শেষ মৃত পাখি।। শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য।।

সুপ্রকাশ প্রকাশিত শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের উপন্যাস 'শেষ মৃত পাখি' পড়ে লিখেছেন অরিজিৎ ব্যানার্জী। আমরা তাঁর অনুমতি নিয়ে নিজেদের টাইমলাইন থেকে শেয়ার করছি।
........................................................................................
সাল ১৯৭৫ – দার্জিলিং-এ খুন হলেন তরুণ কবি অমিতাভ মিত্র। সন্দেহের তীর ছিল তাঁরই বন্ধু, রহস্যকাহিনী লেখক অরুণ চৌধুরীর দিকে। কিন্তু সাক্ষ্যপ্রমাণে প্রচুর অসঙ্গতি থাকার দরুণ অরুণবাবুর বিরুদ্ধে কিছু প্রমাণ করা গেল না, বেকসুর খালাস পেলেন তিনি।
সাল ২০১৯ – সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমের সাংবাদিক তনয়া ভট্টাচার্য একটা ধারাবাহিক লিখছেন, ভারতের নানা প্রান্তে ঘটে যাওয়া ‘অমীমাংসিত’ খুনের কাহিনী নিয়ে। অমিতাভ হত্যারহস্য হবে তাঁর এই ধারাবাহিকের সর্বশেষ গল্প। সেইজন্য অনেক অনুরোধ-উপরোধ করে তনয়া শেষমেশ অরুণ চৌধুরীর সম্মতি আদায় করে এলেন দার্জিলিং-এ। অরুণবাবুর সাক্ষাৎকার নিয়ে চুয়াল্লিশ বছর আগে ঘটে যাওয়া এই হত্যা, এবং তার পরের ঘটনাবলী নিয়ে, একটা জমজমাট গল্প লেখার উদ্দেশ্যে।
তনয়া কি পারবেন সত্যিটা বের করতে, ঘটনার এত বছর পরে?
উপরে উল্লিখিত দুটো অনুচ্ছেদে যতটুকু বললাম, , “শেষ মৃত পাখি” বইয়ের ব্লার্ব এবং ব্যাককভার পড়েই এটুকু জানা যাবে। তাহলে প্রশ্ন হল – উপন্যাসের ৪০৩ পাতা জুড়ে, কি এই সত্যের অন্বেষণই আছে? এতবড় রহস্যকাহিনী পড়তে বোর লাগবে না?
উত্তর হল – না, লাগবে না, অন্তত আমার তো লাগেনি। জাত রহস্যগল্পের মতনই ঠাসবুনোটে গল্পটি বুনেছেন লেখক, যার পরতে-পরতে উন্মোচন হয়েছে রহস্যের। এতে গল্প তো আছেই, গল্পের মধ্যেও আছে একটা গল্প, এবং এই দুই গল্পের গোলকধাঁধাঁয় পড়ে পাঠক হিসেবে বেশ মজা পেয়েছি, এবং স্বীকার করতে বাধা নেই, মস্তিস্কের ব্যায়ামও হয়েছে কিঞ্চিৎ।
বইটা পড়তে পড়তে, শাক্যজিতের ওপরে মাঝে মাঝেই খুব রাগ হয়েছে। ঠিক যখন ভেবেছি যে এইবার…এইবার ধরে ফেলেছি আসল ব্যাপারটা, শাক্যজিৎ পুরো ব্যাপারটা গুলিয়ে দিয়েছেন মাত্র দু-তিনটে বাক্য ব্যবহার করেই। ঘটনাটা অনেকটা এরকমঃ টুকরো টুকরো অংশ জুড়ে জুড়ে একটা ইমারত খাড়া করা হল, কিন্তু হঠাৎ লেখক দেখিয়ে দিলেন যে ইমারতের গঠনটা, পুরো ভুলে ভরা, প্রচুর ফাঁকফোঁকর রয়ে গেছে সেখানে। হাল্কা টোকায় পুরো কাঠামো ভেঙ্গে চৌচির হয়ে যাচ্ছে।
অতএব, আবার কেঁচে গণ্ডূষ!
এই ব্যাপারটা শাক্যজিৎ বারেবারে ঘটিয়েছেন এই উপন্যাসে। কিন্তু তাঁকে দোষ দেওয়া যায়না, কেননা সমস্ত সূত্র তিনি সামনে ফেলে রেখেছেন, পাঠক আমি চলতে চলতে সেগুলো দেখেছি, অনেক সময় সেগুলোর সদ্বব্যবহারও করেছি, কিন্তু খানিক বাদেই দেখেছি যে আমি ভুল, একই সূত্র অন্য ভাবেও ব্যাখ্যা করা সম্ভব!
শাক্যজিৎ রাশিবিজ্ঞানী, অতএব রাশিবিজ্ঞানের ভাষায় বলতে হলে, কোভ্যারিয়েটের সূক্ষ্ম তারতম্য ঘটিয়ে তিনি কনভার্জেন্স ক্রাইটিরিয়া (convergence criteria) বদলে বদলে দিচ্ছেন, ফলে একই ঘটনার নানাবিধ ব্যাখ্যা সামনে আসছে, এবং সবকটাই সমান সম্ভবপর মনে হচ্ছে।
এই যে খেলা, রহস্যকাহিনীর এটাই তো মূল আনন্দ। পাঠক হিসেবে গত এক সপ্তা ধরে দারুন উপভোগ করেছি এই খেলাটা। গতকাল রাত্রে বইটা শেষ করে তাই, বেশ ফাঁকা ফাঁকাই লাগছে।
এ তো গেল বইয়ের একটা দিক। বইটাকে ভাল লাগার আরো দুটো অন্তত কারণ আছে। প্রথমটা হল, দার্জিলিঙয়ের প্রাকৃতিক বর্ণনা। বর্ষার যে রূপ লেখক বর্ণনা করেছেন মাঝে মাঝেই, সেটা পড়ে ভীষণ ভাল লেগেছে, এবং খানিকটা মানসভ্রমণও করে নিয়েছি সেই ফাঁকে।
দ্বিতীয় দিকটি হল, সত্তরের (নাকি গত শতাব্দীর সাতের দশক বলাটা ঠিক?) দশকের বাংলা কবিতা। শাক্যজিৎ যে কবিতার একজন একনিষ্ঠ পাঠক, সেটা বোঝা যায় তাঁর কবিতার ব্যবহারে। কত নামী-অনামী কবির কবিতার স্তবক তিনি তুলে এনেছেন উপন্যাসের নানা অধ্যায়ের প্রারম্ভে। সেসব কবিতা পড়াটা আমার কাছে নতুন, এবং তার রেশ ধরে ইন্টারনেট ঘেঁটে আরো কিছু কবিতা পড়া হল, সেটাও একটা লাভ তো বটেই। কবিতাগুলো পড়ে তৎকালীন বাংলা সাহিত্যের যে রাগী প্রতিবাদী মেজাজটা, সেটা খুব সুন্দর ধরা গিয়েছে।  এছাড়া বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বনাম লিটল ম্যাগাজিনের যে চিরাচরিত দ্বন্দ্ব, সেটাও বেশ পরিষ্কার বোঝা গেছে জায়গায় জায়গায়। “সুনীল গাঙ্গুলির দিস্তে দিস্তে লেখা/কত কবি মরে গেল চুপি চুপি একা একা” লাইনটা আবার মনে পড়ে গিয়েছিল আমার।
সব মিলিয়ে, বেশ ভাল কাটলো গত সপ্তাহটা – তনয়ার সহকারী হয়ে দার্জিলিং ঘোরা হল, জমজমাট রহস্য দেখা হল, কবিতা শোনা হল, বুদ্ধির গোড়ায় খানিক শান দেওয়া গেল – পাঠক হিসেবে আর কী চাই? 
“গুরুচন্ডা৯’-র সুবাদে শাক্যজিতের লেখালেখি আগে কিছু পড়া ছিল, তবে এত বড় আকারে উপন্যাস তিনি আগে লেখেননি। প্রথম প্রচেষ্টা হিসেবে অনেক সাধুবাদ তাঁর প্রাপ্য, আরো লিখতে থাকুন এরকম পুষ্টিকর লেখা, এই আবদার রইলো তাঁর কাছে।
সবশেষে “সুপ্রকাশ”কে ধন্যবাদ, এত সুন্দর একটা বই প্রকাশ করার জন্য। মুদ্রণ প্রমাদ আছে, তবে খুবই সামান্য। সৌজন্য চক্রবর্তীর প্রচ্ছদ, বরাবরের মতনই, অনবদ্য।
পাঠ চলতে থাকুক। 🙂 
বই – শেষ মৃত পাখি
লেখক – শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য
প্রকাশক – সুপ্রকাশ
মূল্য – ৫২০ টাকা

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।