বাঙালির শিকার স্মৃতি।। সম্পাদনা : গৌরব বিশ্বাস।।

'জঙ্গল নিস্তব্ধ। একটি পাখীর ডাকও শোনা যায় না। বসে বসে পায়ে ঝিনঝিনি ধরে গিয়েছিল। একটু নড়ে বসতে হোল। পাতার আড়ালেই ছিলাম, বাইরে থেকে আমাকে দেখতে হলে খানিকক্ষণ খুঁজতে হয়, কিন্তু আমার সামান্য নড়ায় গাছের তলায় কুটো ভাঙ্গার শব্দ শুনলাম। যেভাবে বসার ভঙ্গীতে আরাম কায়েমি হয়েছিল তাতে পিছন ফেরা কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তবু ফিরতে হোল। ফিরে যা দেখলাম তাতে স্তম্ভিত হয়ে যেতে হোল। সেই প্রকাণ্ড বাঘ ঠিক আমার গাছের তলায় এসে দাঁড়িয়েছে। কি ভাবে কাঁটা বন পাশ কাটিয়ে নিঃশব্দে এখানে উপস্থিত হোল। অনুমান করা শক্ত। বন্দুক ঘুরিয়ে বাঘের দিকে নেবার উপায় নেই, আরামের প্রণালী মস্ত বড় বাধা হয়ে আছে— আমার চার পাশে ডাল আর পাতা। ইতিমধ্যে বাঘ নিচের ডালে সামনের পা রেখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমার পা থেকে বাঘের থাবা মাত্র কয়েক ইঞ্চি তলায়। বাঁচার কোন রূপ উপায় না থাকায় সামনের দিকে বন্দুকের নল রেখেই বাঁট বগলে তুলে নিলাম, তারপরে ঘোড়া টিপে দিলাম। বিকট আওয়াজ করে গুলি বেরিয়ে গেল এবং সঙ্গে সঙ্গে বাঘ আমার সামনে লাফিয়ে পড়ল। স্ন্যাপ শটে রিফল্-এ বহুদিন হাত পাকিয়েছিলাম। বাঘকে সামনে পেয়ে আর একবার গুলি চালালাম। সামনের জমি থেকে একরাশ ধুলো উড়ে গেল, বাঘও আর এক লাফে জঙ্গলের ভিতর ঢুকে গেল। দ্বিতীয়বার গুলি বার হবার পর যে হুঙ্কার ছেড়েছিল তা শুনলে গর্ভিণীর গর্ভপাত হয়ে যায়। বুকের কাছাকাছি লক্ষ্য করেই বন্ধুকের ঘোড়া টিপেছিলাম। গুলি চলার পর বাঘ যে ভাবে হুঙ্কার দিয়েছিল তাতে অনুমান করা চলে—নিশানা ফাঁকি দেয়নি কিন্তু মাটিতে ধুলো ওড়া এবং পুনরায় লাফ মেরে জঙ্গলে ঢুকে যাওয়ায় লক্ষ্যভেদ সম্বন্ধে আত্মশ্লাঘাকে জীইয়ে রাখা গেল না।

এখন কি করা যায়। দুইবার বন্দুকের আওয়াজের পর লোকেদের গাছ থেকে নেমে আসার কথা। বাঘ কি ভাবে জখম হয়েছে তাও জানি না। মোটের উপর গুলি লাগল কিনা সে বিষয়েই বা কেমন করে নিশ্চিত হওয়া যায়। বাঘ যেদিকে লাফ মেরে জঙ্গলের ভিতর ঢুকে গেল সেই দিকেই লোকেরা গাছের উপর বসতে গিয়েছিল। ভড়কে যাওয়া অথবা জখুমি বাঘের সামনে পড়ে গেলে— ফিরতি মানুষদের মধ্যে একজনের চলা চিরকালের জন্য বন্ধ হতে পারে। ওরা নিরস্ত্র অবস্থায় জখুমি বাঘের আক্রমণে মারা পড়বে, আর আমি বাঘ জখম করে বন্দুক হাতে গাছের উপর বসে থাকব? ঘটনাটি সম্পূর্ণ উপলব্ধি হতে গাছ থেকে নেমে এলাম। জঙ্গলের দিকে ঝোপ-ঝাপ ভাল করে দেখে নিয়ে যেখানে গুলি লেগে মাটির চাপড়া উড়ে গিয়েছিল, পরীক্ষা করলাম— একফোঁটাও রক্তের দাগ নেই।

লক্ষ্যভেদের ব্যর্থতাই আমাকে আস্বস্ত হবার সুযোগ দিল। বাঘের গায়ে যখন লাগেনি, তখন লোকগুলো সশরীরে ফিরে আসতে পারবে। পরক্ষণেই পুরানো  অভিজ্ঞতা মনে করিয়ে দিল হাই ভেলোসিটি রাইফেল-এর মারে রক্ত অনেক সময় কয়েক সেকেণ্ড পরে বার হয়। পুরাতন ঘটনা মনে পড়ার পর জঙ্গলের ভিতর ঢুকতে হলো। হেয়ার ট্রিগার প্রস্তুত রেখে এক পা দু পা করে ভিতরে ঢুকতে যাচ্ছিলাম। খোলা জমি থেকে বেশিদূর আসতে হয় নি, দেখলাম কাঁটা ঝোপের অনেকটা জায়গায় আছাড়ের পর আছাড় খাওয়ায় থেঁতলে গিয়েছে— মরণ কামড়ে ছোট বড় শক্ত ডালকে ডাটা চিবানর মত পিষে দিয়েছে— মাটিতে থোকা থোকা টাটকা রক্ত। গুলি লাগার প্রমাণ ভালই পাওয়া গেল, কিন্তু কোথায় লেগেছে না জানতে পারলে কতটা জখম হয়েছে বুঝি কেমন করে। অনেকে রক্তের রং দেখে বলতে পারেন হৃদয় ছেঁদা হয়েছে কিনা। আমার এই জ্ঞানটি ছিল না। রক্ত ঝরা অনুসরণ করে একলা জঙ্গলের ভিতরে ঢোকার ভরসাও পাচ্ছিলাম না। অপরদিকে চীৎকার করে লোকেদের গাছ থেকে নামতে বারণ করলে, জঙ্গলের প্রতিধ্বনি আমার ভাঙ্গা তামিলকে এমন একটি ভাষা তৈরী করে ছাড়বে যার কোন মানে হয় না। তার উপর বাঘ যদি কাছেই পড়ে থাকে, তাহলে আমার চিৎকার শুনে কোন দিক এবং কত কাছ থেকে আক্রমণ করবে ঠিক নেই। আতান্তরে পড়ে গেলাম। কি করব ভাবছি এমনি সময় সামনের কাঁটা ঝোপ থেকে একটু দূরে গোঙ্গানীর আওয়াজ শুনলাম, অথচ ঝোপ নড়ার কোন ইঙ্গিত পাওয়া গেল না। গোঙ্গানীর আওয়াজে যথেষ্ট শক্তি ছিল, যার থেকে অনুমান করা চলে উত্থান শক্তি রহিত হলেও কাছে পেলে মানুষের উপরও মরণ কামড় দিতে ছাড়বে না। বাঘ কোনদিকে এবং কতটা দুরে আছে ঐটুকু জানতে পারাই আমার পক্ষে যথেষ্ট লাভ। জায়গাটা মনে মনে ঠিক করে ঐ দিকে এগুবার জন্য পা বাড়িয়েছি, বাধা এসে উপস্থিত হোল।

সশব্দে চলার আওয়াজ করতে করতে বাঘ আমার দিকে আসছে। পায়ের তলায় শুকনো কুটো ভেঙ্গে যাওয়া বা পাতা মোচড়ানোর কিছুমাত্র ভ্রূক্ষেপ নেই। যে জানোয়ার নিঃশব্দে চলে তার এইরূপ আচরণ অদ্ভুত লাগল। বেশি এগুতে দেয়া উচিত হবে না ভেবে শব্দ লক্ষ্য করে বন্দুক তুলে ধরলাম। ট্রিগার টিপতে যাব এমনি সময় মানুষের অনুকরণে কাশির আওয়াজ শুনলাম। দিনের আলোতেই গা ছম ছম্‌ করে উঠল। রক্ষা পেলাম মানুষের কথা শুনে। কে একজন বললে 'চুপ'। দুইজন বোধ হয় পাশাপাশি হাঁটছিল সুতরাং ওদের হাঁটাকে চতুষ্পদীর চলা ভাবায় অন্যায় করিনি। যাক একটা প্রকাণ্ড ফাড়া কেটে গেল। শব্দ অনুসরণ করে লক্ষ্যভেদের চেষ্টায় সফল হলে ওদের মধ্যে একটা মরত এবং আদালতে আমার প্রাণ নিয়ে টানাপোড়েন পড়ে যেত। বিপদ তখনও সম্পূর্ণ কাটে নি, চেঁচিয়ে বলতে হোল, এদিকে আসিস না বাঘ এখনও মরেনি। কথাটা শেষ হওয়া মাত্র লোকগুলো উল্টো দিকে ছুট দিল। একজন বোধ হয় আছাড়ও খেল। খানায় পড়ে থাকলেও চমৎকার।

দামী রাইফেলের গুলি খেয়েও বাঘ যদি না মরে তা হলে শিকারীকে বিশেষ অসুবিধায় পড়তে হয় – কারণ তার ইজ্জতের উপর জুলুম চলতে থাকে। এখন আমি করি কী? জখুমি বাঘকে শেষ না করতে পারলে মানুষগুলোকে মৃত্যুর মুখে ফেলে দেয়া হয়, নিজেরও মুখ দেখাবার উপায় থাকে না। পায়ে হেঁটে বাঘ শিকারে আসা মানেই সাহসী হিসাবে আত্ম-বিজ্ঞপ্তির প্রচার। হত্যার সৌখিনতায় বন্দুকের শক্তি পরীক্ষা।

সব দিক ভেবে ঠিক করলাম, বাঘকে মেরে মড়াকে স্বচক্ষে না দেখলে টিটকারীর পীড়ন সহ্য করতে হয়। দম্ভের শাসন নত হতে দিল না, এগুতে লাগলাম। দিগভ্রমের সম্ভাবনা ছিল না, বাঘের গোঙ্গানীই জানিয়ে দিয়েছিল কোথায় সে আছে। বেশি দুর যেতে হোল না। একটি ঝোপের তলায় নরখাদকের পিছন থেকে খানিকটা পায়ের অংশ দেখতে পেলাম। পেট ও বুক ঝোপের তলায় আড়াল পড়েছে। নিশ্বাস- প্রশ্বাস চলছে কিনা জানতে হলে আর খানিকটা দেহ দেখা দরকার কিন্তু কাছে যেতে হলে পুরাণ উই এর ঢিপি মাড়িয়ে যেতে হয়। পায়ের চাপ পড়লে টিপির ডগা কি ভাবে ধসে যাবে কিছুই ঠিক নেই এবং ধসলে যদি টাল সামলাতে না পারি তাহলে আছাড়ের সঙ্গে বন্দুকের নল আমার মাথার খুলি পর্যন্ত উড়িয়ে দিতে পারে। খুলি না উড়লেও পুরাণ উইএর ঢিপি কেউটে বা গোক্ষুরের এক একটি কেল্লা! ওখানে অনধিকার প্রবেশের জন্য ছোবল মেরে আপ্যায়িত করলে জীবনের অবসান সুনিশ্চিত।

চিন্তা করে দেখলাম, এখনও যদি বাঘের আক্রমণ করার শক্তি থাকে তাহলে শুন্যে গুলি চালিয়ে ওটাকে ঝোপ থেকে বার করে আনা দরকার। চেম্‌বারে পাঁচটা টোটা ছিল। দুটো খরচ হয়েছে, আর একটা শুন্যে ওড়ালেও আত্মরক্ষার জন্য দুটো থাকবে। যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম সেখান থেকে যতটা পারলাম পিছিয়ে গিয়ে যেটুকু দেহ দেখা যাচ্ছিল তাই লক্ষ্য করে ট্রিগার টিপলাম, বারুদ ফাটল, সমস্ত পাহাড় তোলপাড় করে গুলি চলার আওয়াজ জানিয়ে দিল আমার দম্ভের কথা। মরা বাঘকে ডবল করে মারলে সাহসের দাবী বাড়ে না, তবে নিশ্চিন্ত হওয়া চলে মানুষের হিংস্র প্রকৃতিকে সুস্থ রাখার জন্য একটি বুভুক্ষু আহারান্বেষী প্রাণীকে বধ করার আনন্দ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করিনি। বলাই বৃধা, বন্দুকের শক্তির সাহায্যে আমার সাহস দেখানোর প্রমাণ আজও আমার ঘরে সাজান আছে। বাঘ মরেও নিষ্কৃতি পায় নি, আজও হয়ত চরিত্রশুদ্ধির কথা শুনছে।'

শ্বাপদ সন্ধানে
দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী
.....................................................................
বাঙালির শিকার স্মৃতি
সম্পাদনা : গৌরব বিশ্বাস 

প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী

মুদ্রিত মূল্য : ৪৯০ টাকা

#সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।