অভিমানভূম।। (পুরুলিয়ার ধুলো মাটি নদী আর মানুষদের গল্প-কথা-মিথ)।। শুভদীপ চক্রবর্ত্তী।। সুপ্রকাশ।।
‘ভাদর মাসে করম পরব
মুদের ঘরে ঘরে’
প্রচলিত বিশ্বাস, এই বিশেষ তিথিতে ভগবান বিষ্ণু অনন্ত শয্যায় পাশ ফিরে তাকিয়েছিলেন এই পৃথিবীর দিকে। যেদিকে দৃষ্টি পড়েছিল ভগবানের, পৃথিবীর সেই অংশ হয়ে উঠেছিল সুজলা-সুফলা। এদিকে এক নিঃসন্তান রাজা সন্তান কামনায় পুজো করেছিলেন করম দেবতার। সেই রাজার দুই সন্তান হয়— কর্মু আর ধর্মু। পরে এই রাজপুত্র কর্মুই উঠেপড়ে লাগেন এই করম পুজো চালু করতে তাঁদের সম্প্রদায়ের মধ্যে। আদিম কোনও এক পুণ্য লগ্নে মাহাতো কুড়মি সম্প্রদায়ের মধ্যে সেই থেকেই প্রচলন হয় করম পুজোর।
করম পরবের প্রচলিত ক্রিয়াকর্মের দিকে চোখ ফেরালে, সেখানেও পুজো আর ভক্তির সঙ্গে সহজ সারল্য একরাশ। অবশ্য এক্ষেত্রে স্থান বিশেষে প্রথা কিছু আলাদা হতেই পারে বলে ধারণা। ঘুরে-ফিরে যেটুকু জানা গেল, প্রতিবছর ভাদ্র মাসের শুক্লা একাদশী তিথিতে হয়ে থাকে এই করম পরব। করম পুজোর সঙ্গেই জড়িয়ে আছে প্রান্তিক মানুষদের আরও একটা পরব, ‘জাওয়া’। এটাও একেবারেই আরাধ্যা প্রজজন দেবীকে তুষ্ট করার পুজো। জাওয়া পরবের কয়েকদিন আগে থেকে একটা বেতের টুপা বা চুবড়িতে বালি ভরে, তার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হয় ডাল-মুগ-বুটা প্রভৃতি শস্যের বীজ। রোদে-জলে কয়েকদিনের মধ্যেই চুবড়িটা ভরে ওঠে নয়া শস্যের অঙ্কুরে। যে মেয়ের চুবড়ি লাবণ্য পায় যত বেশি, ভরে ওঠে শস্যে, তার উর্বরতা তত বেশি বলে মনে করা হয়। মনে করা হয়, করম হল সক্ষমতা, যৌবন ও সমৃদ্ধির দেবতার পুজো। আবার জাওয়া উৎসবেও আরাধনা করা হয় প্রজজনের বা উর্বরতার দেবীর। সেই কারণেই হয়তো এই দুই উৎসব একত্রিত হয়ে নাম হয়েছে ‘করম-জাওয়া’ পরব।
সেই শালের দাঁতন কাঠি নিয়ে নদীতে বা পুকুরে স্নান করে মেয়েরা ডালাগুলোকে রাখে গ্রামের প্রান্তিক একটা স্থানে। শুরু হয় জাওয়া গান। সেই গান গাইতে গাইতে ডালাগুলোকে ঘিরে ঘোরা হয় তিনবার। কুমারী ও অবিবাহিত মেয়েরা এরপর ভিজে কাপড়ে ছোট ছোট শালপাতার থালায় রাখে বীজগুলোকে। থালায় এঁকে দেওয়া হয় কাজলের তিনটে দাগ। এই যে সম্পূর্ণ হওয়া ডালা, এর নাম ‘জাওয়া ডালি’। বিভিন্ন লোকসংস্কৃতি গবেষকেরাও মনে করেন, ডালায় অঙ্কুরিত এই দানা শস্যগুলো প্রজননের প্রতীক। উন্নত দেশের জন্য চাই উন্নত শস্য ও সুস্থ মানুষ— এটাই যেন মূল কথা একটা প্রান্তিক পরবের। বিড়ির ধোঁয়া ছাড়েন বয়স্ক লায়া। কখন যেন পাশে এসে বসা গ্রামেরই বয়স্ক এক মাস্টারমশাই নিজের মনেই প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন গল্পে বিভোর আমাদের দিকে, “কী বলেন, ভাবনা আধুনিক কিনা?”
এই প্রত্যেকটি জাওয়া আলাদা করে চিহ্নিত করার জন্য পুঁতে দেওয়া হয় কাশ গাছের কান্ড বা কাশকাঠি। একে বলা হয় ‘জাওয়া পাতা’। যে সমস্ত কুমারী মেয়েরা সম্পূর্ণ করে এই পদ্ধতিটি, তাদেরকে বলা হয় ‘জাওয়ার মা’। বেলা পড়ে আসে। ভবিষ্যতের সুস্থ আনন্দোচ্ছল হাসি মুখের সন্তানদের কথা মনে করতে করতে জাওয়াগুলিকে নিয়ে গ্রাম্য পুকুর পারের চড়াই-উৎরাই রাস্তা ধরে ‘জাওয়ার মা’য়েরা গ্রামে ফিরে আসে গান গাইতে গাইতে।
…………………………………………….
অভিমানভূম
(পুরুলিয়ার ধুলো মাটি নদী আর মানুষদের গল্প-কথা-মিথ)
শুভদীপ চক্রবর্ত্তী
প্রচ্ছদ : সন্দীপ রায়
অলংকরণ : সুলিপ্ত মণ্ডল
মুদ্রিত মূল্য : ৩৫০ টাকা
সুপ্রকাশ
Comments
Post a Comment