ঝিঙাফুলের কলি।। মিহির সেনগুপ্ত।।

'বাঁশরি গান শুরু করার আগে কিছু প্রাসঙ্গিক বক্তব্য নিবেদন করে এবং তা পরিষ্কার মানবাংলাতেই। অত্যন্ত বিনম্রতার সঙ্গে সে বলে 'পারিবারিক পরম্পরায় আমি ধর্মমতে ইসাই। কিন্তু সেটাই আমার একমাত্র বা প্রধান পরিচয় নয়। আমার সাংস্কৃতিক পরিচয়ে আমি ঝাড়খন্ডি। রক্ত, ভাষা এবং গোষ্ঠীগতভাবে আমি মুন্ডারি গোষ্ঠীর মানুষ। সম্ভবত সে কারণেই পৃথাদিদি আমাকে শুরুটা মুন্ডারি ভাষার একটি গান দিয়ে করতে বলেছেন। অবশ্যই তা আমি করব। তবে যে এলাকাটিতে আজকে আমাদের আসর, সেখানে মুন্ডারি ভাষাভাষী স্ত্রী-পুরুষ খুব কমই উপস্থিত বলে আমার বিশ্বাস। এখানে বেশির ভাগ ঝাড়খন্ডবাসীই কুর্মি-মাহাত। আদিবাসী মুন্ডা, কোল, সাঁওতাল এবং অন্যান্য ছোটোবড়ো গোষ্ঠীর মানুষেরা সামান্য রকমফেরে কোলীয় বা মুন্ডারি ভাষাই শিশুদের মধ্যে ব্যবহার করেন। মাহাতরা যদিও আদিবাসীদের অতি ঘনিষ্ঠ এবং সাঁগা ভাই, তথাপি তাদের সমাজ এখন ভাষাগতভাবে সম্পূর্ণ পৃথকভাবেই বিকশিত। এটা ইতিহাসের স্বাভাবিক নিয়মেই ঘটেছে। মনে হয়, আমাদের জাতি বা গোষ্ঠীগুলির যদি সম্মিলিতভাবে ভাষাকেন্দ্রিক একটি জাতি হিসেবে বিকাশ আমরা চাই, তবে একমাত্র কুর্মালি ভাষাটিই সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। কথাগুলি আমি কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলছি না, সংস্কৃতিগত বিকাশের ধারা লক্ষ করে আপনারা নিশ্চয় তার তাৎপর্য বুঝতে পারছেন। অবশ্যই তার মানে এই নয় যে সে কারণে কোলীয় ভাষা থেকে উদ্ভূত ভাষাগুলি সেক্ষেত্রে অবহেলিত থাকবে। কুর্মালির সুষ্ঠু বিকাশের জন্য এখানকার সব ভাষারই অবদান স্বীকার করে নিতে হবে। গোষ্ঠীগতভাবে সবগুলি ভাষাই সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

যা হোক, কথা না বাড়িয়ে আমি গানে গতি নেব এবার। আর একটি সংবাদ এই যে এখানে আমি একজন সহেলি পেয়েছি নতুন— কৈকেয়ী মাহাতকে। আমার দলের কেউ এখানে নেই। আমার অনুরোধে কৈকেয়ী আমার সঙ্গে গাইতে রাজি হয়েছে। মুন্ডারি ভাষার গানটা আমি একাই গাইব। এবার গানটি শুনুন,— 

'ন তো হো দুদুগর
সিরমা হো কোয়াসি
নিমিন দিগ দা— গে বা নোয়া
চিমেঁতেঁ কাগে গানাইয়া:
আষাঢ় শাঙন ময়োদরাতিহো হো বানোয়া
ভাদর গে ধরতি নোরে জানা।
চিমেঁতেঁ কাগে গামাইয়া:
সিরিমারে শিঙবোঙা ওতরে মারাঙ দেওতা
চিমেঁতেঁ কাগে গামাইয়া:
সিরিমারে শিঙবোঙা ওতরে মারাঙ দেওতা
চিমেঁতেঁ কাগে গামাইয়া
লাই রেনেন দা তেতেন
জিগে সোনাতানা”

গানটি গেয়ে বাঁশরি পৃথার হাতে একটি খাতা তুলে দেয়। সেখানে গানটির বঙ্গানুবাদ লেখা আছে। পৃথা সাধারণ শ্রোতা-দর্শকদের উদ্দেশে সেটি পাঠ করে। গতকাল বাঁশরি এ বিষয়ে আমাকে বলেছিল। পৃথা গানটির অনুবাদ পড়ে—

“শুকনো ধুলোয় আকাশ বাতাস ভরে উঠেছে। গোটা পৃথিবী জুড়ে তার ছায়া। হায় তবু বৃষ্টির দেখা নেই। আষাঢ় শ্রাবণ দুটো মাসই বয়ে গেল। তবু এক ফোঁটা বৃষ্টি পড়ল না। আষাঢ় গেল, শ্রাবণ গেল। এল ভাদর মাস – তবু বৃষ্টি এল কই? মাথার উপরে সূর্যদেবতা আর নীচে মাতা ধরিত্রী প্রতীক্ষা করে আছেন— তবু বৃষ্টি কই। খিদের জ্বালা আর তেষ্টায় ছাতি ফেটে যায়। মৃত্যু বুঝি এল, তবু বৃষ্টির দেখা নেই। হায়!’

কিন্তু বাঁশরি আর মুন্ডারি ভাষায় গাইবে না। সে ঝাড়খন্ডি সহজ লোক-ভাষাতেই পরবর্তী গানগুলো করে। কৈকেয়ীর সঙ্গে সংক্ষিপ্ত বোঝাপড়া করে নিয়েছে সে। পরবর্তী গানগুলোর ফাঁকে ফাঁকে সে কিছু কথাও বলবে বলে জানায়। কৈকেয়ী গান ধরে এবার—

“আষাঢ় শরাবণ মাসে লবীন মেঘে ঘেরলি
পানিকা বুদা না বরষে
ও পরাণ ধরম বাঁচে কেইসে?
কেমনে বাঁচে প্রাণ দারুণ আকালে
সিকি পুয়া চাউল নাহি মিলে।”

ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দুজনেই এই ক'টি কলি গায়। এ ভাষার অনুবাদ কট্টর মান বাংলাভাষীদেরকেও দেওয়ার আবশ্যক হয় না। সব গানই কৃষিকর্ম বিষয়ক এবং তার জন্য সংকটের কথা। এইসব সংকটের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে আকালের সমস্যা। তার ফলে তীব্র অভাবের খবর ক্রমশ পরবর্তী গানগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে—

‘দু একটা গুঢ়া (ক্ষেত) লাগাই ফুরাল মাইষর পৌষে
বছর দিনটা কাটে কিসে উপায় নাই হে ধারে পাশে।
রিলিফ, সড়গ্ খুলল যদি কাজ করি মেলে মেশে,
এ বছর ভাই সবাই গরীব কাজ হল্য মোট দিন দশে।
সড়গ্ ঘাটে একটাকা গম দিল তুষে তুষে
একবেলা ভাই গমে খাঁটা একবেলা খাই ময়দা থাসেঁ। 
ই বছরের আকালে গমে পিঠা সকালে
বল বল বঁধু কেলুকালে আঁচলে।
ভেড়া ছাগল বিকেঁ খালি, আর খালি মোরগ হাঁসে
ঘটি বাটি পড়ল বাঁধা এবার মরি গাছে ঘেঁসে।'


ঝিঙাফুলের কলি
মিহির সেনগুপ্ত

প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী

মুদ্রিত মূল্য : ৪৫০ টাকা

#সুপ্রকাশ 

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।