শেষ মৃত পাখি।। শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য।।

সুপ্রকাশ প্রকাশিত শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের উপন্যাস ' শেষ মৃত পাখি ' পড়ে লিখেছেন এণাক্ষী গোস্বামী। আমরা তাঁর অনুমতি নিয়ে নিজেদের টাইমলাইন থেকে শেয়ার করছি। 
..................................................

প্রীতিভাজনেষু 
সুপ্রকাশ প্রকাশনা 

                      এই চিঠি/লেখাটা পেয়ে খানিক অবাক হয়ত হবেন‌। এ চিঠি শাক‍্যজিৎ ভট্টাচার্যকে লেখা যেত। লেখা যেত অমিতাভ বা অরুণকে। ড‍্যানিয়েল লামাকে। কিম্বা সত্তরের দশককে। বাংলা কবিতাকেও লেখা যেত চাইলেই, কিন্তু তাও এ চিঠি আপনাদের প্রাপ‍্য। তার কারণ শেষ মৃত পাখি। এই শেষ পাখিটি কে বলতে পারেন? অমিতাভ? বাংলা কবিতা? নাকি এদের সমস্তর সমাহার সেই 
"অমলকান্তি-রোদ্দুরের কথা ভাবতে-ভাবতে, 
ভাবতে-ভাবতে 
যে একদিন রোদ্দুর হতে চেয়েছিল।"

আপনারা এ উপন‍্যাসের প্রচ্ছদে এঁটেছেন 'রহস‍্যকাহিনী'র তকমা। অথচ তনয়ার গল্পের খোঁজ, ড‍্যানিয়েলের ব্ল‍্যাক হর্সের খোঁজ তো এ উপন‍্যাসের মূল উপজীব‍্য নয়। আরও গূঢ় আরও অতলান্ত কিছু এ আখ‍্যান। উপন‍্যাস গড়তে যে আধার লাগে তাতে রহস‍্য আছে বটে, তবে এলিজি আর পোলিটিক‍্যাল স‍্যাটায়ারের মাঝখানে কোথাও অবস্থান করা শেষ মৃত পাখি, শুধুই রহস‍্যকাহিনী এমনটা আমি মানতে পারলামনা। বিদ্বজনেরা একে হয়ত ক্ল‍্যাসিক এলিজিতে স্থান দেবেননা, কারণ typical lament of death জাতীয় কিছুই নেই এখানে, তবুও এ উপাখ‍্যান তো তাদের যারা প্রতিভার দাম পায়নি। পায়না। 

এ উপন‍্যাস এত চিরায়ত দ্বন্দ্বের। বাজারী এবং ধুলোখেলায় পড়ে থাকা বহু না জানা গল্পের দ্বৈরথ, মহানগর বনাম জেলার যুদ্ধের। এ উপন‍্যাস রুণু গুহনিয়োগীর 'সাদা আমি কালো আমি'র। সুমন চাটুজ্জের ভাষায়; 'কত কবি মরে গেল চুপি চুপি একা একা'র। এ উপন‍্যাস সিস্টেমের প্রহসনের। না, আমি ড‍্যানিয়েল লামার কথা বলছিনা। আমি বলতে চাই, সেই গলিত শব সিস্টেমের কথা যাকে বেতালের মত পিঠে করে বয়ে চলেছি আমরা। প্রতিটি গল্পের শেষে আমাদের কাঁধে আরও, আরও জাঁকিয়ে বসছে সে। সিস্টেম, যার রদবদল চেয়ে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়ে আমাদের ছেলেরা চলে গেছে অকালে। যারা অস্ত্র ধরতে পারেনি, অমিতাভর মত তারা তুলে নিয়েছিল কলম। কিন্তু হল কৈ? বদল কী কিছু হল? হলনা, হবেনা বদল। কারণ আমরা জানি, বিশ্বাস করি, কবিরা কোনদিন হাতে বেয়নেট তুলে নিতে পারেননা। আর তাই প্রতিবাদ প্রতিরোধ সবটাই হয়ে যাক সাময়িক বা ক্ষণস্থায়ী। কখনও লামা কখনও গম্বুর হাত ঘুরে রাষ্ট্র আমাদের হাতে ধরিয়ে দেয় কাঁচকলা। আমরা আবার ডুবে যাই অন্ধকারে। চুয়াল্লিশ বছর, চুরাশি বছর, আরও সময় আরও আরও। জাতি ডুবে যায়, দেশ ডুবে যায়, সস্তার ইন্টারনেটে। দুটাকার চাল আর বুলেট ট্রেনের বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে আমরা পঙ্গু ভারতীয়। 

তনয়া আসলে সেই 'তোমাকে চাই' স্বপ্ন। 
"ছিপছিপে কবিতার ছন্দে ভাষায়;
গদ্যের যুক্তিতে বাঁচার আশায়।
শ্রেণীহীন সমাজের চির বাসনায়,
দিনবদলের খিদে ভরা চেতনায়,
দ্বিধাদ্বন্দের দিন ঘোচার স্বপ্নে
সাম্যবাদের গান ঘুমে জাগরণে…
বিক্ষোভে বিপ্লবে তোমাকে চাই,
ভীষণ অসম্ভবে তোমাকে চাই
শান্তি অশান্তিতে তোমাকে চাই
এই বিভ্রান্তিতে তোমাকে চাই।"

সেই বিপ্লবের স্বপ্ন, যে আসবে আমরা আশা করে থাকি গোটা জন্ম। যার আসার আশায় আমরা জীবন বাজি ধরি। কিন্তু বাস্তবে তনয়ারা আসেনা। আসলেও মহেশ তাকে পেছন থেকে টেনে ধরে, আনন্দ পাঠক সহায় হননা, সব সত‍্যি জেনে সিদ্ধার্থও কি সহচর হয়? বরং সব গুহ‍্যকথা নিষ্ক্রমণের আশঙ্কায় ফেলে দেয় দার্জিলিংয়ের গভীর খাদে। ওকামস্ রেজর থিওরি অনুযায়ী। সবচেয়ে সহজ পন্থায়।

শাক‍্যজিৎ বেশ কিছু অনবদ‍্য ইমেজারি ব‍্যবহার করেছেন এই উপন‍্যাসে। পৃষ্ঠা ১১: "অনেকটা দূর অবধি পথের চেহারা অনেকটা ওম পুরীর গালের মতোই এবড়ো খেবড়ো। পৃষ্ঠা: ৫১ "কবিতার সবচেয়ে কাছাকাছি যেটা, সেটাতেই গেছি। ক্রাইম কাহিনী।" এ উপন‍্যাসের ভাষার বিন‍্যাস আমাকে ওয়ান সিটিংয়ে পড়তে বাধ‍্য করেছে। প্লট, সাব-প্লট, তারও পরে মার্জিনের পাশে লেখা গলিঘুঁজি, সাধারণ গোয়েন্দা কাহিনীতে এমন সচরাচর দেখা যায়না। শেষ মৃত পাখি সেইখানেই অন‍্যরকম। 

আমার কপিটিতে প্রচুর মুদ্রণ-প্রমাদ রয়ে গেছে, যা খানিক তাল কেটেছে পড়ার গতির। এ বাদে আর কিছুই নয়। শুধু এর রেশ থেকে যাবে অনেকদিন। প্রচ্ছদের সিল‍্যুয়েট ছবিটির সাথে ভেজা দার্জিলিংয়ের বর্ণণা আমার পরের ক‍্যুইনস অব হিলস ট্রিপে আবারও নতুন করে মনে করাবে এই উপন‍্যাসকে। 

আপনাদের প্রকাশনীর সকলকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা। শুভেচ্ছা লেখক, প্রচ্ছদশিল্পীকেও। ভাল থাকুক অমিতাভ, আর অরুণ সঞ্জয়ের মত বন্ধু সক্কলকার হোক তাহলেই কুয়াশা ছিঁড়ে একদিন রোদ উঠবে দার্জিলিং টু দমন-দিউ।

                                         শুভেচ্ছান্তে
                                      এণাক্ষী গোস্বামী

শেষ মৃত পাখি
সুপ্রকাশ প্রকাশনা
ছবি: ইন্টারনেট
মুদ্রিত মূল‍্য: ৫২০₹


Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।