ঝিঙাফুলের কলি।। মিহির সেনগুপ্ত।।

'কৈকেয়ী এরপর পাতা নাচের ছুট্‌কো কিছু গান করে। পাতা নাচ আর পাঁতা নাচ দুটো আলাদা ব্যাপার। পাঁতা নাচ আদিম মানুষের বৃষ্টি প্রার্থনা এবং শস্যোৎপাদন ক্রিয়ার ঐন্দ্রজালিক, বিশেষত যৌন ক্রিয়া অনুকৃতির অনুষ্ঠান। ধরিত্রীর উর্বরতা কামনাও এই অনুষ্ঠানের অন্যতম অঙ্গ। পাতা নাচ শুধু করম নাচের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। এ বিষয়ে গবেষকদের মধ্যে বিতণ্ডা আছে, তা থাকুক, কৈকেয়ী গাইছে,-

“আমার বঁধু হাল বাহে
কিয়া লাটার আড়ে
ডাহিনে বায়ে লাল গরু
দেখে হিয়া ফাটে
ননদী লো আমি যাব
নিজেই বাইসাম্ দিতে।' (বাইসাম বাসি আমানি পান্তা ভাত )

এবং

“আমার বঁধু হাল বাহে কেঁদ কানালীর ধারে
গরা গায়ে খরা লাগে বড় দয়া লাগে।
মুখের ঘাম ছুঁয়ে পড়ে দেখে নয়ন ঝুড়ে
ননদী লো হামি যাব নিজেই বাইসাম্ দিতে।'

ঝাড়খন্ডি কিষাণ ভোর ভোর লাঙল কাঁধে মাঠে যায়। কেয়া ঝোপের ধারে সে লাঙল চষে। ক্রমে বেলা বাড়ে, প্রখর হয় রোদ্দুর। কিষান বউয়ের মনও ততই স্বামীর জন্য চঞ্চল হয়। ননদকে বলে, স্বামীর বাইসাম সে নিজেই নিয়ে যাবে। এ ভাষা আমাদের প্রতিবেশীর মুখের বুলি। বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রয়োজন হয় না। কিন্তু বাইসামের দেরি দেখে তো স্বামী নিশ্চয় রাগে ফুঁসছে—

'টেনা ছিঁড়ার করম দড়ি হাল বাহতে পড়ে মরি
এত কেন বাইসামের ডেরী—
মনে করে দিব এক লড়ি।'

দেরির জন্য, ক্লান্ত, অধৈর্য ক্ষুধার্ত স্বামীর লাঙল চালানোর লাঠি দিয়ে বউকে ঘা কতক দেওয়ার ইচ্ছে হয়। কিন্তু বউ-এর তো আর কাজ একটা নয়, হাজার দিক সামলাতে হয় তার। তাই চূড়ান্ত ইচ্ছে থাকলেও তাড়াতাড়ি স্বামীর বাইসাম পৌঁছে দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব হয় না। কারণ,

'ছানা দুট্যা হরল গরল
গোয়ালে গোবর ভরল
শাশুড়ি ননদী রঙ্গ দেখে।
শিকড় বাকড় কাঠ রন্ধু চুল্হা ধরেনা হে
কি করে বাইসাম দিব্য ছানা রহে না যে।'

কৃষিকর্ম নির্ভর এইসব গানে দাম্পত্যজীবনের যে দ্বন্দ্ব-মাধুর্য রূপ ফুটে ওঠে, সেই সহজতা লোকসাহিত্যের সার্থকতার জগৎ, অন্যত্র তা একান্তই দুর্লভ। ঝাড়খন্ড লোকসাহিত্যের অন্যতম অংশ পাঁতা নাচের গান সেই বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল।

কৈকেয়ী তার গান সাঙ্গ করে সখীদের সঙ্গে সভার উদ্দেশে প্রণতি জানায়। আমরা সভার বিশিষ্ট অতিথি। বিডিও পুষ্পিতা, সিও ডাং সাহেব, দুর্গাবাবু, শাহনওয়াজ ইত্যাদি সভার এক অংশে অন্যান্য বিশিষ্ট মহিলা-পুরুষদের সঙ্গে বসেছি। কৈকেয়ী এবং তার সঙ্গীরা আমাদের কাছে এসে সবার উদ্দেশে বিশেষ শ্রদ্ধা সম্মান জানায়। সবাই সমস্বরে তাদের গানের প্রশংসা করে। এরই মধ্যে বাঁশরি এসে কৈকেয়ীকে হাত ধরে সভার বাইরে নিয়ে যায়। সম্ভবত, একান্তে তার সঙ্গে আলাপ-পরিচয় করার জন্য। দুর্গাবাবু তাদের বলেছেন যে সভা শেষে যেন তারা তাঁর সঙ্গে কথা না বলে চলে না যায়। তাঁকে আমি আগেই বলে রেখেছিলাম, যে এই দুই পার্বতীর সঙ্গে আমি কিছু বিশেষ জানকারির জন্য আলাপ করতে চাই। দুর্গাবাবু বলেছেন, ‘ব্যাপারটা আজই সময়ে কুলোবে কিনা সন্দেহ। তবে অবশ্যই আলাপ-পরিচয়টা হবে।' দেখা যাক।' 


ঝিঙাফুলের কলি
মিহির সেনগুপ্ত

প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী

মুদ্রিত মূল্য : ৪৫০ টাকা

#সুপ্রকাশ 

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।