ঝিঙাফুলের কলি।। মিহির সেনগুপ্ত।।

'বাইরে প্রবল বৃষ্টি চলছে। ইস্কুলবাড়ির সামনে একটি সুবিস্তীর্ণ খেলার মাঠ। স্থানটির নাম পাঠান- টোলি। মোগল আমলে নাকি পাঠান-পল্টনের ছাউনি ছিল জায়গাটা। তোপচাঁচি, বাসপুরা, তাঁতরি, করমাচাড়, মানটাড় এইসব গাঁও-বসতিগুলো পোক্ত হলে এখানে দুর্গাবাবুদের এই ইস্কুলটির পত্তন হয়। ইস্কুল এলাকার আশেপাশে দু-একটি ঝোপড়ি আছে। তারা সব রুইদাস জাতের লোক। ইস্কুলের অবস্থান দক্ষিণ-মুখী। পুব দিকের একটি ঝোপড়ি বা টালির ছাউনিওলা কুটিরের চালে ভারি সুন্দর হলুদ রঙের ফুল ফুটে রয়েছে।

দুর্গাবাবুকে বলেছিলাম আজ ঝিঙাফুল্যা নাচগান বিষয়ে কথা হবে। দুর্গাবাবু মোটা বাঙালিদের নিয়ে একটা বড়ো আলোচনার সূত্রপাত করার মুখে সেটাকে থামা দিতে হলো। কারণ, আমার মনের মধ্যে একটা নতুন সাংস্কৃতিক সমাচার শোনার আগ্রহ বড়ো উতলাভাব সৃষ্টি করেছিল। দুর্গাবাবুর আলোচনাটিও অবশ্য নতুন তথা অজানা সংবাদ পরিবেশনের দিকে এগচ্ছিল, কিন্তু অতবড়ো পরিধির আলোচনার মধ্যে যেতে মন চাইছিল না। ভাবছিলাম, আগে প্রাথমিক কিছু উচ্ছ্বাসের নির্মাণ হোক, তাত্ত্বিক ব্যাপারটা পরে হবে।

চা খেতে খেতে দুর্গাবাবু পুবদিকের সেই হলদে ফুলে ছাওয়া চালার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘দেখুন এই বাদলা বিকেলের সাঁঝে ওই ঝিঙাফুলগুলো কেমন শোভা দিচ্ছে। এখন যদি বৃষ্টিটা একেবারে না থাকত, আর খানিক রোদ্দুরের ছোঁওয়া থাকত আরও চমৎকার দেখাত।' মনে হলো, দুর্গাবাবুকে এখানের লোকেরা যতই রাশভারী ভাবুক, মানুষটি খাঁটি মানভূমিয়া রসিক এবং তাঁর প্রাণে কবিতা আছে। আমাকে ঝিঙাফুল্যা নাচ-গানের কথা শোনাবার জন্য বোধহয় মানুষটি উপযুক্ত আবহ সৃষ্টি করছেন। রঘুনাথকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, “হেই রঘুনাথোয়া, করমা নাচের গানা তোহর আতেই কি নাই।' রঘুনাথ লাজুকভাবে বলল, ‘আতেই থোড়াবহুৎ, লেকিন আচ্ছা নাই হতেই। সুরঠো লাই আইগা গলায়। ফির দ্যাখেন আইগা ইসরতো বিটি ছাওয়ালদের বেপার বটে।' দুর্গাবাবু পুব দিকের সেই ঝিঙে ফুলে ছাওয়া চালাটা দেখতে দেখতেই বললেন, 'ওই যে ঝিঙাফুলগুলো ফুটে আছে, উয়্যার, কি একটা গানা আছে না? বিটি ছেলাগুলা করে?' 'হুঁ আইগা’—  বলে সে গাইতে শুরু করে দিল—

‘সাঁঝে ফুটে ঝিঙা ফুল
সকালে মলিন
আইজ কেনে বঁধুর
বদন মলিন হে?
সাঁঝে ফুটে ঝিঙাফুল
সকালে মলিন।’

রঘুনাথের গলা মাত্রাতিরিক্ত বেসুরো বলে দুর্গাবাবু তাকে থামিয়ে দিলেন। বললেন, ‘করম ঠাকুরের পূজা উপলক্ষে যে নাচের অনুষ্ঠান হয় তাই করম নাচ। আর সেই নাচের সঙ্গে যে গান গাওয়া হয় তাকেই ঝাড়খন্ডে করম নাচের বা পাতা নাচের গান বলে। আসলে এসব গানের সুর ঝুমুরের সুরই। মেয়েরাই ব্যাপারটা করে। গান-নাচ তারাই করে। প্রায় প্রত্যেক গ্রামেরই আদিবাসী মাহাত নির্বিশেষে করম পরবের বড়ো মর্যাদা দেয়। হরে রঘুনাথ, তাঁতরি না করমাটাড় কোথাকার বিটি ছেল্যারা এ গীত ভালো করে বটে? আদিবাসীদেরই বা কে আছে, জানিস কি নাই? হামারতো মেলাদিন ইসব শোনা হয় না।' 


ঝিঙাফুলের কলি
মিহির সেনগুপ্ত

প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী

মুদ্রিত মূল্য : ৪৫০ টাকা


Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।