নিয়ে ধরতে গিয়ে গোটা এনলাইটেনমেন্ট-এর তত্ত্বটা অন্ধকার হয়ে গেল। বিবেকানন্দ-বিষয়ক বক্তৃতার বইগুলো কিছুকাল হল নিজের হাতে বাধ্য হয়ে উপহার দিয়েছেন, সেসব নিয়ে নাড়াঘাঁটা করতে গিয়ে শঙ্কর, রামানুজ, মোক্ষমূলর ইত্যাদি নামগুলো অভ্যন্তরস্থ বায়ু কুপিত করল বটে, কিন্তু নির্গুণ, সগুণ ইত্যাকার বায়বীয় ব্যাপারগুলি ব্রহ্মরন্ধ্র ভেদ করে লক্ষ্মীর পাঁচালির পরের গাওয়া কেত্তন, আর কালীকেত্তন সব কিছুর সঙ্গে একাকার হয়ে পরম তত্ত্বকে সর্বং খল্বিদং করে ফেললে শেষমেষ চৈতন্য হলে দেখলাম, লেজ যথাস্থানেই আছে। আমি বেমতলব তার চারদিকে পাক খেতে গিয়ে নিজের চার দিকেই পাক খাচ্ছি। তাই এখন ভাবছি, বরিশালি আপ্তবাক্যটিই প্রকৃত ‘সূত্র’। অর্থাৎ ‘গরিবের পোলা তোর মোতার দরকার কী?’ এটি একটি বাকলাই বরিশাল্যা প্রবচনসূত্র। সূত্রটির টীকা ভাষ্য না দিলে ‘বোজোন’ যাইবে না। বাপ ছেলেকে খালুই নিয়ে বাজার থেকে মাছ আনতে বলেছেন। মাছ নিয়ে মাঠের আলপথ ধরে ফেরার সময় ছেলের জোর হিসি পেলে, খালুই মাঠে রেখে তৎকর্মে ব্যস্ত। ইত্যবসরে চিল এসে খালুইসুদ্ধ মাছ নিয়ে গগনবিহারী। বেচারা কাঁদতে কাঁদতে বাপের কাছে এসে বৃত্তান্ত জানালে বাপ তাকে এই কথাটি বলেন। সুতরাং সঠিক-সূত্রটি তদবধি প্রতিষ্ঠা পেল যে, গরিবের পোলার মোতার দরকার নেই।

যতদূর মনে হয়, সূত্রটি প্রথমবার পিতৃদেবের কাছে এবং পরে রবিদার কাছে শুনে স্বয়ং প্রাজ্ঞ হয়েছি। তাই ভাবছি, ফালতু ‘উফাল মারইয়া লাভ নাই। সোজা গপ্পডা সোজা কথায় কইয়া ফ্যালাই।‘ তাতে আমারও পরিশ্রম লঘু হবে, আর পাঠক পাঠিকারাও আমার রবীন্দ্রকুমার-বিষয়ক এলেম ধরতে পারবেন না। আমার গল্পটি মূলত হচ্ছে, রবিদার সঙ্গে আমার মতো একজন আলেহা-আপড়া মানুষের যোগাযোগের গল্প। গল্পটি খুব সরল নয়। এই সংযোগের দুই জন অনুঘটকের কথা বলা এক্ষেত্রে আবশ্যক। অনুঘটক দু’জনের নাম যথাক্রমে সুনীল সেনশর্মা (প্রয়াত) এবং শ্রীশিশির সেন। এদের দুজনের সঙ্গেই আমার পরিচয়ের প্রথম সূত্র ছিল একটি পত্র-নিবন্ধ, পরে সেটি ‘ভাটিপুত্রের পত্র বাখোয়াজি’ নামে একটি কৃশ বই হিসাবে প্রকাশিত হয়। সুনীলদা তাঁর এক বন্ধু মারফত রচনাটি পড়ে খুব আহ্লাদিত হন এবং এদেশে ও বাংলাদেশে অবস্থিত তাঁর ব্যাপক বন্ধুবান্ধবদের সেটি পড়ান। সেই থেকে তাঁর সঙ্গে আমার আলাপ। এই সব বৃত্তান্ত আগেই যথেষ্ট বলেছি। এখন আবার বলছি। সুনীলদার কথা বারবার বলতেও আমার ক্লান্তি হয় না। যা হোক এরপর তাঁর প্রায় নিয়মিত কর্তব্যকর্ম দাঁড়াল দৈনিক আমাকে নিত্যনতুন সংস্কৃতি-প্রেমী তথা বিদগ্ধ মানুষদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। এ কাজে তাঁর দোসর ছিলেন তাঁর এক অগ্রজ বন্ধু শ্রীনীলরতন মুখোপাধ্যায়, যিনি স্বয়ং একজন উত্তম শিশুসাহিত্যিক এবং প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী বুলবুল চৌধুরীর অন্তরঙ্গতম বন্ধু তথা জীবনীকার। তাঁদের কাজই ছিল আমাদের মতো অখ্যাত জনেদের মধ্যে সামান্যতম সম্ভাবনার ছিটেফোঁটা দেখলেও, তা সাধ্যমতো বিদগ্ধ মহলে তুলে ধরা, তাঁদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে আমাদের উৎসাহ উদ্দীপনা বৃদ্ধি করা। সুনীলদা আর শিশিরদা দুজনেই রবিদার কাছের মানুষ। শ্রীশিশির সেন রবিদার নিকট প্রতিবেশী এবং রবিদা সম্পর্কে যাবতীয় খবরাখবর রাখা তিনি বিশেষ কর্তব্যকর্ম হিসেবে করে চলেছেন। 

তপনবাবু অক্সফোর্ড থেকে কলকাতা এলেই রবিদার ওখানে প্রায় নিয়মিত যাতায়াত করে থাকেন। রবিদার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক অসামান্য শ্রদ্ধাপূর্ণ এবং হার্দিক। প্রসঙ্গত, শিশিরদা এবং সুনীলদা, উভয়েই লব্ধপ্রতিষ্ঠ ভূতাত্ত্বিক, কিন্তু নিজস্ব বিষয়ের বাইরেও তাঁদের সুকুমার শিল্পের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ এবং চর্চা যুবকদের নান্দনিক উৎসাহ উদ্দীপনাকেও হার মানাত।

সুনীলদার সঙ্গে আমার পরিচয় ১৯৯৩-এর কোনও একটা সময়ে টেলিফোন মারফৎ, তাঁরই উদ্যোগে ঘটেছিল। এর কিছুদিনের মধ্যেই বাকিদের সঙ্গে, তাঁরই মধ্যস্থতায় আমার পরিচয় ঘটে। তপনবাবুর সঙ্গে পরিচয়টা অবশ্য সরাসরি পত্রনিবন্ধটির মাধ্যমে প্রথমে ডাক যোগাযোগে এবং অনতিবিলম্বে সামনাসামনি ঘটে। এই সময়েই এক দিন সুনীলদার ফোন, ভাইডি তুমি তো এহন বিখ্যাত অইয়া গেলা। আরে কাইল সান্ধ্য মজলিশে তপন রায়চৌধুরী আর রবি দাশগুপ্তের আড্ডার বিষয়বস্তু আছেলে তোমার বইপত্তর আর তুমি। শিশিরদা সেখানে উপস্থিত আছিলেন। রবিদা তোমারে আর তোমার লেহাপত্তর দ্যাখতে চাইছেন। শিশিরদার লগে যোগাযোগ করইয়া দ্যাহাডা করইয়াই ফ্যালাও। উল্লেখ্য, ইতিমধ্যে আমার সামান্য বইপত্তর এবং কিছু খুচরো লেখা, যা তখনও পর্যন্ত প্রকাশিত, সে সব তাঁদের দিয়েছি। ‘বিষাদবৃক্ষ’-এর তখনও ডালপালা ছাঁটা চলছে। রবিদাকে তখনও কোনও বই দেওয়া হয়নি, আলাপ ছিল না বলে।

প্রথম দর্শনের অনুভূতিটা অর্জুনের বিশ্বরূপ দর্শনের মতো। অত বড়ো একটা মাথা, ওইরকম দীর্ঘবাহু এবং অমন চওড়া মজবুত হাতের কব্জি, সর্বোপরি মেদহীন উন্নত দেহকাণ্ড সমন্বিত সুদর্শন একজন মানুষকে সামনে দাঁড়ানো দেখলে, নিজেকে একটি নেংটি ইঁদুর ছাড়া কিছু ভাবা যায়? বার্ধক্যজনিত কিছু শারীরিক অস্বাচ্ছন্দ্য অবশ্যই ছিল। কিন্তু তা কেবলই বহিরঙ্গে প্রক্ষিপ্ত। খান তিনেক বই আর কিছু কুচোকাঁচা পায়ের কাছে রেখে প্রণাম করলে, তিনি প্রাচীন মহাস্থবিরদের ভঙ্গিতে আশির্বাণী উচ্চারণ করেছিলেন। আত্ম দীপো ভব। বলা বাহুল্য, রবিদা তখনও আঁচ করেননি যে এ পিদ্দিমে তেল নেই। তারপর থেকে মাঝে মাঝেই যাতায়াত, টেলিফোন করা, শারীরিক খোঁজখবর নেওয়া, এছাড়া আর কী করা যায়? মানে আমাদের মতো মানুষের পক্ষে আর কী করা সম্ভব? তবু বোধিবৃক্ষ তো বটেন। প্রায় শতাব্দী প্রাচীন জ্ঞানতাপস। যত অকিঞ্চিৎকর মনুষ্যই হই না কেন, এটা তো বুঝি, তাঁর তাবৎ স্বাধ্যায়ের অনুপুঙ্খ খোঁজখবর রাখার মতো মনীষা, আমার প্রজন্মের জাতক জাতিকাদের তো দূরস্থান, বিগত প্রজন্মেরও খুব বেশি কারুর যে অধিগত, তেমন তো মনে হয় না। সাহিত্য, ইতিহাস এবং দর্শন বিষয়েই যদি শুধু বলা হয়, তার ধ্যানধারণা, পঠনপাঠন এবং অনুশীলন তথা সর্বোপরি মনুষ্যকুলে দুর্লভ যে গুণটিকে আমরা দুর্লভ হিসাবে মান্যতা না দিয়ে হালকা করে ‘কাণ্ডজ্ঞান’ বলে তুচ্ছ করি, তা যে তিনি কী বিপুল পরিমাণে ধারণ করেন, আর তা যে কী করে গোটা বিশ্বকে ঋদ্ধ করার নিরন্তর তপস্যায় নিযুক্ত, তাঁর সাম্প্রতিকতম দু-একটি প্রবন্ধ পাঠ করলেও তা বোঝা যায়। আমি তাঁর ‘হুইটনার ফিলোসফি’ এবং ‘এ ওয়ার্ল্ড হিউম্যানিটি’ শীর্ষক প্রবন্ধাবলীই শুধু এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করব। কিন্তু সে শুধু উল্লেখমাত্রই, সেসব নিয়ে সামান্যতম আলোচনারও ধৃষ্টতা দেখাতে পারব না। সেটা ভীষণভাবে অনধিকার চর্চা হবে, পাপ স্পর্শ করবে আমাকে। একটা কথাই শুধু বলব যে রবিদা জ্ঞানকে প্রজ্ঞায় পরিণত করতে পেরেছেন। আজকের দিনে একথা অসম্ভব মনে হলেও, একশো ভাগ সত্য বলে আমি বিশ্বাস করি। জ্ঞান যখন প্রজ্ঞায় উত্তীর্ণ হয়, তখনই তা মানুষের সামগ্রিক কল্যাণের ক্ষেত্রে প্রযুক্ত হতে পারে। শুধুমাত্র শুষ্ক জ্ঞান কল্যাণাত্মক হয় না। একমাত্র প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিই হৃদয়ের ঐশ্বর্যে ঐশ্বর্যবান হন। রবিদার কাছে চুপচাপ বসে থেকে, কখনও কখনও তাঁর দু-চারটি কথা শুনে এবং তাঁর সামান্য কিছু রচনা পাঠ করেও এই সত্য উপলব্ধ হয়। আমার অভিজ্ঞতাটা এমনই। আরেকটা কথা, এহেন স্মৃতিশক্তি যদি আর কারুর থাকে! সারা জীবনের অধীত বিদ্যা পুরোটাই তাঁর মগজে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে আছে।
‘বিষাদবৃক্ষ’ এর পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত হলে একদিন সভয়ে জিজ্ঞেস করলাম একবার হাঁড়ির ভাত দু’একটা টিপে দেখবেন কি-না। মনের ইচ্ছেটা এই যে দু-একটা পাতা উল্টে দেখেও যদি বলেন যে এবার ছাপাখানায় দেওয়া যেতে পারে। ভয়ের কারণ খুব একটা ছিল না। প্রথমত, আমি প্রকৃতিগতভাবে একটু বেশি মাত্রায় ছ্যাবলা গোত্রের মানুষ। ছ্যাবলাদের সুবিধে এই যে তারা অসম্ভব দুঃসাহসী হয়। দ্বিতীয়ত, রবিদার স্বভাবে এতদিনের মধ্যে আদৌ কিছু ভয়াবহতার লক্ষণ পাইনি, যেটা পণ্ডিতদের সাধারণ চারিত্র্যলক্ষণ বলে ধরা হয়। বরং কোনও বিষয় নিয়ে যদি বোগদা সুলভ মতামত কখনও দিয়ে ফেলি, তবে গভীর মমতায় তার সঠিক টীকাভাষ্যটি বুঝিয়ে ‘জ্ঞানাঞ্জন শলাকা’-র উপযুক্ত ব্যবহারে পাঁঠাকে মানুষ করার প্রযত্ন করেন। তৃতীয়ত, মাঝে একদিন ‘সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম’ নিয়ে নিজে থেকেই আলোচনা করার সময় ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলেছিলেন। বইখানা বুড়ার খুব পছন্দ হয়েছিল সম্ভবত। তাছাড়া, নিঃশব্দে রোদন বোধহয় তাঁর চরিত্রগত কোমলতার লক্ষণ। এটা প্রায়শই নজরে পড়ে। ভ্যাঁ করে কাঁদার কথাটা একটু বেশিই বললাম বটে, তবে যে ‘একছের’ মিথ্যা কথা, এমন নয়। এই সব অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে, একদিন শিশিরদার সঙ্গে গিয়ে আকাঙ্ক্ষাটিকে ব্যক্ত করলাম।

একটানা পাতা চারেক পড়ে এবং খনিকটা এলোমেলো উল্টেপাল্টে বললেন, এটিকে অচিরেই প্রকাশের ব্যবস্থা কর। বললাম, প্রকাশক পাচ্ছি না। যার কাছেই যাই খেদিয়ে দেয়। আপনি যদি—
—ও ব্যাপারে আমার হাতযশ নেই। কিন্তু বইটা প্রকাশের ব্যবস্থা করতেই হবে। চেষ্টা চালাও। এবিষয়ে অন্যান্য বৃত্তান্ত এই আখ্যানের জন্য জরুরি নয়, বা খুব উপাদেয়ও নয়।

রবিদা স্বভাবসিদ্ধ ভাবে সুরসিক, পাণ্ডিত্য সেখানে অনাবশ্যক গাম্ভীর্যের কুজ্ঝটিকা সৃষ্টি করেনি। খুবই গম্ভীর আলোচনার মধ্যে হঠাৎ করে এমন চমৎকার এক একটি সরেস আপাত লঘুবাক্য বলবেন যে, প্রথমটা হকচকিয়ে যেতে হয়। সে ব্যাপারটি তাঁর লেখার মধ্যেও মাঝে মাঝে বড় মজাদার লাগে। তবে তা কদাচিৎ। একদিনের ঘটনা বলছি। সেদিনও শিশিরদার সঙ্গে গিয়েছিলাম। শরীর মন অন্য দিনের চাইতে ভালই ছিল মনে হয়। বেশ একটু ফুরফুরে ভাব। এমনিতে বয়সোচিত কারণে শরীর দুর্বলই থাকে। বিশেষ কোনও রোগ যে আছে এমন নয়। যথেষ্ট সাবধানী মানুষ। যাহোক, সেদিন আমরা থাকাকালীন একটা টেলিফোন এল। টেলিফোনটা শোবার ঘরে। ড্রইংরুমে আমরা। কথাবার্তায় বিঘ্ন ঘটে বলে, সেখানে টেলিফোন নিষিদ্ধ। হঠাৎ শুনলাম রবিদা বেশ উচ্চরবে হাসছেন। বসার ঘরে এসে জানালেন, হীরেন ফোন করেছিল। একটা বেশ মজার কথা বলল, জানো। বলে কি— আমাদের নাকি বয়সের গাছপাথর নেই। ও কথাটা আমি বলতে পারি। ও বলবে কেন? ওর আর এমন কী-বয়স? শিশিরদা আমার দিকে একটু ঝুঁকে বললেন, পাথর নেই এ কথাটা আমার পরামর্শ ছাড়া ওনাদের কারুরই বলা উচিত না। গাছের ব্যাপারটা অবশ্য আমি জানি না। শিশির দা ভূ-তাত্ত্বিক, প্রস্তর বিশেষজ্ঞ। রবিদা কানে একটু কমই শোনেন। শিশিরদারও একটা যন্ত্র দরকার হয়। যাই হোক রবিদার কানে কথাটা যায়নি। তিনি বলে চলেছেন, বলে কি-না গাছপাথর নেই! আমি সেই যে কত কাল আগে জন্মেছিলাম— । তা হ্যাঁ হে শিশির, আমার তো এই ঊননব্বই হোল, না কি? তোমার তো হিসেব থাকা উচিত। প্রত্যেক বছর তুমিই তো আমার জন্মদিনে গান শোনাও। শিশিরদা জানালেন ওই রকমই হবে। রবিদা একটু গম্ভীর হয়ে বললেন, কেন যে লোকেরা জন্মদিন পালন করে। একটা দুঃখের দিন নিয়ে উৎসব করার কোনও মানে হয়?

এই ঘটনার বছর তিনেক বাদে আরেক দিনের ঘটনা। সেদিন আমরা শোবার ঘরেই বসেছি। রবিদা শুয়ে। ইদানীং বেশিরভাগ সময়ই শুয়ে থাকেন। প্রয়োজনীয় সব সামগ্রীই বিছানার আশে পাশে। একজন নার্স এবং একজন কম্বাইন্ড হ্যান্ড সব সময়ের জন্য। এছাড়া নিত্য সারস্বত চর্চার সহায়ক একটি মেয়ে। পড়ে শোনানো এবং অনুলিখন তাঁর কাজ। নিজে পারেন না এখন আর। কিন্তু শ্বাসপ্রশ্বাস নেওয়ার মতো সারস্বত চর্চা অব্যাহত। স্ত্রী গত হয়েছেন বেশ কয়েক বছর। একমাত্র সন্তান মেয়ে দূরবাসিনী। যে দিনের কথা বলছিলাম, সেদিনও বয়স প্রসঙ্গ উঠল। রবিদা বললেন, দেখতে দেখতে নব্বই-এ পড়লাম। না-কি বল শিশির? শিশিরদা কিছু বলার আগেই আমি নিচু স্বরে তাঁকে জানালাম, তিন বছর আগেই না বলেছিলেন ঊননব্বই চলছে? শিশিরদা সুকুমারীয় হিসাবে বললেন, এখন কমতির দিকে যাচ্ছে। রবিদাকে বললেন, আজ্ঞে হ্যাঁ উদযাপনের সময় তো হয়ে এল, সবাইকে খবর দিতে হবে। ফেরার সময় রাস্তায় নেমে বললেন, রবিদার মত স্মৃতিধর পুরুষ আর একজনও পাবে না হে। শুধু বয়সের ব্যাপারেই একটু গণ্ডগোল হয়ে যায় আজকাল। তবে কী–জানো? আমার মনে হয়, এটা রবিদার রসিকতারই একটা ধরন।

...........................................
চলার পথের চলনদার
মিহির সেনগুপ্ত
..........................................

সম্পাদনা, পুনর্বিন্যাস : অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী
মুদ্রিত মূল্য : ৪৯০ টাকা

সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

প্রতিযাত্রা।। দুর্লভ সূত্রধর।। সুপ্রকাশ।।

লেটারপ্রেসের কম্পোজিটর : এক বিষাদান্ত পরম্পরা।। অনন্ত জানা।। সুপ্রকাশ।।

রাস্তার শুরু।। জয়া মিত্র।। সুপ্রকাশ।।