অলৌকিক বাগান।। শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য।।

".....গত চল্লিশ বছর ধরে নিত্যময়ী এখানে তাঁর পূর্বপুরুষের আশ্রয় পেয়ে এসেছেন। ঘনরাম সামন্ত একটি গোসাপের রূপ নিয়ে যখন এসেছেন, নিত্যময়ী তাঁর চোখ দেখে চিনতে পেরেছেন আর একটি প্রণাম তখন গড়িয়ে গিয়েছে তাঁর বিষয়ী কৃতাঞ্জলির থেকে। নিধিরামকে বুঝে নিয়েছেন বেজি শরীরের আঁশগন্ধে। মা, স্বর্গীয়া ভুবনমোহিনীকে দেখেননি কি? নিত্যময়ী জানেন, অন্তঃপুরচারিণীরা ওভাবে সামনে আসেন না। তাঁরা আমের বউলের মধ্যে সারা দুপুর লুকিয়ে থাকেন, শালিখের চোখের মণির ভেতর ঢুকে গিয়ে শীতঘুম দেন, অথবা বর্ষার বিকেলে কেউটের আঁশে সেঁধিয়ে কাকচক্ষু জলের মধ্যে জল হয়ে গিয়ে পদ্মপুকুরে ভেসে বেড়ান অলস।

আজ এই অন্ধকার বাগানে ঘুরতে ঘুরতে শিখার মনে হলো, নিত্যময়ী সেই ধারাপাতের এক অখণ্ড। শৈশব থেকে হার্টের রোগ থাকার কারণে কখনো বিয়ে হয়নি নিত্যময়ীর। তার উপর কুরূপা ছিলেন, বসন্তরোগের চিহ্ন হিসেবে মুখমণ্ডলের কিছু গভীর ক্ষত, এবড়োখেবড়ো দাঁত, কুতকুতে চোখ নিয়ে তিনি একটি বজ্রাহত শিরিষগাছ, যার পরিমণ্ডলে অপর কোনো যোগ্যতর বৃক্ষ বাড়তে পারেনি। তাঁর সঞ্চয়ের মধ্যে একমাত্র ছিল বাপ-মায়ের আদর, যেটুকু মৃত, তবু যেন হাড়গুঁড়ো আর খোল ভেজানো জল দিয়েই চলেন নিস্ফলা ডাঙায়। নিত্যময়ী একটা একটা করে গাছের কাছে যাচ্ছেন, তীক্ষ্ণ চোখে দেখছেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে, কখনো হয়ত অল্প ছাল তুলে চামড়ায় ঘসে নাকের কাছে হাত এনে গন্ধ শুঁকছেন, তারপর এগিয়ে যাচ্ছেন। পেছনে পড়ে থাকছে একটি হাত বোলানোর নরম স্পর্শ। শিখার একটু ভয় লাগছে, কারণ সাপখোপ নিত্যময়ীর হতে পারে, কিন্তু তার বাপ ঠাকুরদা তো আর নয়! নিত্যময়ী ঘুরতে ঘুরতে প্রশ্ন করলেন, 'তোদের বাচ্চা কাচ্চা হয় নে কেন রে? পেট এঁটে বসে আছিস নাকি? ছয় বছর তো বিয়ে হতে চলল।'

‘সংসারের হাল তো জানেন। বাচ্চা হলি খাওয়াব কী?' হালকা হাসল শিখা। তার ঊনত্রিশ বছরের রোগা পিঠে তখন শিরশিরে হাওয়া লাগল।

‘তাতে কী হলো। বাচ্চা এলে খাবার জুটে যায়। কত গরীবগুর্বো গণ্ডায় গণ্ডায় নামিয়ে ফেলল, আর তোরা বুঝে ফেলেছিস সব।' আবছা অন্ধকারে নিত্যময়ীকে পুরোটা বোঝা যায় না, যেন অর্ধেক মানবী, যার হাত মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে তিরতিরে। ‘বাচ্চাকাচ্চা না হলে শান্তিজলটুক পাবি কোথা থেকে গো?'

'ইহজন্মই কাটল নি মাসিমা, আবার আত্মার কথা ভেবি কী করব! আমরা গরীব মানুষ, সংসার বাড়াতে গেলি অনেক ভেবেচিন্তে পা ফেলতি হয়।'

আকন্দের ঝোপের কাছে গিয়ে চোখ বুজে শ্বাস নিলেন নিত্যময়ী। ‘কত ফুল ফুটে আছে দেখ। নিজের হাতে কলার খোসা আর ডিমের খোল ভেঙে মেশাতাম মাটিতে। লকলক করছে এখন।' বাতাসে যেন কীসের গন্ধ, এক খবর এ চরাচরে, নিত্যময়ীর আকন্দ-কাঁঠালিচাঁপা-বুনোকুল-মহানিম গর্ভবতী হয়েছে। আসছে বছর অফলা শেকড়ে তর্পণ দেবে দামাল ঝাঁকড়া সন্তানেরা। শিখা একটু দূরে দাঁড়িয়ে সাবধানে বলল, ‘মাসিমা, এবার চলে আসেন। রাত বাড়তেছে।' 

অলৌকিক বাগান
শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য 

প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী

মুদ্রিত মূল্য : ২০০ টাকা

#সুপ্রকাশ


Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।