অনন্যবর্তী।। দুর্লভ সূত্রধর।।

সুপ্রকাশ প্রকাশিত দুর্লভ সূত্রধরের উপন্যাস 'অনন্যবর্তী' পড়ে লিখেছেন গৌরব বিশ্বাস। আমরা তাঁর অনুমতি নিয়ে নিজেদের টাইমলাইন থেকে শেয়ার করছি। 
..................................................
দুলর্ভ সূত্রধরের এ উপন্যাস পড়ার প্রথম সৌভাগ্য হয় গতবছর শারদ নির্মুখোশে। সেবছর শারদ নির্মুখোশের মূল থিম ছিল বাঙালির নব্বই দশক। কিন্তু এ উপন্যাসকে নির্দিষ্ট কোনো কালের সীমাগন্ডিতে বাঁধা চলে না। হতে পারে, এ উপন্যাস যে সময়কালের কথা বলে, সেটা সাতের দশক। কিন্তু যে গুটিকয়েক মানুষ জনের সাথে পরিচয় করায়, তেমন মতাদর্শ নিষ্ঠ মানুষজন সবকালেই বড় দুলর্ভ।
এ উপন্যাস এ কিশোরের অভিমানী কৈশোরের যৌবনে পদার্পনের আখ্যান। তাঁর দৃষ্টিতে সমাজকে দেখা, মতাদর্শের আগুনের প্রথম পাঠ এবং চারিপাশের মানুষজনের মধ্যে নিজেকে খুঁজতে চাওয়ার প্রচেষ্টাও বটে। 
নিজের 'আইডেন্টি' খুঁজতে গিয়েই কিশোর শোভন আবিষ্কার করেছিল, তার পরিবারে তার অবস্থান কতকটা জ্যামিতি বাক্সের দু-কাঁটার কম্পাসটার মতো। তাকে নিয়ে কারও বিশেষ হেল-দোল নেই। এর জন্য সে অভিমানী কিন্তু এতে সে অভ্যস্তও। বরং, তার গুরুত্ব তার বন্ধু-বান্ধবদের দলের মধ্যে এবং অবশ্যই টুকুর কাছে। 
শোভনের কথনেই এবং শোভনকে ঘিরেই এ উপন্যাসে ক্রমে হাজির হয় সতীশচন্দ্র, শচীন্দ্রপ্রসাদ, ফণীভূষণ, কুসুমিতা, তরুবালা, কৃষ্ণাদি, অবনদার মতো পার্শ্বচরিত্ররা। 'পার্শ্ব' কথাটা উল্লেখ করলাম বটে, কিন্তু এই চরিত্রগুলো না থাকলে, শোভন তনয়দের বেড়ে ওঠার মতাদর্শ নিষ্ঠ আখ্যানটিও পরিস্ফুট হত না। 
দুর্লভবাবুর 'আহম্মকের খুদকুঁড়ো' যাঁরা পড়েছেন, তাঁরা উপন্যাসের এই চরিত্রগুলো সম্পর্কে কিছুটা পূর্ব পরিচিত। এবং এ উপন্যাসের চরিত্রায়নের ছাঁচই বুঝিয়ে দেয় এ উপন্যাস আত্মজৈবনিক। অথচ, তাতে আমিত্বের আত্মরতি নেই বরং আত্মকেন্দ্রিকতার ঊর্ধে এক দল কিশোরের সমাজের জন্য ভাবনা। ব্যক্তিগত সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের 'অপবিত্রতা'কে মহত্ত্বর মতাদর্শে উদবর্তন। মতাদর্শই তো সমগ্র জীবনের পথ নির্দেশিকা।
এ উপন্যাস আসলে দুই প্রজন্মের মানুষের কথা বলে। নবীন প্রজন্মের শোভন তনয় এবং তাদের বন্ধু-বান্ধবীরা। এবং পূর্ববর্তী প্রজন্মের সতীশচন্দ্র শচীন্দ্রনাথ ফণীভূষণ। সময়কালের নিরিখে দুই প্রজন্মের বয়সজনিত পার্থক্য থাকলেও, মতাদর্শের ভিত্তিতে এক প্রজন্ম অপরটির ছায়া মাত্র। সতীশচন্দ্র, শচীন্দ্রনাথ এরা যেন যৌবন কালের শোভন তনয়। দুই প্রজন্মের বেড়ে ওঠা, জীবন যাপন, আশা-নিরাশার এবং মতাদর্শের মধ্যে কী সাংঘাতিক মিল। আবার পার্থক্যও আছে। শোভন-তনয়দের নব অঙ্কুরিত মতাদর্শ সরলরৈখিক। নিজের সমস্তটা মতাদর্শকে বাস্তবায়িত করার স্বপ্ন দেখে শোভন তনয় টুকুর যৌবন। কিন্তু সতীশচন্দ্রের মতো মধ্যবিত্ত সংসারের জোয়াল, পরিবারের অতি প্রিয়জনদের স্বার্থকেন্দ্রীক আচরণে নিরন্তর রক্তাক্ত মানুষরা জানেন-"যে কোনো আদর্শই শুনতে ভালো, কিন্তু তার প্রয়োগ-পদ্ধতি অত্যন্ত জটিল এবং কষ্টসাধ্য এক প্রক্রিয়া'। এক সময় তাঁরাও তো তাঁদের যৌবন ঘিরেও শোভন তনয়দের মতো কত স্বপ্ন দেখেছিলেন!
কিন্তু মতাদর্শের এই জটিল কষ্ট-সাধ্য বাস্তবিক প্রয়োগটাই সতীশচন্দ্র, শচীন্দ্র, ফণীভূষন আর নীরদবাবুরা প্রৌঢ় বয়সে করে দেখান শটি ডাঙায়। এই চার প্রৌঢ়ের(?) কর্মকাণ্ডই আবার নতুন করে ভরসা যোগায় শোভন তনয়, টুকু কাজুদের মনে। 
আর এই দুই প্রজন্মের মানুষজনের আশা-হতাশা, জীবনের উত্থান পতন, মান-অভিমান, ভালোবাসার রঙ প্রতিফলিত হয় চিরবহমান কুন্তীর অপরাহ্ন আলোয়। 
এই উপন্যাসের মানুষজনেরা কেউ কেউকেটা নন। অতি সাধারণ পরিচিত মানুষজন- ঘরেও নহে, পারেও নহে / যে জন আছে মাঝখানে'.... সেই তাঁদের প্রতিদিনের বেদনাকে/সেই  তাঁদের/জেগে-ওঠা ভোরগুলোকে। 
এ উপন্যাস গতিবিধি অনুযায়ী হতেই পারত,  পরিবারে আপাত অপাংক্তেয় এক কিশোর কিংবা জীবন সংগ্রামে নিরন্তর ক্লিষ্ট মতাদর্শ আঁকড়ে বেঁচে থাকা তিন প্রৌঢ়ের কিংবা উপন্যাস জুড়ে ছড়িয়ে থাকা টুকরো টুকরো নানা চরিত্রের বিষণ্নতা উদযাপনের আখ্যান। কিন্তু লেখক মহাশয়, কলমের মায়াবী মোচড় অনায়াসে সে আশঙ্কা উড়িয়ে সন্ধান দিয়েছেন, উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় আলোকবর্তিকার।  শোভন আর এখন স্বপ্নে উড়োহাজের গায়ে সেঁটে থাকে না। স্বপ্নে সে এখন উড়োজাহাজের পেটের ভিতর। শুধু সে কেন, উড়োজাহাজ বয়ে নিয়ে চলেছে দুই প্রজন্মকে-শোভন-তনয়-সতীশচন্দ্র-শচীন্দ্র-ফণীভূষণ,  তাঁদের ভরসার মানুষ গুলোকে। আর শোভনের ঠিক পাশেই থাকে টুকু-তার খরতপ্ত জীবনের 'ওয়াশিস'। জীবন তো আসলে এমনই-'আলোর উৎসার', 'ভালো মন্দের সারাৎসার'। জীবন অনন্য-অনন্যবর্তী।
'আছে দুঃখ আছে মৃত্যু বিরহ দহন লাগে/ তবুও শান্তি তবু আনন্দ তবু অনন্ত জাগে'।

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।