শেষ মৃত পাখি।। শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য।।

সুপ্রকাশ প্রকাশিত শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের উপন্যাস ' শেষ মৃত পাখি ' পড়ে লিখেছেন ঈপ্সিতা গুপ্ত। আমরা তাঁর অনুমতি নিয়ে নিজেদের টাইমলাইন থেকে শেয়ার করছি। 
...........................................

শব্দছক খেলতে বসেছেন নিশ্চয়ই কখনও না কখনও। ধরুন একটা শব্দ খুঁজে পেলেন। সেটার সাথে জুড়ে থাকা শব্দ, তার সাথে জুড়ে থাকা শব্দ... পরপর সুন্দর করে মিলে যাচ্ছে। মন খুশি। ছকটার সমাধান সেরে ফেলছেন, এই আনন্দে। কিন্তু শেষ শব্দ, যেটা পেয়ে গেলেই ছক সম্পূর্ণ হবে, সেখানে এসে আটকে গেলেন। অনেক চেষ্টা করেও শব্দ খুঁজে পেলেন না। বুঝলেন, প্রথম খুঁজে পাওয়া শব্দ থেকে শুরু করে সবটাই ভুল করেছেন। সবটাই বাতিল। আবার করে শুরু করতে হবে। কেমন লাগবে বলুন তো!

বর্ষার দার্জিলিং। কুয়াশায় মোড়া, অবিশ্রান্ত বৃষ্টিতে ঝিমিয়ে পড়া দার্জিলিং। যে শহর বিশেষ বিশেষ সময়ে মানুষের কোলাহলে মুখরিত হয়ে ওঠে, বর্ষায় সেই যেন মুখ গুঁজে থাকে শরীরের মাঝে। বিষন্নতা তখন তার সঙ্গী। এই দার্জিলিঙে পা পড়ল প্রবাসী বাঙালি মেয়েটির। পেশায় সাংবাদিক হলেও তার কাজ অন্যরকম। সারা দেশের অমীমাংসিত বিভিন্ন ঘটনার তল খুঁজে বের করতে চায় সে। তারপর তা নিয়ে লেখে জমজমাট সব কাহিনী। সবাই মুখিয়ে থাকে সেইসব কাহিনীর জন্য। এবার সে এসেছে শৈল শহরে, তার এই সিরিজের শেষ কাজটি করতে। সেই রহস্য, যা তাকে নাড়িয়েছিল সেই কোন এক ছোটবেলার দুপুরে।   

১৯৭৫ সালের জুন মাস। সংবাদমাধ্যম উত্তাল। বিভৎস ভাবে খুন হয়েছেন সম্ভবনাময় কবি অমিতাভ মিত্র। কবরখানায় এক সমাধির পিছনে পরেছিল তাঁর উল্টানো শরীরটা। মুখ বলে কিছু নেই, শরীরে আরও আঘাত দৃশ্যমান। কে করল এমন নৃশংস খুন? সন্দেহের তীর তার দিকে, যে ছিল মৃত মানুষটির সবচেয়ে কাছের জন। ছোটবেলার বন্ধু। রহস্য কাহিনীর লেখক হওয়ার চেষ্টায় মগ্ন অরুন চৌধুরী।

একটা শেষ না হওয়া উপন্যাস। দুই বন্ধুর কাহিনী। দুজনই সন্দেহ করছে, খুন হবেন। দুজনই চিঠি লিখেছেন এক গোয়েন্দাকে। ইতিমধ্যেই ঘটে যায় একটি খুন। অসমাপ্ত কাহিনীর শেষে কী প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন লেখক?

একটা ঘোড়া। সারা গায়ে বৃষ্টির ছিটে নিয়ে দেখা দিচ্ছে সে। বারবার। অদ্ভুত ভাবে মাথা নীচু তার। কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করতে থাকে তনয়া, দার্জিলিঙে এসে উপস্থিত সাংবাদিক‌ মেয়েটি। এ যেন কীসের প্রতীক হয়ে উঠছে!

একটা থানা। ভয়ঙ্কর কান্ড ঘটেছে বলে বোঝা যাচ্ছে। মধ্যরাতে এসে উপস্থিত হল ইনচার্জ ড্যানিয়েল লামা। আজ তো তার ডিউটি নেই।‌ তাহলে সাধারণ পোশাকে এত রাতে কার ফোন‌ পেয়ে ছুটে এল সে?

রহস্য কাহিনী। কিছু ঘটনা, কিছু পারিপার্শ্বিক পরিবেশ, কিছু ক্লু, এক বা একাধিক সম্ভবনা। একপাশে তদন্তকারী দল, অপরপাশে সন্দেহজনকেরা। কিছু নির্মান, কিছু বিনির্মাণ। এভাবেই শেষমেষ সমাধান। দোষীর শাস্তি, সত্যের জয়। কিন্তু সব রহস্য কাহিনীর গতিপথ কি এতটাই সরলরৈখিক? না। কিছু কাহিনীর শেষ আর শুরুর অনেকটা তড়িৎ বর্তনীর মত। অনেকগুলো চাবির জায়গা আছে মাঝপথে। আর চাবিগুলো হারিয়ে গেছে। তাই.... আলো থেকেও জ্বলছে না।

বছর শেষের কাউন্টডাউন এখন ঘন্টা হিসেবে গোনা হচ্ছে। একটা গোটা বছর। ৩৬৫ দিন। কত বই দেখলাম, তার কিছু সংগ্রহ করলাম, তার আবার কিছু পড়ে ফেলতে পারলাম। শেষ আর শুরু যখন একলগ্নে ঘটে, তখন শেষের উদযাপন জমকালো হতেই হয়। সময় এগোতে থাকে সেই মাহেন্দ্রক্ষণের দিকে। বছরের শেষ বইটি যেন এই নীতির বিরূদ্ধাচারণ না করে, সেই জন্যই বেছে নিয়েছিলাম বইটিকে। 'শেষ মৃত পাখি'। বহু পাঠকের মুগ্ধতা এই সিদ্ধান্তে আসার মূল কারণ। বড় বই। চারশোর বেশি পাতার জন্য ধার্য করেছিলাম তিনটে দিন। কিন্তু, এতক্ষণ সময় দেওয়া গেল না। দু দিন, আরও ঠিক করে বললে ৩৬ ঘন্টাতেই শেষ করে ফেলতে হল পড়া। এ বই একবার ধরলে, শেষ না হওয়া অবধি থামা বড্ড কঠিন।

ইর্ষা আর বন্ধুত্বে কে জেতে? কবিতা আর গদ্যের লড়াই কি সত্যি? রহস্য বড়ই রহস্যময়। আর জগৎ সংসারে সবচেয়ে বড় রহস্য - মৃত‌ ব্যক্তি। 
এ বই পড়ে দীর্ঘক্ষণ ভাবতে হবে। ভাবতে হবে, কী পড়লাম। ধীরে ধীরে বুঝতে হবে, কী হল, কেন হল, কীভাবে হল। তারপরও থামা যাবে না। অনেক কিছু ভাবা এরপর শুরু করতে হবে। তারপর দীর্ঘসময় ধরে আত্মস্থ করতে হবে সবটা।

এবছরে পড়া দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ বই এটিই। এযাবৎকাল পর্যন্ত  আমার পড়া অসাধারণ বইয়ের তালিকায় স্থান দিলাম এটিকে। বছরের শেষ দিনটায় আরও একটা কোনো বই পড়া যেতই। কিন্তু পড়ব না। এ স্বাদ লেগে থাকুক মনে।

শেষ মৃত পাখি
শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য
সুপ্রকাশ 
₹৫২০.০০

আর হ্যাঁ। যা না বলে শেষ করা অনুচিত। মরা আলোর হলদেটে রঙে আঁকা বৃষ্টি ভেজা পাহারের কোলে দাঁড়িয়ে থাকা বাড়িটি অদ্ভুত সুন্দর। সামনে সিল্যুয়েটে ধরা দেওয়া মানুষটি ততটাই রহস্যাবৃত। সৌজন্য চক্রবর্তীর সাজানো প্রচ্ছদটিও মনে গাঁথা রইল।

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।