অভিমানভূম।। (পুরুলিয়ার ধুলো মাটি নদী আর মানুষদের গল্প-কথা-মিথ)।। শুভদীপ চক্রবর্ত্তী।। সুপ্রকাশ।।
সাঁওতালি গ্রামগুলোতে কোনও কাজের জন্য গেলে, কাজের পরেও একটু বেশি সময় থেকে যাই সেখানে। এটা-সেটা গল্প হয় করকট্যা, বারোমাস্যা, জলহরি এইসব ছবির মতো গ্রাম আর তার মানুষদের সঙ্গে। কেমন পরিচিত হয়ে যায় সকলেই, যেন পাশের ঘরের ছা! যে কোনও সময় যে কোনও গ্রামেই চলে যেতে বাধা নেই একদমই। সন্ধের পরে দাওয়া থেকে ওঠার তোড়জোর করলেই ধমক দিয়ে বসিয়ে মুড়ির বাটি এগিয়ে দেয় সরলাদি। হড় ঘরের বউ সরলা সোরেনের সেই ধমক অগ্রাহ্য করে, এত ক্ষমতাই বা কার!
জলহরি গ্রামটার পাশেই বেশ উঁচু সবুজ পাথুরে একটা টিলা। সেটার উপর উঠে গেলে দেখা যায় নেমে আসা সূর্য ধীরে ধীরে একা হয়ে যাচ্ছে কেমন। একা হয়ে যেতে যেতে কেমন জায়গা ছেড়ে দিচ্ছে অন্যান্য নক্ষত্রদের। অন্ধকার একটু জমাট বাঁধতে থাকলে নিচ থেকে ডাক দেয় তখন কেউ। “কালো হয়ে গেলে দাদা মুশকিল হবে নামতে!” মিতনদাদের গ্রাম করকট্যায় গেলেই আবার কাজের পর মিতনদা বা তার বাড়ির লোকের সঙ্গে আড্ডা মারা একটা বেশ মজার ব্যাপার। একদিন বিকেলের দিকে দেখি, মিতনদার ভাইপোর সঙ্গে গ্রামের আরও দু-তিনটে বাচ্চা বেশ বড় কয়েকটা ইঁদুর ধরে নিয়ে এসেছে মাঠ থেকে। মনে ফুর্তি খুব। “তা, কী করবি রে ওগুলো নিয়ে?” জিজ্ঞেস করতেই খুশি চেপে রাখতে না পেরে বত্রিশ পাটি উবাচ। “খাব!” মঞ্জুরের দিয়ে তাকাই। সত্যি সত্যি ইঁদুর খাবে? মঞ্জুর হাসতে হাসতে বলে, ওদেরকেই জিজ্ঞেস করো! আবার জিজ্ঞেস করি অগত্যা, কী করে খাবি রে? ইঁদুরের লেজ ধরে নাড়াতে নাড়াতে হাসতে হাসতে উত্তর আসে এবার, “আগুনে পুড়াবো। তারপর খাব...”
মিতনদাদের গ্রামের বাঁদিকে একটা শালবন। আর ডানদিকে গেলে উঠে যাওয়া যায় আর একটা উঁচু মতো টিলায়। সেখানে বসলে চোখের সামনে খলবল করে হলুদ সর্ষের দল। একটু দূরেই নিচু একটা পুকুর থেকে পাম্প দিয়ে টেনে আনা জল গুবগুব করে মিশে যাচ্ছে ক্ষেতের মাটিতে। সেইসব সূর্যাস্তের সামনে বসে কথা বলতে পারি না আমরা কেউ। এত ক্ষুদ্র মনে হয় সমস্ত পিছুটান, রোজকার দিন আনি দিন খাই সব সমস্যা— যে উঠতে ইচ্ছে করে না একদমই। সহজ-সরল ভাল মানুষ মিতনদাও ডাকতে এসে বসে পড়ে পাশে। আরও একটু গলা নামিয়ে বলে, “একটু চা হয়েছে বাড়িতে; খেয়ে যেও।” ফেরার পথে হাঁটতে হাঁটতে বলি, “একটু মহুয়া হবে মিতনদা?” মিতনদা হেসে ফেলে। “কাল দেব। কিন্তু খুব অল্প। বেশি খেতে পারবে না...”
…...............................
Comments
Post a Comment