নষ্ট চাঁদের আলো।। অলোক সান্যাল।। সুপ্রকাশ।।
গায়েরা নিরুত্তাপ ভঙ্গিতে সিঁড়িতে পা রেখেছিল। পেছন থেকে তার হাত টেনে ধরল মাগাভা। দ্বীপের মুখ থেকে, বুঝি কোনো জাদুবলে আরেকটা জাহাজ সমুদ্র ফুঁড়ে হাজির হয়েছে! উঁচু মাস্তুলে মড়ার খুলি আঁকা একটা কালো নিশান বিপদ জারি করছে। মাগাভা দেখল ঝলমলে টুপি পরা সাদা চামড়ারদের সর্দার নাগাড়ে চিৎকার করে চলেছে। কয়েকজন যুদ্ধবাজ তার ডাকে সাড়া দিয়ে ইস্পাতের ফলা বের করল। কয়েকজন আবার কী করবে বুঝতে না পেরে ডেকে ইতিউতি ছোটাছুটি শুরু করেছে। সঙ্গে 'পি-হাত' বলে চেঁচিয়ে চলেছে। জনা কয়েক ছুটে নিচে সিঁড়ি পথ নিল। আর তখনই একটা অদ্ভুত দৃশ্য সকলকে স্থাণু করে দিল।
হঠাৎ উদয় হওয়া পাশের জাহাজ থেকে দড়িতে দোল খেয়ে নিপুণ দক্ষতায় নেমে আসছে কিছু মানুষ। হিংস্র চাহনি। তাদের হাতেও ধারালো ইস্পাতের ফলা। ভীষণ চেহারাগুলোর মধ্যে একজনকে দেখে চমকে উঠতে হয়। যেন সাক্ষাৎ শয়তান! গোটা মুখ কালো দাড়িতে ঢাকা। মুখের ঘন লম্বা চুলগুলো সামলানোর জন্য কিংবা সাজাতে বিনুনি মতো করে বাঁধা। মাঝ কপালে আড়াআড়ি একটা গভীর ক্ষত চিহ্ন। সেই চিহ্ন মুখের বীভৎসতা আরও বাড়িয়ে তুলেছে। চোখের কোটরে দুটো জ্বলন্ত কয়লার টুকরো ভরা যেন! লোকটার দিকে তাকিয়ে অজান্তেই কেঁপে উঠল মাগাভা। হয়তো সকলেই।
'নরক নামিয়ে আন শয়তানের বাচ্চারা।'
বলেই কাঁধে ঝোলা বেল্টের হোলস্টার থেকে পিস্তল বের করে গুলি ছুঁড়ল এডওয়ার্ড। নির্ভুল লক্ষ্য! পিস্তল যথাস্থানে রাখার ফাঁকে অন্য হাতে ধরে রাখা দড়ি ছেড়ে ডেকে লাফিয়ে নামল সে। তারপর দ্রুত দ্বিতীয় হোলস্টার থেকে পিস্তল বের করে ট্রিগারে আঙুল ছোঁয়াল। এবারেও তপ্ত সীসা গেঁথে গেল খোলা তলোয়ার হাতে ছুটে আসা ফরাসি যোদ্ধার হৃদয়ে। ডেকের ওপরে মুখ থুবড়ে পড়ল দেহটা। ততক্ষণে বাকি সঙ্গীরা আশেপাশে নেমে এসেছে। সবার হাতেই ঝলসে উঠছে কাটলেস। রক্তপানে উদগ্রীব। চল্লিশ জনের দলটা কিছুক্ষণের মধ্যেই লা কংকর্ডকে ফালা ফালা করতে শুরু করে দিল। অথচ বিপক্ষে লোকবল দ্বিগুণ! আক্রমণে দিশেহারা ফরাসি ফ্রিগেট যখন ব্রডসাইড ফায়ার করল, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। ডেকের ওপরে সত্যিই নরক নামিয়ে এনেছে এডওয়ার্ড টিচ্ আর তার দলবল!
কুঠুরিতে নামার সিঁড়ির মুখটায় দাঁড়িয়ে লড়াইয়ের মজা নিচ্ছিল দুই বন্ধু। বাকি বন্দী দাসেরা প্রাণভয়ে নিচে নেমে গেছে। গত দু-মাস ধরে যে মানুষগুলো নিষ্ঠুর অত্যাচারে জর্জরিত করেছিল, তাদের মর্মন্তুদ আর্তনাদ গায়েরার দেহ-মনের জ্বালায় যেন শান্তির প্রলেপ লাগিয়ে দিচ্ছে। ওই তো কোয়ার্টার মাস্টার লুইস ব্লাঁ, কালো দাড়িয়াল দস্যুর গুলিতে পাটাতনে লুটিয়ে পড়ল! গায়েরার ঠিক পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে মাগাভা। তার দুটো চোখ যুদ্ধরত দু'পক্ষের ভিড়ের মধ্যে কিছু খুঁজে চলেছে। একটু দূরেই প্রবল বিক্রমে লড়ছে দাড়িয়ালা দশাসই লোকটা। একা হাতে দু-দু'জন যোদ্ধার মহড়া নিচ্ছে! সেদিক থেকে তার নজর সরে গেল মাঝের বড়ো মাস্তুলের কাছে। মাস্তুলের গোড়ায় অনেকগুলো কাঠের বাক্স একটার ওপরে একটা স্তূপীকৃত করা। বাক্সগুলোর কাছে গিয়ে মাগাভার দৃষ্টি থমকে দাঁড়াল। টোগবে! কাপুরষটা আড়াল নিয়েছে। হাতের খোলা লম্বা ছুরিটা নিয়ে সঠিক মুহূর্তের অপেক্ষায়। কালো দাড়িয়ালকে অন্য দু'জনের সঙ্গে লড়াইয়ে মেতে থাকতে দেখে হায়েনার মতো নিঃশব্দে আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে আসছে। পেছন থেকে আঘাত হানতে চায়! দীর্ঘদেহীর যত পুরুষত্ব নিঃসহায় মেয়েদের ক্ষেত্রে প্রকট হয়ে ওঠে। গায়েরা কিছু বোঝার আগেই সিঁড়ির মুখ থেকে ছিটকে বেরিয়ে এল মাগাভা। সামনেই একজন সাদা চামড়ার যোদ্ধা পড়ে কাতরাচ্ছে। কয়েক হাত দূরে পাটাতনে নিরীহভাবে পড়ে রয়েছে তার হাতের অস্ত্র। পড়ে থাকা শরীর টপকে ছুটন্ত অবস্থায় মাগাভা চিতার ক্ষিপ্রতায় নিজেকে ছুঁড়ে দিল। একটা ডিগবাজি খেয়ে উঠে দাঁড়ানোর ফাঁকে তুলে নিল ইস্পাতের ফলা। তার দুটো হাত এখনো বাঁধা। তাতে বরং সুবিধাই হয়েছে। অস্ত্রকে দু-হাতের শক্তি জড়ো করে ধরতে পেরেছে। টানটান শরীরের ভর মুহূর্তের জন্য পেছনের পায়ে স্থানান্তরিত করেই জ্যা মুক্ত তীরের গতিতে সে আছড়ে পড়ল টোগবের ওপরে।
সামনের আঘাত এড়িয়ে চমকে পেছনে তাকাল এডওয়ার্ড। দীর্ঘদেহী এক নিগার ঠিক তার পেছনে! হাতের উদ্যত ফলা তাকে ফুঁড়ে দেওয়ার জন্যই উঠিয়েছিল। নিশ্চিত মৃত্যু নেমে আসার আগেই মঞ্চে উপস্থিত হয়েছে আরও এক নিগার। বাঁধা দু'হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরা এপে। কোনো নিহত ফরাসি যোদ্ধার তলোয়ার। এডওয়ার্ড পলকের মধ্যেই বুঝে নিল দ্বিতীয়জন বন্দী ক্রীতদাস। সামনে পেছনে, দু'দিকেই বিপদ বুঝে চট করে নিজের জায়গা বদলে নিল সে।
চমকে উঠল টোগবেও। মাগাভার চোখ-মুখ সেন্ট ভিনসেন্ট দ্বীপের আগ্নেয়গিরির মতো ফেটে পড়তে চাইছে! সামলে ওঠার আগেই নিজের হৃদপিণ্ডে সুতীক্ষ্ণ যন্ত্রণা অনুভব করল দীর্ঘদেহী টোগবে।
.....................
নষ্ট চাঁদের আলো
অলোক সান্যাল
......................
প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী
অলংকরণ : সৌজন্য চক্রবর্তী , অদ্বয় দত্ত
মুদ্রিত মূল্য : ৫৯০ টাকা
সুপ্রকাশ
Comments
Post a Comment