Posts

Showing posts from July, 2024

অভিমানভূম।। (পুরুলিয়ার ধুলো মাটি নদী আর মানুষদের গল্প-কথা-মিথ)।। শুভদীপ চক্রবর্ত্তী।। সুপ্রকাশ।।

Image
গাছেদের কাছে যাওয়া হয় না কতদিন? কতদিন শোনা হয় না বাকলের ভাষা? এই যে শুকতারা দেখার লোভে প্রতিদিন হারিয়ে ফেলছি রোহিনী, স্বাতী, বিশাখা, অনুরাধা; পথ হারিয়ে ফেললেও উত্তর-ফাল্গুনীর থেকে সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না কোনও। রাত বাড়ে যত, ঝকঝকে আকাশে তত বেশি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে নীলচে সবুজ আলোর দল। আমাদের এই গ্রহের অন্ধকার এক কোণায় প্রাচীন ঘনীভূত লাভা স্তরের উপর পিঠ পেতে দিলে, আরও বেশি মায়াময় হয়ে ওঠে এই তাপহীনতা, আলোহীনতা। এই কার্তিক-নবান্নের দেশে ঝরে পড়তে থাকে হেমন্ত ফসল। ধানের ছড়ায় মিশে চালের গুঁড়ির ছিটা পড়ে গোবর নিকানো দুয়ারে। দমে টান দিয়ে বাঁধা হয় জোরসে ধামসা। পরখ করে নেওয়া হয় মাদলের বোল। তারায় তারায় রটে যায় সেই সমাগত সুখের দিন— আজ কালী বোঙ্গার পুজো! কাল থেকে সহরায়! ….............................. সহরায়ের দ্বিতীয় দিন, অর্থাৎ সারডি মাহাতে পিতৃপুরুষদের অর্চনার সঙ্গে সঙ্গে পুজো করা হয় গৃহ দেবতা বা কুল দেবতারও। দূর-দূরান্ত থেকে আত্মীয়স্বজন, অতিথিরা আসতে থাকেন ঘরে। নাচে, গানে, মহুয়া-হাড়িয়ার নেশায় জমে ওঠে মহল্লা। এরপর পুজোর চাল এবং বলি দেওয়া মুরগীর মাথা দিয়ে তৈরি করা হয় একটা বিশেষ পদ, যার নাম ‘সোরে’। দেবতা ছাড়া...

অভিমানভূম।। (পুরুলিয়ার ধুলো মাটি নদী আর মানুষদের গল্প-কথা-মিথ)।। শুভদীপ চক্রবর্ত্তী।। সুপ্রকাশ।।

Image
কালো একটা চাদর ঢেকে ফেলছে ক্রমশ আকাশ। তার কালো ছায়ায় আরও গাঢ় হয়ে উঠছে কালচে সবুজ। পাথরের ফাঁকে ফাঁকে চোখ মেলছে জংলী লতা। মাথা তুলে যেন বুলি ফোটা বাচ্চাদের মতো শোনাতে চাইছে কিস্‌সা কোনও দূরের দেশের। বৃষ্টি আসছে খুব। খুব বারিষ! খলবল করতে করতে ছুটছে কোথায় ছেলেপুলের দল? “বাঁধের ধারে। মাছ উঠবে তো!” শিলাই মাঠের হরিমন্ডপে আড্ডা খানিক প্রৌঢ় বা মধ্যবয়স্কদের। তাদের আশেপাশে, সামনে বা পিছনের দিগন্তে সবুজ খুব বেশি এখন। সবুজ খুব ঘাস। গাছের পাতা। রুখা জমিতে কদিনের জন্য যেন আদরের প্রলেপ। পুরুলিয়া টাউন থেকে কাজ সেরে ফেরার পথে দেখা হয় এইসব কিছু কিছু অল্প চেনা জানা মুখের সঙ্গে। ডাক আসে অধিকারের টানে। কী সেই অধিকারের নাম? জানা নেই। ভালবাসা কি এতই সহজে পাওয়া যায়? কিংবা নিছক স্নেহ বা বন্ধুত্ব? দু’গ্লাস চায়ের পরে উঠতেই হয় অগত্যা। খুব বৃষ্টি চলে এলে আটকে পড়তে হবে। সঙ্গে ডকুমেন্টস বেশ কিছু। আর এই গ্রাম থেকে ভোরবেলা টাউনে গিয়ে সারাদিনের কাজ সেরে ফেরা তারপর আরও পঞ্চান্ন কিলোমিটার— ব্যাপারটা একটু ক্লান্তিকরও বটে। “চলল্যে?” “উঠি এবার!” এখন আর “বাড়ি যাব” বলা হয় না। বলি, “ঘর যাব।” বলি আবার আসবো পরে একদিন। ফিরতেই ফির...

অভিমানভূম।। (পুরুলিয়ার ধুলো মাটি নদী আর মানুষদের গল্প-কথা-মিথ)।। শুভদীপ চক্রবর্ত্তী।। সুপ্রকাশ।।

Image
ট্রেন থেকে নেমেই কেঁপে গেলাম আরও। এটা কেমন ঠান্ডা! জ্যাকেটের ভিতরে হাফহাতা সোয়েটার। তাও যেন তীরের মতো বিঁধছে হাওয়া। যেখানে পৌঁছোতে হবে সেটা আরও প্রায় পঞ্চাশ বা পঞ্চান্ন কিলোমিটার দূরে। এখানেই এমন ঠান্ডা হলে সেখানে যে কী অবস্থা হবে, সেটা ভাবতে ভাবতেই একটা রিক্সা ধরে পৌঁছে গেলাম পুরুলিয়া বাসস্ট্যান্ড। হাতে কোনও সাড় নেই। আঙুলগুলোকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে আবার গরম চায়ের গ্লাস চেপে ধরি দুই হাতের মধ্যে। মানুষজনের ভাষাটা বাংলা বলে মনে হলেও অদ্ভুত একটা টান। চায়ের দোকানে জিজ্ঞেস করি, “মানবাজার-পুঞ্চার বাস?” আঙ্গুল তুলে দিকনির্দেশ হয়ে যায়। সেই দিক বরাবর হেঁটে কনডাক্টরকে এগিয়ে দিই টিকিটের ভাড়া, “পুঞ্চা নামবো। লৌলাড়া কলেজ। জানালা দেখে দিও।” বরাবর উইন্ডো সিটের লোভ ছাড়া যায় না কিছুতেই। জানালা দেখেই দেয়। শহর পেরোতেই বিজাতীয় বাসের হর্নের শব্দে সামনের কুয়াশাও যেন থতমত খেয়ে যায় একটু। জানুয়ারির সকাল। সবুজ জমির উপর থিকথিকে কুয়াশার মেঘ। সারারাতের জার্নির পরে আলস্য অথবা ক্লান্তিরা চোখ টেনে ধরে কখন যেন আবার। বাসের ভিতর ভিড়ও বেড়ে চলেছে সমানে। এইসব সহযাত্রীরাও আমার দেশের মানুষ! ভাবত...

অভিমানভূম।। (পুরুলিয়ার ধুলো মাটি নদী আর মানুষদের গল্প-কথা-মিথ)।। শুভদীপ চক্রবর্ত্তী।। সুপ্রকাশ।।

Image
সাঁওতালি গ্রামগুলোতে কোনও কাজের জন্য গেলে, কাজের পরেও একটু বেশি সময় থেকে যাই সেখানে। এটা-সেটা গল্প হয় করকট্যা, বারোমাস্যা, জলহরি এইসব ছবির মতো গ্রাম আর তার মানুষদের সঙ্গে। কেমন পরিচিত হয়ে যায় সকলেই, যেন পাশের ঘরের ছা! যে কোনও সময় যে কোনও গ্রামেই চলে যেতে বাধা নেই একদমই। সন্ধের পরে দাওয়া থেকে ওঠার তোড়জোর করলেই ধমক দিয়ে বসিয়ে মুড়ির বাটি এগিয়ে দেয় সরলাদি। হড় ঘরের বউ সরলা সোরেনের সেই ধমক অগ্রাহ্য করে, এত ক্ষমতাই বা কার! জলহরি গ্রামটার পাশেই বেশ উঁচু সবুজ পাথুরে একটা টিলা। সেটার উপর উঠে গেলে দেখা যায় নেমে আসা সূর্য ধীরে ধীরে একা হয়ে যাচ্ছে কেমন। একা হয়ে যেতে যেতে কেমন জায়গা ছেড়ে দিচ্ছে অন্যান্য নক্ষত্রদের। অন্ধকার একটু জমাট বাঁধতে থাকলে নিচ থেকে ডাক দেয় তখন কেউ। “কালো হয়ে গেলে দাদা মুশকিল হবে নামতে!” মিতনদাদের গ্রাম করকট্যায় গেলেই আবার কাজের পর মিতনদা বা তার বাড়ির লোকের সঙ্গে আড্ডা মারা একটা বেশ মজার ব্যাপার। একদিন বিকেলের দিকে দেখি, মিতনদার ভাইপোর সঙ্গে গ্রামের আরও দু-তিনটে বাচ্চা বেশ বড় কয়েকটা ইঁদুর ধরে নিয়ে এসেছে মাঠ থেকে। মনে ফুর্তি খুব। “তা, কী করবি রে ওগুলো নিয়ে?” জিজ্ঞেস ক...

অভিমানভূম।। (পুরুলিয়ার ধুলো মাটি নদী আর মানুষদের গল্প-কথা-মিথ)।। শুভদীপ চক্রবর্ত্তী।। সুপ্রকাশ।।

Image
রেডিয়ো স্টেশনের অনুষ্ঠান এখন যেমন চ্যানেল টিউন করলেই শোনা যায় মোবাইলের বা ট্রানজিস্টার রেডিয়োতে, পুরুলিয়ায় কমিউনিটি রেডিয়োর শুরুর দিকে একদমই সেরকম ছিল না ব্যাপারটা। বরং ‘অনএয়ার ব্রডকাস্টিং’ শুরু হয়েছিল বেশ খানিকটা পরেই, তার কারণ এটার জন্য নির্দিষ্ট কিছু টেকনোলজি এবং সরকারি অনুমতির প্রয়োজন হয়। দীর্ঘ টালবাহানার পর একসময় মিলল সেই সম্মতি। সোজা হয়ে দাঁড়ালো ত্রিশ ফুট লম্বা রেডিয়ো ট্রান্সমিটার টাওয়ার। রেডিয়ো স্টেশন থেকে সাত কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে শোনা যেতে লাগল গ্রামীন কমিউনিটি রেডিয়োর সমস্ত অনুষ্ঠান। কিন্তু প্রযুক্তির ব্যবহারেও অশান্তির কমতি কিছু নেই। ঝড়ঝাপটায় ট্রান্সমিটারের মুখ ঘুরে যায় মাঝেমধ্যেই। তার ফলে কিছু কিছু গ্রামে অনুষ্ঠান শুনতে যে সমস্যা হচ্ছে, সে অভিযোগ ছিল কয়েকদিন ধরেই। তাছাড়াও সাত কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে সমস্ত গ্রামেই পরিষ্কার ব্রডকাস্টিং হচ্ছে কিনা, সেটাও ঘুরে দেখার প্রয়োজন ছিল একটু। প্রথম প্রথম কয়েকদিন আমি আর মঞ্জুর বেশ কয়েকটা গ্রামে ঘুরে বুঝলাম যে, নিজেদের পক্ষে এই পুরো কাজটা করে ওঠা মুশকিল। ফলে দায়িত্বটা ভাগ করে দেওয়া হল রেডিয়ো স্টেশনের বাকি সহকর্ম...

অভিমানভূম।। (পুরুলিয়ার ধুলো মাটি নদী আর মানুষদের গল্প-কথা-মিথ)।। শুভদীপ চক্রবর্ত্তী।। সুপ্রকাশ।।

Image
অসুর সম্প্রদায়ের কথা আগে ইতিউতি কানে এসেছিল বটে। কিন্তু এই অঞ্চলে যে এঁরা এত বড় একটা প্রতিবিপ্লব করে ফেলেছেন প্রায়, সেটা না দেখলে বিশ্বাস করা অসম্ভব হত। বেশ কয়েক দিনের চেষ্টায় খুঁজে পাওয়া গেল এই সম্পূর্ণ আয়োজনের যিনি মূল হোতা, সেই অজিত প্রসাদ হেমব্রমকে। পুরুলিয়ারই মানুষ, তাই মঞ্জুরকে পুরো বিষয়টা বুঝিয়ে ফোন করতে বললাম একটুও দেরি না করে। উদ্দেশ্য, এখানে যদি উনি এই মুহূর্তে থাকেন, তাহলে কবে, কখন আর কোথায় গেলে একটু কথা বলা যাবে অজিত প্রসাদের সঙ্গে, সেটা জানতে চাওয়া। সময় পাওয়া গেল তার দু-তিন দিন পরেই। মঞ্জুরের বাইকে আমি আর মিতনদা সওয়ারি হয়ে রওয়ানা দেওয়া গেল কাশীপুরের দিকে। বেশ কয়েকবার ফোন করে সঠিক জায়গায় পৌঁছে দেখা হল যে মানুষটার সঙ্গে, তার একটা চোখ অস্বাভাবিক রকম লাল। দেখেই মনে হয়, কোনও অসুস্থতা আছে গভীর। অজিত প্রসাদ হেমব্রম যে তাঁর এই বিকল্প উদযাপন প্রচারের জন্য বেশ দৌড়াদৌড়ি করছেন, সেটা অবশ্য ইতিমধ্যেই জানতে পেরেছি তার আগেই বেশ কয়েকটা রিপোর্ট দেখে। ডাক এসেছে এমনকি জওহরলাল নেহেরু ইউনিভার্সিটি থেকেও। এবং সেই সঙ্গেই চলছে বেশ কিছু বই লেখার কাজ। খানিকটা অবাক হয়েই দেখলাম, বইগুলো মূ...

অভিমানভূম।। (পুরুলিয়ার ধুলো মাটি নদী আর মানুষদের গল্প-কথা-মিথ)।। শুভদীপ চক্রবর্ত্তী।। সুপ্রকাশ।।

Image
চায়ের দোকানে বসেই নাকি দেখে ফেলা যায় একটা গোটা সমাজ, এরকম একটা লাইন কি কেউ লিখে গিয়েছিলেন আগে? লিখে না থাকলেও, সত্যিই যে চায়ের দোকানে বসে একটা গোটা সমাজ ব্যবস্থার মোটামুটি একটা ছবি এঁকে ফেলা যায় চোখের সামনে, সেটা বুঝতে পারি বেশ। ভগবানদার দোকানের তুলনায় শেখরদার চায়ের দোকানে ভিড়টা একটু বেশিই। তার কারণ, দোকানটা একদমই লৌলাড়া কলেজ বা ছেলেমেয়েদের স্কুল আর হোস্টেল সংলগ্ন। ছুটির দিন ছাড়া প্রায়ই চায়ের দোকানের সামনে লেগে থাকে ছেলেমেয়েদের ভিড়। গ্রামের পাশে পাশে উঁচু-নিচু টিলা। খুব ইচ্ছা হয়, একদিন একটা টিলার উপর বসে একটা সূর্যের ডুবে যাওয়া দেখব একা একা। কিন্তু কাজের চাপ বাড়ছে দিনের-পর-দিন। সময় বের করাই হয় না প্রায়। হাজারটা ফাইল। ডকুমেন্টেশান। সরকারি নথি। ইমেল। প্রোজেক্ট বাজেটের চাপ। সেইসঙ্গে মাথাব্যথার রোগটাও যেন জাঁকিয়ে বসছে পাল্লা দিয়ে। রোজ ওষুধ খেতে হয় এক গাদা। স্টুডিয়ো থেকে কেউ কেউ যখন ঘরে আসে, তখন টেবিলের উপর সাজিয়ে রাখা ওষুধের স্ট্রিপ দেখে তারা বলেও ফেলে, “ওষুধ খেয়েই তো পেট ভরে যায়, তাই তোমায় খেতে হয় না কিছু আর!” কাজের পোস্ট বা ডেজিগনেশন-টেজিগনেশন গুলি মেরে, কাজের বাই...

অভিমানভূম।। (পুরুলিয়ার ধুলো মাটি নদী আর মানুষদের গল্প-কথা-মিথ)।। শুভদীপ চক্রবর্ত্তী।। সুপ্রকাশ।।

Image
কোন মেঘ কখন যে ডানা পাঠায়, তার খোঁজ করতে করতেই এরমধ্যে হঠাৎ রাতের দিকে মঞ্জুরের ফোন। দশটা পেরিয়ে গেছে। ওই সময় এখানকার কারোর থেকে ফোন পাওয়া একটু আশ্চর্যই বটে! ফোন ধরতেই চিরাচরিত মঞ্জুর, “কী হে, রাতে আসবে নাকি?” দামোদরপুরে বিশাল ছো-লাচ পালা আজ! সারা রাতভর। অবশেষে পাওয়া যায় কাঙ্খিত সেই ডানা। মঞ্জুরের বাইকে খানিকক্ষণের উড়ান শেষে, যেখানে পৌঁছানো হয় শেষমেষ, সে দৃশ্যটা অভূতপূর্ব। একটা বিশাল মন্ডপ, কিন্তু দর্শকদের সঙ্গে শিল্পীদের উচ্চতার পার্থক্য নেই কোনও। স্টেজ বলতে ধুলোময় জমিটাই। সেইটাই দর্শকাসনও বটে। ধুলোময় জমির স্টেজের একদিকে অর্কেস্ট্রা দল। ধামসা, মাদল, বাঁশি আর আরও অনেক রকম বাজনাপত্র নিয়ে পালা জমাতে প্রস্তুত তারা। শুরুর আগে একটু বিড়ির মৌতাতে জাল দিয়ে ঘন করে নেওয়া ধুনকি মেজাজ। পালায় গান গাইবেন যে গায়ক, গলার সাম্মানিক উত্তরীয় গুছিয়ে নিতে ব্যস্ত তিনি বেজায়। নাচের শিল্পীদের জন্য বাকি গোটা ময়দানটাই। আশেপাশের গ্রাম থেকে মানুষ ভেঙে পড়েছে পালা দেখতে। কিংবা অনেকে দেখছেও না। এদিক-সেদিক ঘুরছে, নেশা করছে একটু দূরের অন্ধকারে। বিবাহিত মহিলাদের কোলের উপর ঘুমিয়ে পড়েছে ছোট শিশু। মনে হচ্ছে এই পালা...

অভিমানভূম।। (পুরুলিয়ার ধুলো মাটি নদী আর মানুষদের গল্প-কথা-মিথ)।। শুভদীপ চক্রবর্ত্তী।। সুপ্রকাশ।।

Image
পুরুলিয়া-কলকাতা আর কলকাতা-পুরুলিয়া যাতায়াতের মধ্যে এই তীব্র গরমের দিনগুলো কেমন হলুদ রঙের মায়ার মতো ভিড় করে আসে বিকেলের জানালার কাছে। পুরুলিয়া যাওয়ার জন্য সকালের ‘রূপসী বাংলা’ আর বিকেলের ‘পুরুলিয়া এক্সপ্রেস’ বিলকুল না-পসন্দ। রাতের চক্রধরপুর প্যাসেঞ্জার ছাড়া বরং মায়াবী ভীষণ দুপুরের রাঁচি-হাওড়া ইন্টারসিটিটা। ঝাড়গ্রাম থেকে টাটানগর হয়ে বরাভূম পেরিয়ে ঢোকে সেটা পুরুলিয়ায়। ছোটার পথে পার হয় বিশাল ছোটনাগপুর মালভূমি রেঞ্জ। দুপুরের রোদটা পড়ে এলেই, বাইরের গনগনে গরম হাওয়ার তেজটাও পড়ে আসে কেমন। তার সঙ্গেই গা ধুয়ে পাড়া বেড়াতে বের হওয়া মেয়েদের মতো জেগে ওঠে অদ্ভুত সুন্দর নামের একেকটা স্টেশন। নামের থেকেও বেশি সুন্দর হয়তো গাছপালা ঘেরা তার নির্জনতা। স্নিগ্ধতাও ছিমছাম ভীষণ। লাল-সাদা দেয়াল। গাছের পাতায় ভরে আছে স্টেশনের লালচে বেঞ্চিগুলোও। প্ল্যাটফর্ম জুড়ে শালপাতা, অশথপাতা। সেই খয়েরি-সবুজ পাতাদের ব্যাকড্রপে আবছা ধূসর একটা পাহাড়। পাহাড়ের পিছন দিয়ে অন্ধকার নেমে এলে ঝুপুস, ট্রেন থেকেও নামার সময় হয়ে আসে। এবং স্টেশনে বাহন নিয়ে হাজির মলয়দা। লাস্ট বাস তো বিকেল চারটে বাজলেই পগারপার! এত সন্ধেয় ভরসা অগত্...

অভিমানভূম।। (পুরুলিয়ার ধুলো মাটি নদী আর মানুষদের গল্প-কথা-মিথ)।। শুভদীপ চক্রবর্ত্তী।। সুপ্রকাশ।।

Image
এদিকে গরম পড়তেই ব্যস্ততা বেড়ে যায় ছো-পার্টির। পুরুলিয়া মানেই যে ‘ছো লাচ’ বা ছৌ নাচ, সেটা বেশ খানিকটা সত্যিও বটে। ছৌ নাচের পালা বসে সাধারণত গরমকালের মাসগুলোতেই। সন্ধের পর জ্বলে ওঠে হলুদ বিজলি বাতির জ্যোৎস্না। সারাদিন মাঠেঘাটে কাজ করার পর ক্লান্ত হা-হদ্দ মানুষগুলো মেতে ওঠে মহিষাসুরমর্দিনী পালা, কার্তিকেয় পালা বা শিব-পার্বতীর পালায়। মাথা নিচে পা উপরে করে লাফিয়ে ঘুরে গেলে শূন্যে, বোঝা যায় যুদ্ধ পৌঁছেছে চরমে! যেন ব্রহ্মান্ডও কেঁপে ওঠে তারপর শূন্য থেকে নেমে আসা তাদের স্পর্শ পেলে মাটি। ভাবি, এভাবেই কি আরোপিত হয় দেবত্ব? সহজ-সরল মানুষগুলোর ভিতর থেকে আদ্যন্ত শিল্পী প্রকৃতিটা বেরিয়ে এলেই কি ঈশ্বর স্বয়ং এসে বসেন তাদের পাশে? কোন মেঘ কখন যে ডানা পাঠায়, তার খোঁজ করতে করতেই এরমধ্যে হঠাৎ রাতের দিকে মঞ্জুরের ফোন। দশটা পেরিয়ে গেছে। ওই সময় এখানকার কারোর থেকে ফোন পাওয়া একটু আশ্চর্যই বটে! ফোন ধরতেই চিরাচরিত মঞ্জুর, “কী হে, রাতে আইসব্যে নাকি?” কোথায় আসবো? আমাদের দামোদরপুর। বিশাল ছো-লাচ পালা হে আজ। সারা রাতভর। আসবে বলো তো যায়ে নিয়ে আসব। আরে, যাব না মানে? কখন থেকে শুরু? বারোটা। আমি সাড়ে এগারোটা নাগাদ য...

অভিমানভূম।। (পুরুলিয়ার ধুলো মাটি নদী আর মানুষদের গল্প-কথা-মিথ)।। শুভদীপ চক্রবর্ত্তী।। সুপ্রকাশ।।

Image
কিন্তু আরও একটু গভীরে যেতে হবে। গভীরে যাওয়া মানে, পৌঁছাতে চাওয়া উৎসবের দর্শনটার কাছাকাছি। খোঁজ পাওয়া গেল ‘মিলন আখড়া’র। যেতে হবে প্রায় পনেরো কিলোমিটার দূরের গ্রামে। গ্রামের নাম, জামবাদ। ‘মিলন আখড়া’র প্রাণপুরুষ প্রৌঢ় সৃষ্টিধর মাহাতো। মানভূমের প্রাচীন ঐতিহ্যগুলো প্রাণপণে ধরে রাখতে চাইছেন তারা। সৃষ্টিধর বাবুকে একজন স্কলার বললেও, কমই বলা হয় বরং একটু। শাল গাছ দিয়ে ঘেরা জংলা মতো একটা জায়গায় বসে কতক্ষণ যে কথা হয়েই চলে, হিসেব থাকে না কোনও। মাঝে একবার রেকর্ডারের ব্যাটারিও বদলাতে হলে, সেই সুযোগে ঢলতে শুরু করা বিকেলের আলোর দিকে তাকান বয়স্ক মানুষটা। শালগাছে ঘেরা একটা জায়গা। আচমকা অন্যমনস্কতা পেয়ে বসে। ছড়া কাটতে শুরু করেন তিনি। ছড়া কেটে কেটে বুঝিয়ে দিতে থাকেন, সত্ত্বঃ তমঃ আর রজঃ গুণের সামঞ্জস্য। বুঝিয়ে দিতে থাকেন ‘মাঝের পথ’ ধরে চলা আসলে ঠিক কতটা গুরুত্বপূর্ণ। ‘এক সড়পে দু সড়পে তিন সড়পে লোক চলে / আমার টুসু মাঝে চলে, বিন বাতাসে গা দোলে’। এতই সূক্ষ্ম, নমনীয় দেবীর চরিত্র! জিজ্ঞেস করি আবার, এখানকার সব উৎসব বা পরবই তো ধানকাটার সময় মেনেই হয়। এটাও সেরকম কোনও কারণে কি? উত্তর দিলেন কেটে কেটে। “মকরের দিনে টুসুর...

অভিমানভূম।। (পুরুলিয়ার ধুলো মাটি নদী আর মানুষদের গল্প-কথা-মিথ)।। শুভদীপ চক্রবর্ত্তী।। সুপ্রকাশ।।

Image
রাস্তাঘাটে বেজায় ভিড়। এখানে সবার গন্তব্যই কাঁসাই নদী। মেয়েদের হাতে রংবেরঙের চৌডল। সঙ্গে একেক দলের একেক রকম গান। পাহাড়ি পথে, জঙ্গলের ভিতর দিয়ে পায়ে চলা সরু পথে কিংবা পাথরের মাথায় পা ফেলে চলার সময়ও গান থামছে না তাদের। এই সব গানের পিছনে পিছনেই আমরাও পৌঁছে যাই কাঁসাইয়ের ধার। যেদিকে চোখ যায় শুধু মানুষ আর মানুষ। মুখে মুখে ঝুমুরের গান। আর উদ্দাম নাচ সেই লোকগানের সঙ্গে সঙ্গে। অথচ ঈশ্বরের মূর্তি নেই কোনও। কোনও প্যান্ডেল নেই, কাঠামো নেই। চূড়ান্ত বাহুল্য বর্জিত, অথচ শরীর-মনে উদযাপন করে নেওয়া একটা উৎসব। পথ চলতে চলতে কিংবা অবিরাম নাচের ক্লান্তি পেয়ে বসলে কখনও, তারা বসে পড়ছে বালির উপর। সেই বালির উপর বসেই চলছে একে-অন্যের সঙ্গে ভাগাভাগি করে খাওয়া-দাওয়া। পিঠে এই উৎসবের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ। নতুন ধানের চাল থেকে তৈরি হওয়া নানারকম পিঠে একে অন্যের সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছে এই সমস্ত মানুষ। তার সাক্ষী থেকে যাচ্ছে একটা নদীর উপত্যকা। নদীর ভাল নাম, কংসাবতী। ‘গড়গড়্যা’ বা ‘আসকা’ পিঠের আস্কারা এড়িয়ে চলে এইদিন, এত সাধ্যি কার! পা ধরে এলে, বসে পড়ি খানিক আমিও। বসে পড়লে উঠতে ইচ্ছে করে না হঠাৎ। দেখে যাই চৌডল নিয়ে...

অভিমানভূম।। (পুরুলিয়ার ধুলো মাটি নদী আর মানুষদের গল্প-কথা-মিথ)।। শুভদীপ চক্রবর্ত্তী।। সুপ্রকাশ।।

Image
মানভূমের প্রকৃতি কোনও যুক্তিই খাড়া করতে দেয় না আবেগের উপরে। তাই পন্ডিতরা যতই বলুন না কেন, মাঠের ধান ঘরে উঠলে কৃষি-নির্ভর পরিবারগুলোতে সমৃদ্ধির পরব ‘টুসু’ পালিত হয়, তবু এটা আসলে একদমই প্রান্তিক মেয়েদেরই উৎসব। তাই যেন তাদের টুসু গানে ধরা পড়ে যায় তাদের ভীষণ নিজস্ব সুখ-দুঃখের সাতকাহন। অনেকের মতে, টুসু আসলে মা লক্ষ্মীর লৌকিক রূপ, অর্থাৎ দেবী হলেও তিনি যেন একান্তই ঘরের মেয়ে, যার উপর রাগ করা যায়, চোখের কোল ঝাপসা করে অভিমান করা যায় মন ভরে। ঘরের মেয়ে, তাই তাঁর আরাধনায় আড়ম্বর নেই, বরং আন্তরিকতা আছে। আছে মেয়েদের গায়ে-হলুদের সময় সখীদের খুনসুটিতে এ-ওর গায়ে ঢলে পড়ার মতো সোহাগ। সৃষ্টিধর বাবুর কথাতেই উঠে আসে অমোঘ উচ্চারণ একটা, “টুসুর কোনও জাত নেই, কোনও ধর্ম নেই, কোনও বর্ণ নেই, কোনও মন্ত্র নেই। সবাই টুসু মায়ের পুজো করতে পারে। টুসু গান গাইতে পারে। আর এই গানেই হল টুসুর আসল মন্ত্র।” শুনতে শুনতে আশ্চর্য লাগে, একদিকে যখন এত হানাহানি কাটাকাটি কিংবা হেঁশেলে উঁকি দিয়ে দেখা কী ফুটছে উনুনে, সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে প্রান্তিক এই উৎসবগুলো ঠিক কতটা আধুনিক হয়েই শুরু করেছে সেই কোন প্রাচীন কাল থেকে তার পথচলা। অথচ তবু আমাদে...

অভিমানভূম।। (পুরুলিয়ার ধুলো মাটি নদী আর মানুষদের গল্প-কথা-মিথ)।। শুভদীপ চক্রবর্ত্তী।। সুপ্রকাশ।।

Image
মনে পড়ে, ‘ধর্ম’ অর্থাৎ ‘যা ধারণ করে’— বাড়ি ফেরার শেষ লোকাল ট্রেনের দরজায় দাঁড়িয়ে কপাল থেকে এলোমেলো চুল সরাতে সরাতে কথাটা বলেছিল একজন। পুঞ্চা বাজারে যাওয়া মানেই, চরণপাহাড়ি কালীমন্দির থেকেও ঘুরে আসা একবার। পুঞ্চা থেকে মানবাজার যেতে ডানদিকের একটা রাস্তা দিয়ে ঢুকে গেলেই, চরণপাহাড়ি কালীমন্দির। তার থেকে খানিকটা এগিয়ে গেলেই পুঞ্চা ব্লক হসপিটাল। মন্দিরটা একটা উঁচু টিলা মতো জায়গার উপরে। বেশ কয়েকটা সিঁড়ি পার হয়ে উপরে ওঠার পর মন্দিরের চাতাল। স্নিগ্ধ রূপের মা কালীর মূর্তি মন্দিরের মধ্যে। পাশেই আর একটা আলাদা মন্দিরে স্থাপিত শিবলিঙ্গ। সন্ধেবেলা শাঁখ, কাঁসর, ঘন্টা আর মন্ত্রপাঠের শব্দে জমজমাট মন্দির চত্বর। পুজো হয়ে গেলে, মাথা বাড়িয়ে নিয়ে নেওয়া শান্তির জল। দূরে দাঁড়িয়ে প্রণাম করি আমিও। প্রণাম করতে করতেই দেখি, সহজ-সাধারণ গ্রামের মানুষদের সঙ্গে কথা বলছেন মন্দিরের পুরোহিত ঠাকুর। পরবর্তীকালে দু-একবার গল্পও হয় বয়স্ক ভদ্রলোকের সঙ্গে। কথা বলতে বলতেই খানিকটা ঠাহর করা যায় বয়স্ক মানুষটার ভিতরে জেগে থাকা আধুনিক মনটার। একবার জিজ্ঞেসও করে ফেলি, মেয়েদের আঠেরো আর ছেলেদের একুশ বছরের নিচে তো বিয়ে আইনত ...

অভিমানভূম।। (পুরুলিয়ার ধুলো মাটি নদী আর মানুষদের গল্প-কথা-মিথ)।। শুভদীপ চক্রবর্ত্তী।। সুপ্রকাশ।।

Image
এক ঘন্টা কেন, সেরকম মন না থাকলে তো সারা জীবনেও জেনে ওঠা যায় না পাশের মানুষটাকে। আর এতো জলজ্যান্ত ইতিহাসের কথা! তবে এটা দেখেও আশ্চর্য লাগে যে, এখানকার মানুষদের গা লাগোয়া হয়েই এমন ঐতিহ্যময় ইতিহাস ছড়িয়ে থাকতেও আশেপাশের প্রায় সকলেই কী অসম্ভব নির্লিপ্ত! প্রথম প্রথম ব্যাপারটা দেখে একটু চোখে লাগলেও, পরে সামান্য হলেও হয়তো ধারণা করা যায় আদত বাস্তবতাটুকু। বুঝতে পারি যে, তাদের চারপাশের সঙ্গেই এত বেশি মিলেমিশে গেছে এই সবকিছু, আলাদা করে এর কারণ বা ঐতিহ্য খোঁজার প্রয়োজন হয়নি তাই হয়তো এদের আর। দু’বেলা দু’মুঠো অন্ন জোগাড় করে তারপর ঢোল সহরতে কেটে গেছে দিন-গুজরান। এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্ম। এসব এদের বাড়ির সহজাত উঠোনের মতোই তাই। বাড়ির লোককে অতিথিদের মতো আদরযত্ন করাটাই তো বরং চোখে লাগার ব্যাপার! কোনও উপলক্ষ ছাড়া এর আগে বুধপুরে যাওয়ার সময় হয়নি সেইভাবে। উৎসবের সময় এত বেশি ভিড় থাকে যে, সেইসময় ভগবান হোক অথবা প্রাচীন ঐতিহ্য— কারোর কাছেই ঠিকঠাক পৌঁছানো যায় বলে মনে হয় না। বেশ চড়া রোদের একটা বিকেলে তাই প্রায় প্রথম দেখার মতোই পৌঁছে যাই বুধপুর। খুব বেশিক্ষণের রাস্তা নয়। কিন্তু, প্রাচীন মন্দিরের ক...

অভিমানভূম।। (পুরুলিয়ার ধুলো মাটি নদী আর মানুষদের গল্প-কথা-মিথ)।। শুভদীপ চক্রবর্ত্তী।। সুপ্রকাশ।।

Image
বেলাও যে ভ্যানিশ হয়ে আসছে! গরম হাওয়াটা মরে গিয়ে কেমন একটা হালকা মিঠে গন্ধ ভেসে আসছে রাস্তা পেরিয়ে ওপাশের জঙ্গলটা থেকে। রাত বাড়তে থাকলে নাকি এই গন্ধও বাড়তে থাকবে। নেশা এমনই গন্ধের, সাপখোপও এসে নাকি নাক ঘষে যায় মাঝেমধ্যে খানিক! জঙ্গলের লাগোয়া বাড়ির উঠোনে খলখল হাসির আওয়াজ। লাল প্লাস্টিকের ফুটবলটায় লাথি মেরেই তার পিছনে দৌড়োচ্ছে নিচু চালের বাড়িটার ঝুঁটি বাঁধা বাচ্চা দুটো। চায়ের দোকানে বেশ জমজমাট ভিড়। আর পেটের ভিতর, মাথার উপর মানুষ ভরে নিয়ে বাসটা ধুলো উড়িয়ে চলে যেতেই, অঞ্জনদার দেখা পাওয়া গেল অবশেষে। অনেক দেরি হয়ে গেছে। পাকবিড়রা যাব! এ এক অদ্ভুত সমাপতন। ধর্ম ধর্ম করে এতকিছু হচ্ছে চারপাশে। হয়েই চলেছে কত কত যুগ ধরে। অথচ এখানে যেন সেই সবকিছু অন্য কোনও পৃথিবীর ঘটনা। শুনেছিলাম, মানভূমে একসময় জৈন ধর্মের প্রভাব ছিল ব্যাপক। তাই বর্তমান পুরুলিয়া জেলার বেশ কিছু জায়গায় নিদর্শন ছড়িয়ে আছে তার। পাকবিড়রাও সেরকম একটা গ্রাম। কাঁকড় মাখা লাল মাটির পথে ধুলো উড়িয়ে চলেছে বাইক। বেশ কয়েক কিলোমিটারের রাস্তা। পাকবিড়রা গ্রাম থেকে পুঞ্চা ব্লক বা বাজার অবধি এই এতটা দূরত্ব প্রায় দিনই পায়ে হেঁটেই যাতায়াত করেন বেশ কিছু মানু...

অভিমানভূম।। (পুরুলিয়ার ধুলো মাটি নদী আর মানুষদের গল্প-কথা-মিথ)।। শুভদীপ চক্রবর্ত্তী।। সুপ্রকাশ।।

Image
তারাই তোমার পিছুটান। তারাই তোমার পালানোর কারণ! তবু কোথাও গেঁথে যাওয়ার পর, সহজ কি পালানো সেখান থেকে আদৌ? অথচ এই লড়াই নিজের সঙ্গে নিজের। হার নিশ্চিত জেনেও, আদতে শেষ নেই কোনও লাগাতার ক্লান্তির এই। লক্ষ্য তবু, অবিরাম রক্তক্ষরণ নিয়েও দৌড়ে ঢুকে যাওয়া একটা জঙ্গলে। পিঠে গেঁথে যাওয়া তীর নিয়েও যে জঙ্গলের ভিতর ঢুকে গেলেই, সারিয়ে তুলবেন বনদেবী! জখম যতই গভীর হোক না কেন, হইহই করে ছুটবে আবার প্রাণ! পারডি লেকের ধারে বসে বুড়ো সনাতন মুর্মু শোনান অবিশ্বাস্য এই গল্প। শোনান শিকার পরবের দিন কত কত শিকারের নতুন করে জীবন খুঁজে পাওয়ার কাহিনী এইভাবে। তবু শহর বদলে গেলে, মনখারাপ সঙ্গী হয় শুধু। মাঝ আকাশে চোখ বুজলেও, সেই গেঁয়ো মেঠো ধুলো ভেসে আসে, যেখানে ভালবাসা ফেলে আসি ভুলে। যেখানে আমার ফেরা হয় না আর। সেও কি আমায় ডাকে সেইভাবে? অগত্যা সেই রাত জাগা সব কাজের ভিড়ে, কখন যেন হেসে ওঠে আয়না। সেই একই প্রশ্ন। এক, এক, এক! কী এমন মন তোমার? কী এমন কাজ, যা তোমায় সত্যিই মনখারাপের সময়ও দেয় না? কে যে কী দেয়! আমরাই বা ফিরিয়ে দিই কি কিছুই? পারি কি দিতে? অবিচল এক সত্যি-মিথ্যের ঘেরাটোপে পড়ে গেলেই তাই, ওই রাঙা মাটির বুকে ফুটে থাকা বা ঝর...

অভিমানভূম।। (পুরুলিয়ার ধুলো মাটি নদী আর মানুষদের গল্প-কথা-মিথ)।। শুভদীপ চক্রবর্ত্তী।। সুপ্রকাশ।।

Image
এই টুকরো টুকরো মুহূর্তের হাত ধরে ছেলেবেলায় ফিরে যেতে ইচ্ছা করে খুব। কয়েক মুহূর্ত বসে থাকতে ইচ্ছা করে নিজের শৈশবের পাশে। মনে পড়ে বুড়ির ঘর। কাল আমাদের দোল। পোড়া আলুর রসনা। একটু বেশি টক আর ঝালে আওয়াজ ওঠে টাকরায়। আর মনে আসে প্রিয় গান, ‘মন সে রাবণ যো নিকালে, রাম উসকে মন মে হ্যায়’... অক্টোবর পার করে সেদিন পুরুলিয়াতে এসে নামা হয় আবার ‘একদিন কার্তিকের নীল কুয়াশায়/যখন ঝরিছে ধান বাংলার ক্ষেতে-ক্ষেতে ম্লান চোখ বুজে’। এবার আর মলয়দাকে ডাকা হয়নি গাড়ি নিয়ে আসার জন্য। তবু পুরুলিয়া স্টেশনে নেমে ভোরের বাসে পঞ্চান্ন কিলোমিটার দূরের গ্রামে পৌঁছাতে পৌঁছাতে, ঠান্ডা হাওয়াটা বশে নিয়ে নেয় মাথা-কপাল সবটাই। কমিউনিটি রেডিয়ো স্টেশন থেকে ফেরার পথে মাথা-ব্যথার অ্যান্টিডোট নিতে দাঁড়াতেই হয় চায়ের দোকানে। হঠাৎ কোথা থেকে ইমন এসে হাজির। এমনই মাথা ধরেছে, দশ-বারো মিনিটের হাঁটা পথই যেন দশ-বারো মাইল। ফেরেস্তা ইমনের বাইকে উঠে পড়া গেল। বললাম, “আগে একটু বাজারের দিকে চলো তো। কয়েকটা ওষুধ নেওয়ার আছে...” বাজার যাওয়ার পথে দু’পাশে ছোট ছোট চাষ জমি, নিচু পুকুর, ছোট ছোট ঘর-বাড়ি। মাটির দেওয়াল। খোলা মাঠের মধ্যে বাৎসরিক যাত্রাপ...

অভিমানভূম।। (পুরুলিয়ার ধুলো মাটি নদী আর মানুষদের গল্প-কথা-মিথ)।। শুভদীপ চক্রবর্ত্তী।। সুপ্রকাশ।।

Image
বাইরে বেরোতেই সে এক আশ্চর্য দৃশ্য! ঠান্ডা বেশ। অন্ধকারও। কিন্তু তার মধ্যেই পিলপিল করছে লোক রাস্তায়। দূরের দূরের গ্রাম থেকে গাড়ি ভাড়া করে আসছে লোকজন। যাওয়ার পথে দেখি মুসলিম ওসির হাতে তৈরি চরণপাহাড়ি কালীমন্দিরে থিকথিকে ভিড়। রাস্তায় মাঝে মাঝেই হ্যালোজেনের বাতি। তার মাঝের রাস্তায় আন্ধার! সেইসব আঁধার রহস্যময় করে আরও ঝকমকে জামাকাপড় পরে খিলখিল করতে করতে চলেছে বয়সে একটু বড় মেয়েদের দল। বুধপুরের মোড়ে পৌঁছোতেই ভিড় বেড়ে যায় আচমকা অনেকটাই। সবাই চলেছে নদীর দিকে। নদীর পাড়ের বালিতে নানা রকম জিনিসের পসরা। ছোটখাট মেলা বসে গেছে যেন। পাথুরে নদীর বুকে কাতারে কাতারে লোক। দেশি নেশার গন্ধ। টলোমলো করে এগিয়ে আসছে অন্যের কাঁধে ভর দিয়ে কেউ কেউ। নদীর বুকে বিশাল একটা মূর্তি দাঁড় করানো। তা রাবণ পোড়াই দেখতে যখন এসেছি, তখন ওইটা রাবণই, মেনে নিতে অসুবিধা কোথায়? মজাই লাগে বেশ। এখানে যদিও রাবণের মাথা দশটাই রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু ব্যাপারটা ঠিক হবে কী? ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ একটা শোরগোল। দেখি হাতে একটা তীরের মাথায় আগুন নিয়ে ছুঁড়ে মারে কেউ রাবণের দিকে। তারপর কেউ কখনও নিচ থেকে রংমশাল ছুড়ছে। কেউ বা আবার অন্য কোনও ভাবে আগুন...

অভিমানভূম।। (পুরুলিয়ার ধুলো মাটি নদী আর মানুষদের গল্প-কথা-মিথ)।। শুভদীপ চক্রবর্ত্তী।। সুপ্রকাশ।।

Image
ফ্রেম আউট হয়ে যাওয়ার সময় চলে আসে নিজেরও কখন যেন। তার আগেই বোধহয় তাই বসন্ত রাঙা হয়ে ওঠে এত ভীষণ! বরাবরের মতোই বিলিয়ে দেয় মানভূম তার সর্বস্ব এই একটা ঈশ্বরের মতো সুন্দর ঋতুতে। মিলিয়ে দেয় কত কত ভীষণ অদ্ভুত মানুষ! এবং ইউনিসেফের ডকুমেন্টারির কাজে কলকাতা থেকে আচমকাই এসে পড়ে কেউ। মেয়েদের নিয়ে ছবি হবে। ঝরে থাকা পলাশের উপর জেগে উঠবে হাতে হাত ধরে সাঁওতালি পাতা নাচ। এতদিন থাকার সুবাদেই বোধহয়, চেনা বিকেলে জুটে যায় গাইডের কাজ। চিনিয়ে দিই তাকে অচেনা আদিম ব্যাসল্ট, দূরের ছু-মন্তরে মিশে যাওয়া রাস্তা, পলাশের কুঁড়ি গাছে গাছে। “আপনি থাকতে থাকতেই ভরে যাবে পলাশে সব—” পলাশ সাজতেই থাকে। শুধু আমি নিজেই আবার ছিটকে যাই কোথাও। তেলঙ্গানার ডেকান ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি ছুঁয়ে আদিবাসী অধ্যুষিত মেডক জেলার ভিতরের দিকে পাহাড়ের গায়ে অচেনা কোনও রোদ্দুরে। সেখান থেকে ফিরে আসতে আসতে, পলাশ ঝরানো বৃষ্টি আবার খুব। হাঁচোড়পাঁচোড় করে ধরিয়ে দেওয়া কাউকে শহরে ফেরার ট্রেন। ফিরতে ফিরতে গাড়ির কাচে জল, আর ছোট্ট একটা টেক্সটের বেজে ওঠা মোবাইলে, “কলকাতা ফিরলে দেখা হবে?” দেখা হবে কিনা কে জানে! যন্ত্রণায় ফেটে আসা মাথা সামলে বেরিয়ে পড়া আবার দূরের ...

অভিমানভূম।। (পুরুলিয়ার ধুলো মাটি নদী আর মানুষদের গল্প-কথা-মিথ)।। শুভদীপ চক্রবর্ত্তী।। সুপ্রকাশ।।

Image
“শ্রীমন্তিদি, সেরেঞ হুই কানা?” গান গাইবে একটা, শ্রীমন্তিদি? বাণিজ্যিক নিউজ মিডিয়ার দেওয়া তথ্য অন্য সত্যের কথা বললেও, শ্রীমন্তিদি, শ্রীমন্তি হেমব্রম, এই বাংলার প্রথম মহিলা আদিবাসী রেডিয়ো সঞ্চালক, মানে আর.জে, হেসে ওঠে অমলিন। তাও একটু ভিড়ের থেকে আলাদা হওয়া দরকার। গান শেষ। জুতো পরে বাইরে বেরোতে দেখেই, আকাশ কিছু বলতে আসছে। হাত নেড়ে এখন নয় বলেই হেঁটে যাচ্ছি মাঠের দিকে তারপর। পদ্ম-শালুক ফুটে থাকা পুকুরটার পাশ দিয়ে হাঁটছি। ঝাঁকড়া দুটো আমগাছ যেখানে মাথা ঘসছে, তার নিচ দিয়ে হাঁটছি। বোল ধরে গেছে গাছে। নেশা নেশা গন্ধ। আর সেটা পেরিয়ে গেলেই পাথর খোদানো চেহারাগুলো ফুটবল পেটাচ্ছে দিগন্তহীন মাঠটায়। মাঠের আগে থেকে ডান দিক নিয়ে নিই। আরেকটা পুকুরের পাশ দিয়ে একটু হেঁটে গেলেই সেই জঙ্গলটা! আহা, উপরে-নিচে ফুটে থাকা, ঝরে পড়া লালের সঙ্গে মিশে গেছে নির্বিকার খয়েরি রুক্ষতা। ওই অপার্থিব সৌন্দর্যে ঢুকি না। বরং খানিকটা পা চালিয়ে এগিয়ে যাই মাঠের ধারের দিকে। মাঠটা শেষ যেখানে, সেখান থেকে নিচের দিকে খাড়াই একটা ঢাল। ঢালটা শেষ হতেই, ছড়িয়ে থাকা ধান ক্ষেত। ফসল কাটা হয়ে গেছে সব। ফ্যাকাশে খড়ের গোড়া ছড়িয়ে সারা মাঠ জুড়ে। এবার বর...

অভিমানভূম।। (পুরুলিয়ার ধুলো মাটি নদী আর মানুষদের গল্প-কথা-মিথ)।। শুভদীপ চক্রবর্ত্তী।। সুপ্রকাশ।।

Image
অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে শহর কলকাতায় হেমন্ত দূরঅস্ত্ হলেও, পুরুলিয়াতে ভোরের বেলা তো বটেই, এমনকি সন্ধে পার হলেই শিরশিরানি হাওয়াটা টের পাওয়া যায় বেশ। গ্রামের ভিতরের দিকে আরও একটু বেশি সেই শিরশির। তারই মধ্যে ঘোরাঘুরি চলছে। চলছে শেখাও। মোটামুটি ভাবে পাঁচ দিনের উৎসব সহরায়। আদিবাসী সম্প্রদায়ের অন্যান্য উৎসবের মতোই সহরায়ও একটা আদ্যন্ত কৃষি উৎসব। তার সঙ্গে এখানে পুজো করা হয় গৃহপালিত বা চাষের কাজে সাহায্য করে যে পশুরা, তাদেরও। প্রচলিত ধারণায় কার্তিক মাসের অমাবস্যার পরের দিন থেকে থেকে শুরু হয় ‘হাতি লেকান সহরায়’; অর্থাৎ হাতির মতো বড় উৎসব সহরায়। নতুন ফসল ঘরে উঠে এসেছে ঘরে। পরবর্তী কৃষি মরশুম শুরু হওয়ার প্রস্তুতি পর্বের আগেই তাই এই উদযাপন। যদিও এখানেও দেখা মেলে সনাতন গ্রামীন সমাজের তীব্র একাত্মতার। সব গ্রামে একই দিনে শুরু নাও হতে পারে সহরায় পরব। নির্ধারিত সময়ের প্রায় একমাস আগে গ্রামের সকল পুরুষেরা গ্রাম-প্রধান বা ‘মাঝি’র নেতৃত্বে একত্রিত হয়ে ঠিক করেন পরব শুরুর দিনক্ষণ। গ্রামের একটা পরিবারও যাতে উৎসবের আলো থেকে বাদ না পড়ে, তার জন্যই এই ব্যবস্থা। সাঁওতালি ভাষা ও সংস্কৃতির উপর নিরলস ভাবে কাজ করেছেন, সে...

অভিমানভূম।। (পুরুলিয়ার ধুলো মাটি নদী আর মানুষদের গল্প-কথা-মিথ)।। শুভদীপ চক্রবর্ত্তী।। সুপ্রকাশ।।

Image
এখানকার প্রায় সমস্ত গ্রামেই দেখি সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো গোল মঞ্চের মতো একটা জায়গা। উপরে পাকা ছাউনি, চারপাশ খোলা। নিচের মঞ্চের সঙ্গে উপরের ছাদ জুড়ে আছে লম্বা লম্বা কিছু পিলারের সংযোগে। পিলারের মধ্যে ঝুলছে কোথাও কোথাও মাদল, ধামসা। এগুলোই হরিমণ্ডপ। শ্রীচৈতন্যের কৃষ্ণপ্রেমের জোয়ার কিছু কম এসে পড়েনি এই মানভূমেও। সেখানেই দেখা হয় আদিবাসী সমাজেরই একজন পুরোহিতের সঙ্গে। এই সমাজের ভাষায়, সেই উপাসকদের বলা হয় ‘লায়া’। যদিও সে বছর কোনও কারণে অসুস্থ থাকায়, করম পুজোর কোনও কাজ করতে অপারগ তিনি। রোদ-বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচতে তাই বসে থাকা অগত্যা গ্রামের মাঝের ওই মঞ্চেই। বিকেলের আগে আগে তাপ তখন কমে এসেছে অনেকটাই। আলোও কেমন মনমরা। সেরকম একটা বিকেলেই গল্প জমে ওঠে লালচে মেঝের উপরে বসে। আদিম জনগোষ্ঠীর এই পরবের খুঁটিনাটি জানতে জানতে, অবাক হই আবারও। কারণ, সেই একাধিক লোককথা আর তার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা ক্ষেত-মাটি-অরণ্যের গান। পরে কয়েকটা বইপত্র ঘেঁটে করম পরবের যা রেফারেন্স পাওয়া গেছে, সেখানে ওই বয়স্ক ভদ্রলোকের বলা গল্পের হুবহু একরকম গল্প না পেলেও, মূল বক্তব্য ছিল প্রায় একই। যদিও গবেষণা তো উদ্দেশ্য নয় ক...

অভিমানভূম।। (পুরুলিয়ার ধুলো মাটি নদী আর মানুষদের গল্প-কথা-মিথ)।। শুভদীপ চক্রবর্ত্তী।। সুপ্রকাশ।।

Image
‘ভাদর মাসে করম পরব মুদের ঘরে ঘরে’ প্রচলিত বিশ্বাস, এই বিশেষ তিথিতে ভগবান বিষ্ণু অনন্ত শয্যায় পাশ ফিরে তাকিয়েছিলেন এই পৃথিবীর দিকে। যেদিকে দৃষ্টি পড়েছিল ভগবানের, পৃথিবীর সেই অংশ হয়ে উঠেছিল সুজলা-সুফলা। এদিকে এক নিঃসন্তান রাজা সন্তান কামনায় পুজো করেছিলেন করম দেবতার। সেই রাজার দুই সন্তান হয়— কর্মু আর ধর্মু। পরে এই রাজপুত্র কর্মুই উঠেপড়ে লাগেন এই করম পুজো চালু করতে তাঁদের সম্প্রদায়ের মধ্যে। আদিম কোনও এক পুণ্য লগ্নে মাহাতো কুড়মি সম্প্রদায়ের মধ্যে সেই থেকেই প্রচলন হয় করম পুজোর। করম পরবের প্রচলিত ক্রিয়াকর্মের দিকে চোখ ফেরালে, সেখানেও পুজো আর ভক্তির সঙ্গে সহজ সারল্য একরাশ। অবশ্য এক্ষেত্রে স্থান বিশেষে প্রথা কিছু আলাদা হতেই পারে বলে ধারণা। ঘুরে-ফিরে যেটুকু জানা গেল, প্রতিবছর ভাদ্র মাসের শুক্লা একাদশী তিথিতে হয়ে থাকে এই করম পরব। করম পুজোর সঙ্গেই জড়িয়ে আছে প্রান্তিক মানুষদের আরও একটা পরব, ‘জাওয়া’। এটাও একেবারেই আরাধ্যা প্রজজন দেবীকে তুষ্ট করার পুজো। জাওয়া পরবের কয়েকদিন আগে থেকে একটা বেতের টুপা বা চুবড়িতে বালি ভরে, তার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হয় ডাল-মুগ-বুটা প্রভৃতি শস্যের বীজ। রোদে-জলে কয়েকদিনের মধ্য...

অভিমানভূম।। (পুরুলিয়ার ধুলো মাটি নদী আর মানুষদের গল্প-কথা-মিথ)।। শুভদীপ চক্রবর্ত্তী।। সুপ্রকাশ।।

Image
প্রথম যাত্রায় হাওড়া থেকে রাতের ট্রেনে সাইড লোয়ার বার্থ। এই বার্থটাই সব থেকে প্রিয়ও বটে। রাতের বেলা তেমন কিছুই বোঝা না গেলেও, খড়গপুর পেরিয়ে যাওয়ার পরেই কনকনে হাওয়া আসতে থাকে একটা জানালা দিয়ে। কাচ ফেলে দিতে হয় অগত্যা। তাকিয়ে থাকি রাতের অন্ধকার আর তার মাঝে মাঝে জ্বলে ওঠা সাদাকালো জোনাকির মতো দূরের আলোগুলোর দিকে। যেন এগিয়ে চলা সবকিছু ছেড়ে। ভেসে যাওয়া অন্ধকারের হাওয়ায়। গরীব তথা বেকার ছেলের মনখারাপের বাতিক থাকতে আছে কিনা জানা নেই। কিন্তু, মনখারাপ হচ্ছে। ট্রেনের ধকধক শব্দে মনে হচ্ছে পিছনে ফেলে দিচ্ছি এতদিনের মনে পড়া মুখ, মুখের উপর উঠে পড়া চুল, অটোয় পাশে বসে আঙুলের ভিতর ধরে থাকা আঙুল আর কোনোদিন ছেড়ে না যাওয়ার মতো শপথ। মিথ্যে। গায়ে লাগছে না কোনও কিছুই খুব একটা আর। শুধু মনে হচ্ছে, কোনোদিন আর ফিরে না গেলেই তো হয়! কী হয়, সাদা-কালো মিথ্যে কথার শহরে কখনোই যদি ফিরে না যাই আর? তার থেকে তো এই ভেসে পড়াই ভাল। নতুন গন্তব্য ভাল। নতুন দেখা ভাল। কখন যে চোখটা লেগে গেছে, বোঝা যায়নি। যখন ঘুম ভাঙল, ঘড়ির কাঁটা পেরিয়ে গেছে ছয়ের ঘর। পুরুলিয়া স্টেশনে ট্রেন থামবে সাতটা নাগাদ। আরও মিনিট চল্লিশ বা পঁয়...

অভিমানভূম।। (পুরুলিয়ার ধুলো মাটি নদী আর মানুষদের গল্প-কথা-মিথ)।। শুভদীপ চক্রবর্ত্তী।। সুপ্রকাশ।।

Image
বারবার আশ্চর্য হই। একটা ছোট্ট অঞ্চলেই এত রকম লোককথা, উপকথা বা মিথ ছড়িয়ে আছে বাতাসে, এই পুরো মানভূম অঞ্চলটাতে তাহলে কত কত গল্প থাকতে পারে এরকম! অঞ্জনদা বলে, এই মন্দির চত্বরে নাকি বড় কয়েকটা সাপ ঘোরাফেরা করে। শুনেই লাফিয়ে উঠে পড়ি। এই একটা জিনিসে মারাত্মক ভয়! অঞ্জনদা অভয় দেয়, ভয় পাওয়ার কিছু নেই; ওরাই নাকি পাহারা দেয় এই আশ্রম। তবুও! অন্য কিছুতে ভয় না থাকলেও, বিশেষ এই একটা জিনিসে ঝুঁকি নিতে পারি না। উঠেই যখন পড়েছি একবার, বসা হয় না আর। তিনজনে বেরিয়ে আসি নিঝুম আশ্রম পিছনে ফেলে। সন্ধে নামছে বাঁশপাতা হাওয়ায়। দূরে শাঁখ বেজে ওঠে গ্রামের গৃহস্থবাড়িতে কোনও। কেন কী জানি, আনমনেই কপালে উঠে আসে হাত। জংলা রাস্তায় শুকনো পাতার উপর দিয়ে চলার পথ। অঞ্জনদার হাতে টর্চ। জ্বালার প্রয়োজন হয় না যদিও। সারাটা দিনের পর, বেশ লাগে এই আধো-অন্ধকার। আলোহীন ছায়াহীন গল্পেরা আসে আর সরে যায় মাথার মধ্যে। ভাবি, এই পুরো হেঁটে চলাটা যদি খুব হাল্কা প্যানে ধরা যায়… ওয়াইড লং শট… তিনটে ছায়া ফেড আউট হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ... দূর দূর করে তাড়াতে যাব এসব ভাবনা, আবার শাঁখ বেজে ওঠে কোথাও। আবারও হাত উঠে আসে কপালে। অজান্তেই। আর শালপাতা ...

অভিমানভূম।। (পুরুলিয়ার ধুলো মাটি নদী আর মানুষদের গল্প-কথা-মিথ)।। শুভদীপ চক্রবর্ত্তী।। সুপ্রকাশ।।

Image
এখানকার মূল নদী এই কাঁসাই হলেও, এর উৎপত্তি হয়েছে অনেক দূরে। সম্ভবত ঝালদায়। কিন্তু একদিন এলাকার ‘সোশ্যাল ম্যাপিং’ প্র্যাকটিস করতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম আরও একটা নদী। শিলাই। কিন্তু যেদিকে দেখানো হচ্ছে, সেদিকে নদী তো দেখিনি আর কোনও! তাহলে? সোশ্যাল ম্যাপিং করা হচ্ছিল নিউজপেপার বা রেডিয়ো স্টেশনের বাকি সকলের সঙ্গেই। সোশ্যাল সেক্টরে যারা কাজ করেছেন তাদের সকলের কাছেই ‘সোশ্যাল ম্যাপিং’ খুবই পরিচিত এবং গুরুত্বপূর্ণ একটা শব্দ। একটা বড় কাগজে একটা নির্দিষ্ট এলাকার গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলো পয়েন্ট করতে করতে মোটামুটি ভাবে এলাকার খুঁটিনাটি মাথার মধ্যে ঢুকিয়ে নেওয়া, যে কোনও এলাকা ভিত্তিক পরিকল্পনা করতে যেটার গুরুত্ব অত্যন্ত বেশি। সেই ম্যাপিং করতে গিয়েই আচমকা চমকে যাওয়া আবার একটু। জানা গেল, পুরুলিয়াসহ বাঁকুড়া বা মেদিনীপুরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শিলাই নদী, যার ভাল নাম শিলাবতী, সেই শিলাবতীর উৎস নাকি এই এলাকাতেই। একটা নদীর উৎস, তায় এত সুন্দর একটা নাম— দর্শনের অপেক্ষা কি সওয়া যায়? কবে যাব এটা দেখতে? পুরুলিয়া যাওয়া-আসার পথেই তো পড়ে। দেখোনি? আমি থোড়ি জানতাম! কতদূর এখান থেকে? সেদিন বিকালেই অঞ্জনদার বাইকে সওয়ার হয়ে ...

অভিমানভূম।। (পুরুলিয়ার ধুলো মাটি নদী আর মানুষদের গল্প-কথা-মিথ)।। শুভদীপ চক্রবর্ত্তী।। সুপ্রকাশ।।

Image
ভাবতেই কী আশ্চর্য লাগে, যে দেশে একটা গোটা নির্বাচন ব্যবস্থার সামনের সারিতে রাখা হয় জাতপাত বা ধর্মের ঝনঝনানি, সেখানে দেশের এরকম একটা প্রান্তিক জায়গায় একই দিনে উদযাপিত হয় ‘ভাদু পরব’ আর ‘ছাতা পরব’। দুই ভিন্ন সম্প্রদায়ের হৃদয়ের কাছের দুই উৎসব। একেকটা উৎসব মানেই একেকটা গল্প এখানে। অনেক পরে একদিন বাড়ি ফেরার পথে পুরুলিয়া স্টেশনে ট্রেন ধরতে যাওয়ার সময় দেখেছিলাম বাংলার অন্যতম রঙিন এই স্থানীয় গ্রামীণ উত্সব, ‘ভাদু’। একান্ত ভাবেই গ্রামের মহিলাদের নিজস্ব একটা উৎসব। বাংলা ক্যালেন্ডার ধরে বলতে গেলে, বছরের পঞ্চম মাস, অর্থাৎ ভাদ্র মাসের শেষ দিনে পালন করা হয় এই ভাদু উৎসব। প্রচলিত মত বলে, ‘ভাদু’ হল দেবী ভদ্রাবতীর (বা অন্য আরেকটি উত্স অনুসারে রানী ভদ্রেশ্বরীর) ডাক নাম। মানভূম অঞ্চলে দেবী ভদ্রাবতীর পরিচিতি উর্বরতার দেবী হিসেবে। উর্বরতা, অর্থাৎ জমির ফসল, এবং নারীর সন্তান। গ্রামের মহিলাদের কাছে দেবী ভদ্রাবতী ঘরের আদরের মেয়ের মতোই। তাই সারা মাস আনন্দ করলেও, দেবীকে ভাসানের মুহূর্তে বিষাদ আসতেও দেরি হয় না। দেবীর কাছে চাওয়া তো সামান্যই, আসন্ন মরসুমে যেন ফসল হয় ভাল আর ঘরের দুয়ার থেকে যেন দূরেই থাকে দারিদ্রের কাল...

অভিমানভূম।। (পুরুলিয়ার ধুলো মাটি নদী আর মানুষদের গল্প-কথা-মিথ)।। শুভদীপ চক্রবর্ত্তী।। সুপ্রকাশ।।

Image
এই বিশাল জোয়ার-ভাটা নদী আর তার পলি-কাদার গন্ধ নিয়ে বেড়ে উঠেছে যে, সেই তার কাছে পাথুরে মানভূমের এই রোগাসোগা পাঁজরের হাড় বের করা নদী ভাল লাগতে পারে কি? কিন্তু এতই আশ্চর্য এখানকার নদীদের রং আর রূপ, এমনিতেই বসে পড়তে ইচ্ছা হয় পাথরের গা ঘেঁষে। এদিকে বুকের ভিতর লুকানো ভীষণ ‘চাঁদের পাহাড়’। আনমনা ছেলেটা প্রথম যেদিন নদী দেখতে গেল, পাথুরে উপত্যকা দেখে বলে উঠেছিল, “আরে, এতো আমাদের ভেরি ওন রিখটারসভেল্ড!” নদীর উপরেও সারি সারি পাথর। জলের উপর থাকলেও, পাথরে শ্যাওলা নেই একটুও। পাথরের মধ্যেই সবুজ ঘাসের দল মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে কোথাও কোথাও। তার নিচ দিয়ে কলকল চলে যাচ্ছে জল। মনে হয়, এই অসীম প্রকৃতি থেকেই হয়তো ‘সহাবস্থান’ শব্দটা এভাবে শিরায়-উপশিরায় ঢুকে গেছে এখানকার মানুষজনদের মধ্যে। সরস্বতী পুজোর পরেরদিনের সকাল। তীব্র ডিজে বক্সের তাণ্ডব কাটিয়ে পিঠে ব্যাগপত্র নিয়ে হেঁটে যাচ্ছি কাজের জায়গার দিকে, দেখি রাস্তায় ভিড় অন্যদিনের থেকে অনেকটাই বেশি। ব্যস্ততা খুব আচমকাই। সরস্বতী পুজোর পরের দিন মানভূমের এই অঞ্চলে পালন করা হয়, ‘মাকুরি পরব’। কাঁসাই, মানে যে নদীর ভাল নাম কংসাবতী, তারই পাশের গ্রাম বুধপুরে নাকি এই মেলা হয়ে আস...

অভিমানভূম।। (পুরুলিয়ার ধুলো মাটি নদী আর মানুষদের গল্প-কথা-মিথ)।। শুভদীপ চক্রবর্ত্তী।। সুপ্রকাশ।।

Image
এবারের মতো পুরুলিয়ার কাজ মিটলেও, বাড়িতে ফেরা হবে না জন্মদিনের দিন। পালাবো তাই ওই মাটির বাড়ির লজেই। পরেরদিন মিটিং শেষ হয়ে গেলে, আকাশ বেরিয়ে যায় মানবাজারের দিকে, আর লজ থেকে পাঠানো লজঝড়ে একটা চারচাকা জন্মদিন-বালককে নিয়ে রওনা দেয়, যেখানে তিনদিকে পাহাড় দিয়ে ঘেরা পারডি ড্যাম। সেখানে জঙ্গল ভীষণ। সেখানে লোককথার গুনগুন আর শিকার পরব নিয়ে হাজারটা আশ্চর্য খুব মিথ। সেখানে সারাদিন চুপচাপ খুব আর প্রাচীন বিশাল শিলাদের গায়ে রিনিঝিনি সময়ের। পৌঁছাতে পৌঁছাতে কতবার যে দাঁড়ায় সে! ড্রাইভারকে বিরক্ত করে গাড়ি থেকে নেমে যায় ছাপোষা মফস্বলের ছেলেটা। চুপ করে দাঁড়িয়ে শোনে দু’পাশের জঙ্গলে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। এমন বৃত্তাকার ভাবে ঘুরে ঘুরে ডাকে পাখির দল? এসব আবোল-তাবোল ভাবনার তার ছিঁড়ে তাড়া দেয় ড্রাইভার এবার। আকাশ যেমন মেঘলা, আলো পড়ে আসবে খুব তাড়াতাড়ি। তাড়া দেয় বলেই, সন্ধের আগে গ্রামে পৌঁছে, লজে না ঢুকেই দৌড়ে চলে যায় সে ঝিলের ধারটায়। একটা ঢেউ খেলানো পাহাড়ের ছায়া পড়েছে ঝিলের নীল জলে। পাহাড়ের পিছনদিকের আকাশটাও নীলচে কালো কেমন। নিচে কালো তার ছায়া পড়েছে ঝিলের ওই জলেও। আর ঢেউ খেলানো পাহাড়টার দুটো চূড়ার ঠিক...

খণ্ডপ্রহর।। অবিন সেন।। সুপ্রকাশ।।

Image
শ্রাবণের মাঝামাঝি। তবু বাংলার বুকে বর্ষার আগমনের পদশব্দ শোনা যাচ্ছে না। গত দুই বছর বর্ষণ হয়নি তেমন। শুখা গিয়েছে। ফলে ধানের ফলন হয়নি একেবারে। মানুষ আশঙ্কা করতে শুরু করেছে, ওড়িশার দিক থেকে আকাল এবার বাংলার দিকে সরে আসতে চাইছে। দুই বছরের অনাবৃষ্টিতে সম্পন্ন চাষির ঘরেও ধানের মজুত তলানিতে এসে দাঁড়িয়েছে। গরীব মানুষের অবস্থা তথৈবচ। যারা পারছে ঘরবাড়ি ছেড়ে নগর কলিকাতার দিকে যাত্রা করছে। তাদের ধারণা নগরে বুঝি ঢের সম্পদ, ঢের বৈভব— সেই বৈভবের ছিটেফোঁটা যদি ছিটকে এসে তাদের ক্ষুধার্ত মুখের সামনে পড়ে, তবে তারা বেঁচে যাবে। কিন্তু সে আশা মরুভূমিতে মরূদ্যানের দেখা পাবার মতো। রতিকান্ত বার দুই কলিকাতা ঘুরে এসে দেখেছে মেদিনীপুর, হুগলির গ্রাম থেকে পেটের টানে আসা মানুষদের ঠাঁই হয়েছে নগর কলিকাতার এঁদো অলিতে-গলিতে। কলিকাতা তাদের গ্রহণ করেনি। এহেন এক অনিশ্চয়তার মধ্যেও রতিকান্ত ভাবে তাকে কলিকাতা যেতে হবে। চাঁদ বণিকের মতো তাকে একদিন ভিনদেশি হয়েও কলিকাতা বন্দরে পদার্পণ করতে হবে। সপ্তগ্রাম বন্দরে গঙ্গার জলের কিনারায় বসে ক্রমশ ঘনায়মান অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে সে মনে মনে আওড়াল,   ছয় পুত্র লয়ে চান্দ শীঘ্রগতি চলে...