অনন্যবর্তী। দুর্লভ সূত্রধর।।

সুপ্রকাশ প্রকাশিত দুর্লভ সূত্রধরের উপন্যাস 'অনন্যবর্তী' পড়ে লিখেছেন বরুণদেব। আমরা তাঁর অনুমতি নিয়ে নিজেদের টাইমলাইন থেকে শেয়ার করছি।
.............................................................................

অনন্যবর্তী – দুর্লভ সূত্রধর
------------------------------------------- 
একটি স্বপ্ন। উড়োজাহাজের দরজার রাবার প্যানেল ধরে,  রূপালি দেওয়ালের ডিম্বকৃতি বাঁকের মুখে সেঁটে থেকে,  উড়ে চলা । শৈশব থেকে কৈশোর। স্বপ্নের শেষটায়, মায়ের মুখ, ঝড়-ঝঞ্ঝার কৈশোরে,  বদলে যায় কৈশোরের প্রেমিকায়। একটা সময়ে এসে এই  ‘ভেতরে কিছু ঘোষণা, বাইরে শুধু শূন্যতার পদাবলী’ উড়োজাহাজের স্বপ্ন ধরা দেয় না আর।  তখন পাহাড়ী ঝর্ণার ধারে প্রেমিকার শাড়ির আঁচল। তবে এ কাহিনী নিছক কিশোর-প্রেমকাহিনী নয়।
একদল ছেলেমেয়ের বাল্য-কৈশোর থেকে প্রথম যৌবনের বয়ে চলার কাহিনী। মোবাইলপূর্ব মফস্বলীয় যাপন –স্বপ্ন- সংস্কৃতি-ইশতেহার, স্বচ্ছ শান্ত ধারায় কুন্তীর পাড় ধরে বয়ে চলে। সেখানে তরঙ্গ আছে, ঢেউ নেই। সেখানে বাতাস বয়, ঝড় নয়। সেখানে মতাদর্শ আছে, দু’পাড় কাঁপানো জিন্দাবাদ নেই। সেখানে ক্ষমতা আছে, হাড়-হিম শান্তি নেই। সেখানে আখে শেখ, ফণীভূষণ, শচীপ্রসাদ, জাহান আলি স্বর্ণপণ্ডিত, ইমামদের হাতে হাত ধরার চির বহমান সংস্কৃতি আছে, ধর্মের দামামা নেই। একান্নবর্তী পরিবারের ভেঙে যাওয়ার যন্ত্রণা আছে, কাঁকর-চালের অর্থনীতি আছে, যাপনযুদ্ধের মাঝে আদর্শচ্যূত হয়ে বিপথগামী হওয়ার উপাখ্যান নেই। কিশোরী ভাগ্নীর প্রেমের খবরে ইশ্তেহারের অবনদার ‘বাড়ি থেকে বেড়ুনো নিষেধ’ এর ফতোয়া যেমন আছে, তেমনি আছে  ছেলেমেয়েদের মেলামেশায় বাধা না দেওয়া শশিভূষণ, তরুবালা কুসুমিতা ফণীভূষণরাও। আছে কৃষ্ণাদি-অবনদার ইস্তেহারের আড়ালে এক নিরুচ্চারিত ব্রতযাপন। সে ব্রতে চুপিসারে ফাগুন এসেও ডাক দিয়ে যায়, অন্যভাবে।
কুন্তীর জলে ঢেউ ওঠার সব রসদই মজুত ছিল। কালবৈশাখীর তাণ্ডবে শিকড় উপড়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে যাওয়ার উপাদান ছিল - নাইট স্কুলে, সৎ মা-বোনের কুঠুরীতে, যৌথখামারের খবর পাওয়া মুরুব্বিদের হেঁ হেঁ তে, ফয়েজ আলির ছড়িগাছায়। এ কাহিনীতে কোথাও চড়া সুর নেই। না মতাদর্শের, না মতাদর্শগত বিরোধের। না সংসার, না স্কুলবেঞ্চ, না গোষ্ঠীর অন্তরকলহে।   যে কাহিনী একদল কিশোরের বন্ধুতাকে ঘিরে এগিয়ে চলে, তাদের মাথা ঝিমঝিমে প্রেম-বিরহে কৃষ্ণচূড়া রাধাচূড়ায় ফুল ফোটে, কুন্তীর শান্ত স্বচ্ছ জলের পাড়ের সে বাতাসে কালবোশেখী থাকে না। স্বর্ণ পণ্ডিত – ফয়েজ আলি-জাহান চাচা- ফণীভূষণ- উষারাণী-কৃষনাদি-অবনদারা বানভাসি ঢেউ তুললে, এ কাহিনীর ভিত্তি যে কুসুমকোমল কিশোর-কিশোরীদেরর বেড়ে ওঠার বেলা, তাদের স্বপ্ন দেখা, হাত বাড়িয়ে দেওয়া, যে শান্ত স্নিগ্ধ মফস্বলীয় পদাবলীর সুর, সে সংস্কৃতি, মতাদর্শ, সুন্দর পৃথিবী গড়ার অঙ্গীকার  – এসব শাটিডাঙার বনবাদারে মাটির তলায় চলে যেত। এই মায়া, এই স্বপ্ন দেখা ও দেখানো, মধ্যবিত্তযাপনের এই পদাবলী ঠিক ঠিক সুরে তালে না বাজলে, ঐ কিশোর-কিশোরীরা- তনয় -শোভন- টুকু-কাজু-তরণী-মনোজ-শিবু-তপেশ ……কুন্তীর কোমল বাঁক ছুঁয়ে সারি গানের সুর তুলে যাওয়া পাল তোলা নৌকার মত  ভেসে যাবে কি করে! ‘ভেতর থেকে মুক্ত হওয়াটাই আসল মুক্তি’, সেই চেতনা ও বোধে দীক্ষিত হবে কি করে! এখানেই ‘অনন্যবর্তী’ অনন্য ।
ইস্তেহারের অক্ষর মেনে জীবন ও সমাজ চলে না। নাইটস্কুল বন্ধ হয়। যৌথখামার কিন্তু বেড়া বাঁধে। মতাদর্শগত বিরোধ থাকে। মতাদর্শ ক্লীব হয়ে যায় না। জীবনে কোনো ম্যাজিক না থাকা কয়েকজন মানুষ, ইস্তেহারের প্রায়োগিক ব্যর্থতার অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে  যেতে যেতে, যাপন-যন্ত্রণা ও স্বপ্ন- স্বপ্নভঙ্গকে সঙ্গী করেও, স্নেহ-মায়া- মমতা- দায়বদ্ধতা -ভালোবাসা দিয়ে, আমি-আমরা, তুমি-তোমরার বহমানতাকে জাগিয়ে রাখে, জাগিয়ে রাখে মতাদর্শকে। আর তাদেরই ছেলেমেয়েরা, আনন্দ-আনন্দীর গোপালরা, একতারা-খঞ্জনীর সুরে সুরে,  আচারের শালপাতা চাঁটতে চাঁটতে, সংগঠন- নাটক-সিলেবাস-প্রেম -পত্রিকার বেলা পেরোতে থাকে। এই দুই প্রজন্মের কাহিনী সমান্তরালভাবে নয়, চানু ঘোষাণীর চায়ের দোকানের পাশে  পরস্পরকে জড়াজড়ি করে বেড়ে ওঠা কৃষ্ণচূড়া-রাধাচূড়ার মতই বেড়ে ওঠে,  ফুল ফোটায়, যে যার মত। কৃষ্ণচূড়া এবং রাধাচূড়া। ডালে ডালে, কাণ্ডে-মুলে, পরম আদরে, মায়ার বিস্তার করে। ভরসা জোগায়। ভালোবাসা দেয়।   
তখনই উড়োজাহাজের স্বপ্নটা ফিরে আসে। উড়োজাহাজের গায়ে সেঁটে থেকে মেঘ কুণ্ডলিতে শ্বাসরোধ হওয়ার স্বপ্ন নয়, নবযৌবন উড়জাহাজের পেটের ভিতরে বসে  – একা নয়, সবাই। এ কাহিনী যে আক্ষরিক অর্থেই বন্ধুতার। সে বন্ধুতা- নিজ –নিজ বৃত্তের। সে বন্ধুতা প্রজন্মের সঙ্গে প্রজন্মের।
স্বপ্ন দেখা দিয়ে এ কাহিনীর শুরু, শেষ হয় স্বপ্ন দেখানো দিয়ে-
‘এই আম দুটো বাপ খাবে। মা মরে যাবার পর তো আর আম-‘ বলে নৌকার লগি ঠেলে যে কাল্লু, সেই কাল্লুকে, পাড়ের ঢালটার মুখে দাঁড়িয়ে, অদ্ভুত নরম গলায় বলে ওঠে কাজু- ‘আমাদের সব বাড়ির অনুষ্ঠানে, সব আনন্দে তোদের ‘নেম্‌তন’ পাকা। তুই তো আমাদেরই বন্ধু, নাকিন?’
কুন্তীর দু-পাড় বিকেলের আলোর অবগাহনে ভাসে। পাঠকও।


Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।