কীর্তনীয়া।। সমরেন্দ্র মণ্ডল।।

'রাত কত ঠাহর হয় না। এখন দেওয়াল ঘড়িতে আর ঘণ্টা বাজে না। ঘণ্টা খাটের তলায় গড়াগড়ি খাচ্ছে। ধুলোও জমে গেছে হয়তো। দেওয়ালে ঘড়িটা শুধু টিকটিক করে। ঘুম আসছে না রাফায়েলের। এমনিতেই ঘুমোতে কষ্ট হয়। বারান্দায় রঙের কৌটো থেকে গন্ধ ভুরভুর করে ঘরময় ছড়িয়ে পড়ে। উঠোনে বারান্দার দেওয়াল ঘেঁষে দুটো সাইনবোর্ড দাঁড় করানো আছে। আজকেই শেষ করেছে। আগেও এমন রঙের গন্ধ আসতো। তবে একটু কম। বড়ো উঠোন ছিল তখন, একধারে কৌটোগুলো রেখে পলিথিন চাপা দিয়ে রাখত। এখন আর উপায় নেই। যাদবের ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়ে সে নিজেই হাঁড়ি পৃথক করে দিয়েছিল। তারপর যাদব একদিন লোকজন ডেকে, আমিন দিয়ে মাপ করে সীমানা ভাগ করে নিল, বেশিটাই নিল। একটা বড়ো ঘর, রান্নাঘর, বাথরুম, স্নানঘর সব যাদব নিয়ে নিল। রাফায়েলের ভাগে শুধু একটা ঘর আর উঠোনের এক টুকরো। সাব্যস্ত হলো যদ্দিন না রাফায়েল নিজের কলঘরের ব্যবস্থা করছে, তদ্দিন যাদবেরটাই ব্যবহার করবে। অবশ্য রাফায়েল বেশি দেরি করেনি। দিন পনেরোর মধ্যেই উঠোনের শেষ মাথায় কলঘর তৈরি করে নিয়েছিল। তারপরেই যাদব পাঁচিল তুলে দিল। অ্যাদ্দিন তা-ও বা মুখ দেখতে পেত ভাইয়ের, রেবেকার; এবার থেকে তাও বন্ধ।

রাতের বেলা গুমরে গুমরে কাঁদে সে। সংসার ভাগ হওয়ার জন্যে যতটা, তার চেয়েও বেশি যাদবের জন্যে। অথচ বাবাকে যেদিন সে বিয়ের কথাটা বলেছিল, সে-ই তো নিজের ঘাড়ে সব দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছিল। একটা পয়সা যাদবের খরচ হয়নি। বাবা রিটায়ার করার পর যা পেয়েছিল, তার অনেকটাই খরচ হয়ে গিয়েছিল বাবার চিকিৎসায়। শেষের দিকে বাবা আর ব্যঙ্কে যেতে পারত না। ডাক্তারের সার্টিফিকেট, কোর্টের এফিডেভিট, নানা কাণ্ড করে রাফায়েলকে ব্যাঙ্ক অনুমতি দিয়েছিল টাকা তোলার। তাও ব্যাঙ্কের লোক এসে বাবাকে দেখে যাওয়ার পর টাকা দিত। ব্যাঙ্কের কথাতেই শেষমেষ রাফায়েলকে নমিনি করেছিল। বাবা মারা যাবার পরেও ঝামেলা মেটেনি। কত কাগজপত্র সই সাবুদ করার পর রাফায়েল টাকা পেয়েছিল। কতই বা, হাজার দশেক মতো পড়েছিল। বাবা মারা যাবার পর পেনশনের টাকা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ব্যাঙ্ক থেকে টাকাটা তুলে এনে যাদবকে ডেকে বলল, এই দ্যাখ বাবার ব্যাঙ্কের বই। শেষ যেটুকু টাকা ছিল তুলে এনেছি।

রাফায়েল ব্যাঙ্কের বই আর টাকা যাদবের সামনে রেখে দিল। বলল কী করবি বল।

যাদব ব্যাঙ্কের বই খুলে ভালো করে দেখে বইটা ছুঁড়ে দিল রাফায়েলের দিকে। ব্যাজার মুখে বলল, বাপ সব টাকা তুলে খরচ করে ফেলেছে!

রাফায়েল মৃদু স্বরে উত্তর দিল, তোর বিয়ের সময়েই তো চল্লিশ হাজার টাকা তোলা হয়েছে।

- তাহলে ডাঁট দেখিয়ে বলেছিলি যে, তুই সব খরচ করবি।

- কত খরচ হয়েছে সে জ্ঞান আছে? চল্লিশ হাজার টাকায় সব হয়ে যেত? একবার হিসাবটা করিস।

-আমার দরকার নেই হিসেব করার। টাকাটা আমায় দে। তোর তো সংসার-টংসার কিছু নেই। টাকা কী করবি?

উদাস স্বরে রাফায়েল বলল, নে।

কথাটা বলে সে উঠে যাচ্ছিল, ঠিক সেই সময় রেবেকার স্বর শুনলো, বটঠাকুর তো আদ্দেক পাবে। তুমি ঠকাচ্ছো কেন?

যাদব ঘাড় ঘুরিয়ে বউয়ের দিকে তাকিয়ে ঝাঁঝিয়ে উঠল, ফ্যাচ ফ্যাচ কোরো না তো। আমার ব্যাপার আমি বুঝবো, তোমায় ক্যাদ্দানি মারতে হবে না।

কথাটা বলেই সে টাকা গুনতে শুরু করল। তারপর দু হাজার টাকা মেঝেয় রেখে বলল, ঠিক আছে, এই দুই রাখ। আমি আট নিলাম।

যাদব টাকা আর ব্যাঙ্কের বই নিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে গেল।

তখনও আড়াআড়ি ভাগ হয়নি। হাঁড়িও আলাদা হয়নি। রেবেকাই রান্না করত। রাফায়েল এসে শুধু খেয়ে যেত। খুব যত্ন করত রেবেকা। সে-ও তার কপালে সইল না। হয়তো এই বটঠাকুরকে একটু বেশি খাতির করত, হেসে দুটো কথা বলত, যাদবের সেটা সহ্য হলো না।

এক রাতে মদ গিলে এসে রেবেকার উপর চোটপাট করছিল। অকথা- কুকথার বান ছোটাচ্ছিল। রাফায়েল শুনতে পেয়ে ওর ঘরের সামনে গিয়ে ধমক দিয়েছিল, এই যাদু, কি করছিস কী। মাঝরাতে নাটক করছিস? বাড়ির মান-সম্মান আর কিছু রাখলি না। বাপ ঠিকই বলত, একটা অমানুষ, কুলাঙ্গার।

যাদব রাফায়েলের মুখের সামনে আঙুল তুলে বলল, চোপ। আমার ঘরের ব্যাপার। তুই চোপ। অ্যাই, অ্যাই শাল্লা, আমার বউয়ের দিকে চোক! দিল্ল্যাগি। চোখ গেলে দেব।

-কী বলছিস কী! তোর কাণ্ডজ্ঞান আছে?

পাশ থেকে রেবেকা বলল, ও কী অকথা কুকথা বলছ? অমন সন্ন্যোসীর মতো মানুষটার সামনে অমন কতা বলতে পারলে!

অ্যাই চোপ। সন্নোসী? হি হি হি। সন্ন্যোসী না ছাই। অ্যাই তোকে অ্যাতো খাতির করতে হবে না। যাহ্।

রেবেকা হাঁ করে স্বামীকে দেখতে থাকে। নতুন মানুষ মনে হয়। রাফায়েল আর কথা বাড়ায়নি। নিজের ঘরে চলে আসে। আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ে। ভাবে, কী করে যে যাদব এমনটা হয়ে গেল কে জানে! অথচ ছোটোবেলায় কত ভালো ছেলে ছিল। মা একটু বেশিই ভালোবাসতো। পড়াশুনোতেই মন্দ ছিল না। ওর থেকে বছর দুয়েকের ছোটো। তবে গান-বাজনায় কোনওদিনই মন ছিল না। বরং খেলাধুলো ভালোবাসত। বিকেল হলেই ছুটত ক্লাবের মাঠে। তখন যুবক সংঘের খুব নাম। বাবাও খুশি ছিল। বলত, খেলাধুলো করলে শরীর-স্বাস্থ্য মন সবটাই ভালো থাকে।

রাফায়েল বরং ঢলে পড়েছিল গানের দিকে। কীর্তনের মহড়ায় সে গিয়ে বসত। গলা মেলাতো। দলের সঙ্গে গাইতে গাইতে কত গান যে গলায় তুলে নিয়েছিল। মাঝে মাঝে বাবা ওকে মূল গায়েনের দায়িত্ব দিত। বলত, আজ তুই গান ধর।

ভাঙা হারমোনিয়াম ধরে সুর তুলে দিত, রাফায়েল ধরত গান। অনেকদিন বাবা ওকে আলাদা করে তালিম দিত। ভুল হলে শুধরে দিত। কীর্তন গাইয়েদের গল্প চলত। একবার এক ডাকাতের গল্প বলেছিল। প্রাণধন না কী যেন নাম, সে কীর্তনও গাইত, আবার ডাকাতিও করত। একবার এক জমিদার বাড়ি ডাকাতি করবে বলে চিঠি পাঠাল। সে যুগে ডাকাতরা চিঠি দিয়ে ডাকাতি করত। তা প্রাণধনও চিঠি দিল। জমিদারবাবু তার লেঠেল, বরকন্দাজ সবাইকে ডেকে পাহারা দিতে বলল। নিজেও তার দু-নলা বন্দুক পরিষ্কার করে গুলি ভরে রেডি করে রাখল। ডাকাত এলেই গুলি ছুঁড়বে। থানাতেও খবর দেওয়া আছে। ঠিক সময়ে পুলিশও চলে আসবে। চিঠি দিয়ে জানিয়েছে রাত দশটায় তারা আসছে। সবাই তটস্থ। যে করেই হোক, ডাকাতদলকে কাবু করতে হবে।

সন্ধে উতরাতেই ভেসে এলো গানের সুর। একদল কীর্তনীয়া গান গাইতে গাইতে এগিয়ে আসছে। জমিদার বাড়ির সবাই দোতলা থেকে নেমে এলো। কীর্তনের দল জমিদার বাড়ির সদর দরজায়। জমিদার বাবু দারোয়ানকে বললেন, দরজা খুলে দাও।

সদর খুলে যেতেই কীর্তনের দল উঠোনে এসে দাঁড়াল। গাইতে গাইতে তার ভিতরে ঢুকল। আহা কী গান! মূল গায়েন যেমন লম্বা, তেমনি চওড়া। ফর্সা দেখতে। আহা, সুর তো, নয়, যেন মধু ঝরে পড়ছে গলা দিয়ে। সকলে বিভোর হয়ে গেল গান শুনে। যে দুজনে খোল বাজাচ্ছিল, তাদের আঙুল যেন কথা বলে। কতক্ষণ যে গাইল, সে খেয়াল নেই কারো। গান থামতেই গর্জে উঠল বন্দুক। কীৰ্তনীয়া হাত জোড় করে বলল, বাবুমশাই এবার আপনারা ওপরে যান।

জমিদার ওপরে গিয়ে দেখল তার দেরাজ খোলা। হাতড়ে দেখল সব টাকা পয়সা ফাঁকা। বাড়ির গিন্নিও দেখল তার আলমারি থেকে গহনার বাক্সটাও উধাও। তাড়াতাড়ি সবাই নিচে নেমে এলো। দেখল কোথায় সেই কীর্তনের দল! সব হাওয়া।

খবর শুনে গাঁয়ের লোকেরা হাজির। মুরুব্বিরা নানা কথা বলে। সবাই বুঝতে পারল, এ সেই প্রাণধন ডাকাতের কাজ।

ছোটবেলায় বাবার কাছে শোনা গল্পটা আজও সে ভোলেনি। এই বয়সেও বেশ মনে আছে।। শুয়ে শুয়েই ভাবে, সেই যে বাপের কাছে গানের নাড়া বেঁধেছিল, তার মধ্যেই সে ডুবে গেল। এখন তো শুধু কীর্তন নয়। পালা গানও করে। খ্রিস্টকীর্তন তো কতজনই গায়। এখন তো বাউলও গাইছে। গেরুয়া পরে খ্রিস্টবাউল আসরে আসে খমক কিংবা দোতারা নিয়ে। পিছনে অবশ্য কী-বোর্ড, গিটার, অক্টোপ্যাড নিয়ে বাজনদাররা বাজিয়ে যায়। এদের গানে ভক্তি নেই, আবেগ নেই, শুধু দেখনদারি, আর খ্রিস্টকে নিয়ে ব্যবসা করা। মনে মনে রেগে যায় রাফায়েল। বাপ নিরু বিশ্বাস বলেছিল, যিশুকে নিয়ে ব্যবসা কোরো না বাপ। মনে রেখে খ্রিস্টকীর্তন মানে যিশুর মহিমা গান গাইছ। ভক্তি আর আবেগ না থাকলে যিশুর গান গাওয়া যায় না। হাজার রকমের বাজনা দিয়ে মানুষের মন ভোলানো যায়, ঈশ্বরের কথা বলা যায় না। ঈশ্বর শুধু তোমার গানটাই শুনবে, বাজনা নয়। তোমাকে তিনি সুর দিয়েছেন নিজের মহিমা শোনার জন্যে, এটা মনে রেখো। যেদিন গলা থেকে সুর হারিয়ে যাবে, ছেড়ে দেবে। কীর্তনের জাত মেরো না।

বাবার কথাগুলো আজও সে মাদুলির মতো হৃদয়ে ধারণ করে আছে। সে শুধু প্রার্থনা করে, প্রভু আমি যেন হড়কে না যাই। সেজন্যই সে এখনও হারমোনিয়াম, খোল, করতাল নিয়ে গান গেয়ে বেড়ায়। কোনও কোনও কীর্তন দল গলায় ক্যাসিও ঝোলায়। কিন্তু রাফায়েলের তাতে মন ওঠে না। একবার তো একটা দলে ক্যাসিওর সঙ্গে ব্যাঞ্জো বাজাতেও দেখেছিল। মন্দ লাগছিল না। কিন্তু রাফায়েলের মনে ধরল না। তার মনে হয়েছিল, গান আগে যাবে, না বাজনা আগে যাবে তাই নিয়েই লড়াই শুরু হয়েছে। রাফায়েল দলে এসব ঢুকতে দেয়নি। দল তো তার নয়। দল নিরু বিশ্বাসের। এই নামেই দল চলছে। গাড়ি চালাচ্ছে নিরু বিশ্বাস, সে শুধু বহন করে নিয়ে চলেছে।...'


কীর্তনীয়া
সমরেন্দ্র মণ্ডল

প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী 
মুদ্রিত মূল্য : ২৪০ টাকা

#সুপ্রকাশ 


Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।