অভিমানভূম।। (পুরুলিয়ার ধুলো মাটি নদী আর মানুষদের গল্প-কথা-মিথ)।। শুভদীপ চক্রবর্ত্তী।। সুপ্রকাশ।।
এই বিশাল জোয়ার-ভাটা নদী আর তার পলি-কাদার গন্ধ নিয়ে বেড়ে উঠেছে যে, সেই তার কাছে পাথুরে মানভূমের এই রোগাসোগা পাঁজরের হাড় বের করা নদী ভাল লাগতে পারে কি? কিন্তু এতই আশ্চর্য এখানকার নদীদের রং আর রূপ, এমনিতেই বসে পড়তে ইচ্ছা হয় পাথরের গা ঘেঁষে। এদিকে বুকের ভিতর লুকানো ভীষণ ‘চাঁদের পাহাড়’। আনমনা ছেলেটা প্রথম যেদিন নদী দেখতে গেল, পাথুরে উপত্যকা দেখে বলে উঠেছিল, “আরে, এতো আমাদের ভেরি ওন রিখটারসভেল্ড!”
নদীর উপরেও সারি সারি পাথর। জলের উপর থাকলেও, পাথরে শ্যাওলা নেই একটুও। পাথরের মধ্যেই সবুজ ঘাসের দল মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে কোথাও কোথাও। তার নিচ দিয়ে কলকল চলে যাচ্ছে জল। মনে হয়, এই অসীম প্রকৃতি থেকেই হয়তো ‘সহাবস্থান’ শব্দটা এভাবে শিরায়-উপশিরায় ঢুকে গেছে এখানকার মানুষজনদের মধ্যে।
সরস্বতী পুজোর পরেরদিনের সকাল। তীব্র ডিজে বক্সের তাণ্ডব কাটিয়ে পিঠে ব্যাগপত্র নিয়ে হেঁটে যাচ্ছি কাজের জায়গার দিকে, দেখি রাস্তায় ভিড় অন্যদিনের থেকে অনেকটাই বেশি। ব্যস্ততা খুব আচমকাই। সরস্বতী পুজোর পরের দিন মানভূমের এই অঞ্চলে পালন করা হয়, ‘মাকুরি পরব’। কাঁসাই, মানে যে নদীর ভাল নাম কংসাবতী, তারই পাশের গ্রাম বুধপুরে নাকি এই মেলা হয়ে আসছে কয়েক শতাব্দী ধরে। মিতনদার সঙ্গে বেরিয়ে পড়ি ক্যামেরা, রেকর্ডার নিয়ে— যদি নিউজপেপার বা রেডিয়োতে কোনও খবর করা যায় এটার...
ঠিক কবে থেকে যে এই মাকুরি মেলার শুরু, সে তথ্য যদিও কারোর কাছেই পাওয়া গেল না। লোক উৎসবের বৈশিষ্ট্যই বোধহয় এটা। আজীবন বহতা নদীর মতো ভেসে চলা শুধু। দেখি, উৎসব ঘিরে বিশাল মেলা। কয়েক শতাব্দী পেরিয়ে গেলেও উৎসাহে যে বিন্দুমাত্র ভাটা পড়েনি, সে বোঝা যাচ্ছে থিকথিকে ভিড় দেখেই। মেলা বসেছে নদীর পাড়ে যেমন, তেমনই নদীর মধ্যেকার চরেও। বেশ কয়েকজন পুলিশের বড়কর্তাকেও দেখা গেল হাজির ভিড় সামলাতে। দূর-দূরান্ত থেকে গাড়ি বোঝাই হয়ে আসছে মানুষজন। মেলার প্রকৃতি যদিও মানভূমেরই অন্য পাঁচটা মেলার থেকে বিশেষ আলাদা কিছু নয়। প্রচুর খাবার দোকান, মেয়েদের সস্তা কাচের চুড়ি, কানের দুল, ঘরের কাজের জিনিস এমনই সব। কেনাকাটি সেরে নদীর চরেই বালির উপরে বসে পড়েছে মানুষ। যতক্ষণ দিনের আলো, ততক্ষণই উৎসব।
কিন্তু উৎসবের হেতুটা যে ঠিক কী, বোঝা যাচ্ছে না কিছুতেই। অথচ ইতিহাস তো একটা ঠিক থাকবে নিশ্চয়ই। অথবা, সত্যিই কি থাকার খুব একটা দরকার আছে? সহজ-সাধারণ মানুষ যেভাবে কোনও উপলক্ষ্য ভুলেই মেতে উঠেছে খুশিতে, সেরকম সহজ কি সত্যিই হতে ভুলে যাচ্ছি আমরা? এরা ভুলে যায়নি বলেই হয়তো, মেলা ঘোরা হয়ে গেলে ভিড় করেছে আবার বুধপুরেরই বিশাল ঐতিহ্যবাহী শিবমন্দিরে। ঐতিহ্য এর বিশালতায় নয়, প্রাচীনত্বে। ফেরার পথে স্থানীয় পুলিশকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা গেল, জেলার নানা প্রান্ত থেকে মেলায় এসেছেন সেদিন প্রায় দেড় লাখ মানুষ!
…………………………………………….
অভিমানভূম
(পুরুলিয়ার ধুলো মাটি নদী আর মানুষদের গল্প-কথা-মিথ)
শুভদীপ চক্রবর্ত্তী
প্রচ্ছদ : সন্দীপ রায়
অলংকরণ : সুলিপ্ত মণ্ডল
মুদ্রিত মূল্য : ৩৫০ টাকা
সুপ্রকাশ
Comments
Post a Comment