অভিমানভূম।। (পুরুলিয়ার ধুলো মাটি নদী আর মানুষদের গল্প-কথা-মিথ)।। শুভদীপ চক্রবর্ত্তী।। সুপ্রকাশ।।

এখানকার প্রায় সমস্ত গ্রামেই দেখি সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো গোল মঞ্চের মতো একটা জায়গা। উপরে পাকা ছাউনি, চারপাশ খোলা। নিচের মঞ্চের সঙ্গে উপরের ছাদ জুড়ে আছে লম্বা লম্বা কিছু পিলারের সংযোগে। পিলারের মধ্যে ঝুলছে কোথাও কোথাও মাদল, ধামসা। এগুলোই হরিমণ্ডপ। শ্রীচৈতন্যের কৃষ্ণপ্রেমের জোয়ার কিছু কম এসে পড়েনি এই মানভূমেও। সেখানেই দেখা হয় আদিবাসী সমাজেরই একজন পুরোহিতের সঙ্গে। এই সমাজের ভাষায়, সেই উপাসকদের বলা হয় ‘লায়া’। যদিও সে বছর কোনও কারণে অসুস্থ থাকায়, করম পুজোর কোনও কাজ করতে অপারগ তিনি। রোদ-বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচতে তাই বসে থাকা অগত্যা গ্রামের মাঝের ওই মঞ্চেই। বিকেলের আগে আগে তাপ তখন কমে এসেছে অনেকটাই। আলোও কেমন মনমরা। সেরকম একটা বিকেলেই গল্প জমে ওঠে লালচে মেঝের উপরে বসে। আদিম জনগোষ্ঠীর এই পরবের খুঁটিনাটি জানতে জানতে, অবাক হই আবারও। কারণ, সেই একাধিক লোককথা আর তার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা ক্ষেত-মাটি-অরণ্যের গান। পরে কয়েকটা বইপত্র ঘেঁটে করম পরবের যা রেফারেন্স পাওয়া গেছে, সেখানে ওই বয়স্ক ভদ্রলোকের বলা গল্পের হুবহু একরকম গল্প না পেলেও, মূল বক্তব্য ছিল প্রায় একই। যদিও গবেষণা তো উদ্দেশ্য নয় কখনোই এইসব খোঁজের। আর একটা মেঘলা দুপুরে গল্প শুনতে বসলে, তথ্য মিলিয়ে দেখার কথা কোন বেরসিকের মাথাতেই বা আসে?

পরবের ব্যস্ততা কম নয় মোটেই! এই দিন গ্রামের পুরোহিতের সঙ্গে জঙ্গলে গিয়ে করম গাছের ডাল এনে বাড়ির উঠোনে বা মাঠের মাঝে পৌঁছে দেয় গ্রামের কুমারী মেয়েরা। করম গাছটা কেমন? পরে গুগলে ইংরেজিতে ‘করম ট্রি’ লিখে সার্চ করলে বেরিয়ে এসেছে তার বিজ্ঞানসম্মত নাম, ‘নৌকলিয়া পর্ভিফলিয়া’। তারপর বিজ্ঞানসম্মত নাম ধরে খুঁজতে খুঁজতে পাওয়া গেল, করম গাছটা আদতে নাকি আমাদের কদম গাছ! আসলে মানভূমেও যে গাঙ্গেয় সমতলের মতো কদম গাছ দেখা যেতে পারে, সেটা সত্যি বলতে মাথাতেও আসেনি।

যদিও, নিয়মের ধরাবাঁধা নেই তেমন কিছু। করম গাছ না পাওয়া গেলে তার বদলে আনা হয় শাল গাছের ডাল। তারপর শুরু হয় দ্রিম দ্রিম বাজনা। নাচে-গানে গ্রামের সকলে মেতে ওঠে মাদলের তালে। সাঁওতাল পুরোহিত বা লায়া গ্রামের পাহাড়ঘেরা কোনও মাঠের মাঝে প্রথাগত ভাবে সূচনা করেন করম পরবের। ক্ষেত ভরা নতুন ফসলের প্রার্থনার সঙ্গে সঙ্গে এই উৎসব মঙ্গলকামনা করে নিজের সন্তানেরও। আসন্ন মরশুমে রুখা-সুখা পাথুরে মাটি যেন ভরে ওঠে সবুজ ফসলে— আশা তো এটুকুই!

প্রচলিতভাবে যে কোনও পরব বা উৎসব কোনও না কোনও দেবতা, মন্দির বা বিগ্রহকে ঘিরে অনুরণিত হলেও এই করম পরবের মূল অনুষঙ্গ আবর্তিত হয় শুধু এবং শুধুই বৃক্ষকে ঘিরে। আজকের এই যান্ত্রিক সময়ে, যখন পৃথিবীর ফুসফুস জ্বলে যাচ্ছে মাসের পর মাসেরও বেশি দীর্ঘ দাবানলে, আগুন লাগছে বাঘমুন্ডির পাহাড়েও, যখন ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে অক্সিজেন— তখন এই ধরনের প্রকৃতির কাছাকাছি থাকা প্রান্তিক উৎসবগুলো নতুনভাবে ভাবতে বাধ্য করে আমাদের। তবু সন্দেহ জাগে, আমরা যথেষ্ট সম্মান দিয়ে শুনছি কি তাদের কথা? প্রচলিত টেক্সট বুকের বাইরে এই অন্যরকম ভালবাসার সুর কি বোঝার চেষ্টা করছি একটুও?
…………………………………………….
অভিমানভূম
(পুরুলিয়ার ধুলো মাটি নদী আর মানুষদের গল্প-কথা-মিথ)
শুভদীপ চক্রবর্ত্তী

প্রচ্ছদ : সন্দীপ রায়
অলংকরণ : সুলিপ্ত মণ্ডল

মুদ্রিত মূল্য : ৩৫০ টাকা

সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

প্রতিযাত্রা।। দুর্লভ সূত্রধর।। সুপ্রকাশ।।

লেটারপ্রেসের কম্পোজিটর : এক বিষাদান্ত পরম্পরা।। অনন্ত জানা।। সুপ্রকাশ।।

সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম।। মিহির সেনগুপ্ত।। সুপ্রকাশ।।