অনন্যবর্তী।। দুর্লভ সূত্রধর।।

সুপ্রকাশ প্রকাশিত দুর্লভ সূত্রধরের উপন্যাস ' অনন্যবর্তী ' পড়ে লিখেছেন শুভদীপ চক্রবর্ত্তী। আমরা তাঁর অনুমতি নিয়ে নিজেদের পেজ থেকে শেয়ার করছি।
...................................................

পরীক্ষার রেজাল্ট। বন্ধুদের বেতালা ছড়ার মাঝে একবগ্গা কিছু সাইকেলের হিপ-হিপ-হুররে। বরাবর উন্নাসিক ফার্স্ট বেঞ্চের উদ্বেগ থেকে তফাতে থাকা সেই বড় হয়ে ওঠার বেলা। আর বিকালের কাদা মাঠে বাঁক নেওয়া ফ্রিকিক গোলে ঢোকার ঠিক আগেই বন্ধুর বোনের কথা মনে পড়তেই, বুকের কোন দিকটা ব্যথা করে ওঠে যেন? 

আবার রেজাল্ট! এক জীবনে কতই যে পরীক্ষা! তাতে উতরে গেলেই, বন্ধুর মতোই খুশি যেন বন্ধুর বোনও! অথচ এই কাহিনী কোনও নিছক বাল্য প্রেমের কাহিনী নয়। সেই লেখা লিখতে চেষ্টাই করেননি লেখক। বরং নিরন্তর এক দোটানার মধ্যে নিয়ে বেড়িয়েছেন তিনি পাঠককে। সেই দোটানা কখনও আচমকা বড় হয়ে যাওয়া ছেলের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েও কথা খুঁজে না পাওয়া বাবার, কখনও সংসারের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে স্ত্রীর সম্মান রাখতে চাওয়া স্বামীর, কিংবা কখনও যৌথ পরিবার ভাঙতে ভাঙতে দুটো ব্যবধান বেড়ে যাওয়া প্রজন্মের, এবং অবশ্যই রাজনীতির।

তবু এরকম তো খুব বেশি হয় না, যেখানে একটা কাহিনী পড়তে পড়তে মনে হয় যে, আমাদের বড় হওয়াটাও যদি এরকম ভাবে হতো? বিভূতিভূষণের অপু বা অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সোনাবাবুর ছোট থেকে বড় হয়ে ওঠার যে যাত্রাপথ, সেই যাত্রাপথে তো সামিল হতে চেয়েছি আমাদের মতো আরও অনেকেই। আর তার বহুদিন পরে দুর্লভ সূত্রধরের লেখা ‘অনন্যবর্তী’ উপন্যাসের এই ছোট থেকে কৈশোরে এগোতে যাওয়া চরিত্রগুলো কোথাও যেন আমাদেরকেও টেনে নিয়ে গেল তাদের সেই রাস্তায় হাঁটার পথে সামিল হতে।

একটা নদী। একটা ছোট রেলস্টেশন। ঘুপচি বাস স্ট্যান্ড। চায়ের দোকান। এবং এইসব ঘিরে গড়ে ওঠা একটা জনবসতি। এই সবই তো ভীষণ পরিচিত দৃশ্য নদীকেন্দ্রিক যে কোনও মফস্বলেই। কিন্তু সেই মফস্বলের গল্পই যেন আলাদা হয়ে যায় দুটো ভিন্ন দেখার চোখ, আর একটা সহজ-সরল লেখনশৈলীতে। মধ্যবিত্ত থেকে নিম্ন-মধ্যবিত্ত কিছু পরিবারের ছেলেমেয়েরা বড় হচ্ছে একসঙ্গে; বড় হচ্ছে তাদের শারীরিক মানসিক নানাবিধ জটিলতা নিয়েই। এবং পড়াশোনার সঙ্গে সঙ্গেই তারা যে শুধু প্রেমেই পড়ছে তা নয়, বরং যাবতীয় অনভিজ্ঞতা নিয়েও জড়িয়ে পড়ছে রাজনীতিতেও। এবং তাদের এই আপাদমস্তক বদলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কোথাও যেন বদলে যাচ্ছে তাদের পূর্বপুরুষদের পথচলাও। ‘অনন্যবর্তী’ শুধুই একদল কিশোর-কিশোরীদের গল্প নয়, এই গল্পে প্রবলভাবে উপস্থিত তাদের বাবা-মায়েরাও। সেই বাবা-মা, যাঁরা কখন যেন হয়ে উঠেছেন আমাদের চারপাশের চেনাজানা অভিভাবকদের মতোই। এখনও অনেকটা বয়স বেড়ে যাওয়ার পরেও যে মানুষগুলোকে দেখলে সিগারেট লুকিয়ে নিতে হয় হাতের মুঠোর তলায়, ঠিক সেরকমই যেন।

এবং একটা সময় ধাক্কা খেতে খেতে এই সমস্ত চরিত্রেরা একটা সময় খুঁজে নিচ্ছে ঠিক নিজেদের বিকল্প একটা মাথা তোলার জায়গা। বামপন্থী রাজনীতির গড়ে ওঠা এবং ক্ষয় কোথাও যেন প্রবল ভাবে বাসা বেঁধে বসেছে এই আখ্যানের আনাচে-কানাচে। ফলে প্রবল ভালবাসায় তৈরি হওয়া একটা সান্ধ্য স্কুলের ভিতরে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা রাজনীতি যেন চারপাশটাকে আরো খুঁটিয়ে, আরো সন্দেহের চোখে দেখতে শিখিয়ে যাচ্ছে পাঠকদের। সেখানেই হাতে হাত রাখার গল্প যেমন তৈরি হচ্ছে, তৈরি হচ্ছে অনেক দিনের বলতে চাওয়া কিছু কথা কিছুতেই বলতে না পারার মতো অব্যক্ত ব্যথা, ঠিক তার পাশে-পাশেই একটা বিশ্বাস ভাঙার গল্পও যেন চুপচাপ বলে চলেছে শুধু প্রেম নয়, বরং রাজনৈতিক অবক্ষয়ের কথাও।

আর ঠিক তার পরেই যখন এই গল্পের বড়রা তৈরি করছে একটা আলাদা জমি, সেই জমি তো শুধুই মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়ে থাকছে না আর। সেই জমি হয়ে উঠছে প্রতিবাদের একটা বিকল্প ভূমি। আইনি সহায়তা কিংবা বিনামূল্যে চিকিৎসা দান যেন দেখিয়ে দিচ্ছে রাষ্ট্রের ব্যর্থতার মাঝে সাধারণের আরো মানবিক হয়ে ওঠার গল্প। আর আমরা ভীষণ চাইছি সেই জমিতে পা রাখতে একবার। ভীষণ চাইছি সেই অভিভাবকদের ছাতার নিচে গিয়ে দাঁড়াতে। চাইছি সেই সব ছেলে-মেয়েগুলোর বন্ধুত্ব যেন অটুট অমলিন থাকে এভাবেই আজীবন। এবং চাইছি শোভন আর টুকুর কচি কলাপাতার মতো সবুজ মনদুটোও যেন এক হয়ে যায় একদিন। আর, কাজুর সঙ্গে টুকুর দাদা তনয়ের প্রেমটাও হয় যেন, শালিক ঠাকুর! পিপুটা যেন সংসার করে সুখে! এরা কারা? তার হদিশ পাওয়া যাবে এই অসময়ে দাঁড়িয়ে একটা অন্যরকম মন ভাল করা আখ্যান ‘অনন্যবর্তী’তে। আর এই অপরূপ আখ্যানের রূপকার যিনি, সেই সূত্রধর কিন্তু আক্ষরিক অর্থেই দুর্লভ!

এই দুঃসময়ে মাথা তুলে দাঁড়াবার মত একটি আখ্যান ‘অনন্যবর্তী’।

.

অনন্যবর্তী | দুর্লভ সূত্রধর
প্রচ্ছদ ও অলংকরণ : সৌজন্য চক্রবর্তী
প্রকাশক : সুপ্রকাশ


Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।