অভিমানভূম।। (পুরুলিয়ার ধুলো মাটি নদী আর মানুষদের গল্প-কথা-মিথ)।। শুভদীপ চক্রবর্ত্তী।। সুপ্রকাশ।।
এক ঘন্টা কেন, সেরকম মন না থাকলে তো সারা জীবনেও জেনে ওঠা যায় না পাশের মানুষটাকে। আর এতো জলজ্যান্ত ইতিহাসের কথা! তবে এটা দেখেও আশ্চর্য লাগে যে, এখানকার মানুষদের গা লাগোয়া হয়েই এমন ঐতিহ্যময় ইতিহাস ছড়িয়ে থাকতেও আশেপাশের প্রায় সকলেই কী অসম্ভব নির্লিপ্ত! প্রথম প্রথম ব্যাপারটা দেখে একটু চোখে লাগলেও, পরে সামান্য হলেও হয়তো ধারণা করা যায় আদত বাস্তবতাটুকু। বুঝতে পারি যে, তাদের চারপাশের সঙ্গেই এত বেশি মিলেমিশে গেছে এই সবকিছু, আলাদা করে এর কারণ বা ঐতিহ্য খোঁজার প্রয়োজন হয়নি তাই হয়তো এদের আর। দু’বেলা দু’মুঠো অন্ন জোগাড় করে তারপর ঢোল সহরতে কেটে গেছে দিন-গুজরান। এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্ম। এসব এদের বাড়ির সহজাত উঠোনের মতোই তাই। বাড়ির লোককে অতিথিদের মতো আদরযত্ন করাটাই তো বরং চোখে লাগার ব্যাপার!
কোনও উপলক্ষ ছাড়া এর আগে বুধপুরে যাওয়ার সময় হয়নি সেইভাবে। উৎসবের সময় এত বেশি ভিড় থাকে যে, সেইসময় ভগবান হোক অথবা প্রাচীন ঐতিহ্য— কারোর কাছেই ঠিকঠাক পৌঁছানো যায় বলে মনে হয় না। বেশ চড়া রোদের একটা বিকেলে তাই প্রায় প্রথম দেখার মতোই পৌঁছে যাই বুধপুর। খুব বেশিক্ষণের রাস্তা নয়। কিন্তু, প্রাচীন মন্দিরের কাছাকাছি আসতেই নতুন করে আশ্চর্য হতে হয় খুব। আচমকাই মনে হয়, খুব প্রাচীন কোনও গ্রামের আলাদা গন্ধ থাকে কোনও? থাকলে সেই গন্ধ হয়তো এই বুধপুর বা পাকবিড়রার সঙ্গে মেলে। পরে একটু বইপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করে দেখেছি, একসময় ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে বেশ নাম ছিল এই গোটা অঞ্চলটারই। কংসাবতী নদী দিয়ে ভেসে আসত বড়বড় ব্যবসায়ীদের অলৌকিক জলযান। যতদূর মনে হয়, স্থলপথে আসতে গেলে ডাকাত বা লুটেরাদের হাতে পড়ার ভয় ছিল সেই সময় খুব বেশি। সেই তুলনায় জলপথে যাতায়াত ছিল অনেকটাই সহজ এবং সুরক্ষিত। মন্দিরের সামনে মলয়দার গাড়ি থেকে নেমে, পাথর দিয়ে তৈরি পুরো জায়গাটার গঠন দেখে অবাক হওয়ার অন্ত থাকে না। কত শতাব্দী পুরোনো মন্দির হবে কে জানে!
খানিকটা অপ্রাসঙ্গিক মনে হলেও, এই সব জৈন তীর্থস্থানে কীভাবে হিন্দু ধর্মের ছোঁয়া লাগল সেই নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে জমা হয়েছে বহু মতবাদ। এক্ষেত্রে অনেকেই বিষয়টাকে সংখ্যাগুরু ধর্মের আগ্রাসী মনোভাব দিয়ে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করলেও, ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়েছে, এটা আসলে আগ্রাসী মনোভাবের থেকেও বেশি বরং সম্পৃক্ত হয়ে যাওয়া স্থানীয় মানুষ বা লোকাচারের সঙ্গে— যেখানে দেবতাকে নিজের মনের মতো মানিয়ে নিচ্ছে মানুষ। সম্পূর্ণ পাথরে খোদাই করে তৈরি করা শিবলিঙ্গ। বেশ বড় গণেশের মূর্তি। এবং, মাটি থেকে হাতির শুঁড় তুলে থাকা অদ্ভুত পাথরের মূর্তি একটা। এসব আচমকা ইতিহাস দেখলে, অচেনা অজানা সৃষ্টিকর্তাদের কাছে নতজানু হয়ে যাই মনে মনে। সেই সব শিল্পীদের কাছে, যাঁরা এই একলা প্রান্তে বসে শুধু ভগবানকে রূপ দেওয়ার জন্যই পার করে দিয়েছিলেন কত মুহূর্তের পর মুহূর্ত!
….................................................
Comments
Post a Comment