অলৌকিক বাগান।। শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য।।

"তিনবার করে নিত্যময়ী জল দিলেন এ পৃথিবীকে। তিনবার জগৎ নিম-শূন্যতা থেকে ত্বরিতে মুখ ফেরাল, দিল ভ্রমরের চঞ্চল, আর তিনবার নিত্যময়ী মনে মনে বললেন, “আমার দেহ নাই তবু তোমাদের স্বেদ দিলুম, আমার মন নাই তবু তোমাদের গান দিলুম, আমার কল্পনা নাই তবু তোমাদের আকাশ দিলুম। তোমরা তৃপ্ত হও।— ভূত প্রেত দেব অসুর চেতনা ও আরম্ভ, সবাই এ কোষবদ্ধ জল পান করো।”

‘নাও, কাজ শেষ হলো পিসি।' দুর্বল গলায় গণেশ বলল।

নিত্যময়ী স্বপ্নোত্থিতর মতো মুখ ফেরালেন। তারপর বললেন, ‘বাবা গণেশ, আর একটাই কাজ যে বাকি থেকে গেল। ওটাও করিয়ে দিবি গো?”

“আবার কী?”

‘আমার নিজের তৰ্পণ।’

‘মানে?’ বিস্ময়ে অভিভূত গণেশের কণ্ঠে বিভ্রান্তি, যেন শ্রান্তি তার শেষ উপজীব্য নয়, যাকে পেরিয়ে আবিষ্কার শেষ হয় না।

‘আমার তো আর কেউ নাই বাবা! আমি চলে গেলে কে জল দেবে বল! তাই নিজের তর্পণটা নিজেই করে যাব। ওই জন্যেই তো আজ আসা।’

‘এমন আবার হয় নাকি?”

“কেন হয় নে? লক্ষ্মী বাবাটি, আমার তর্পণটুকু করে যেতে দে। শুনেছি, সন্নিসীরা নাকি নিজের শ্রাদ্ধ করে গৃহত্যাগ করত। আমি পাপীতাপী মানুষ গো, অত কিছু পারব নে। শুধু মরার পরেও যেন জলটুকু পেয়ে যাই, নাহয় নিজের হাতেই হলো, ক্ষতি কী বল?”

‘কিন্তু, এমন কোনো মন্ত্র তো আমি জানি না পিসি! শাস্ত্রে নেই।'

“বেশ, আমি তবে নিজের মতো করেই করি। তুই শুধু সাক্ষী থাক।”

তারপর গণেশকে সাক্ষী রেখে, নবীন ঊষায় দাঁড়িয়ে একমুষ্টি জল নিলেন নিত্যময়ী। সঙ্গে নিলেন কালো তিল, চন্দন, তুলসিপাতা, দূর্বা, হরিতকি। চোখ বন্ধ করে বললেন, ‘পাপ নিও না ঠাকুর। আমার মরা দেহ গো, তাতে হাজার গুহ্য চিন্তা, অশৈল। তাও আমার তিনকুলে কেউ নাই, আমি চলে গেলে কেউ আমার নামে জল দেবে নে। তাই সুজ্জিঠাকুর আর এই গণেশ, এদের সামনে রেখে আমি নিজের মুখে জল দিয়ে গেলুম। বারবার তিনবার। দয়া করো ঠাকুর, যেন এই জল বারে বারে আমার কাছে ফিরে আসে, এ জন্মের পরে যদি পরজন্ম থাকে, যদি এ পাপদেহ মানুষ হয়ে জন্মায় গো, কী কুকুর বেড়াল হয়ে জন্মায়, আবার যদি এমন হয় যে জন্ম নিল নে, বিবাগী হয়ে শ্মশান-মশানে ঘুরে বেড়াল, তাতেও যেন সবসময় ওটুক জল আমার কাছে থেকে যায়। তোমাদের সবাইরে প্রণাম করি ঠাকুর।'

তিনবার করে নিজেকে জল দিলেন নিত্যময়ী, তিনবার গণেশ মন্ত্রাভিভূত হলো, থরহরি হলো নদী ও নগর, রুষ্টকর্মা নিয়তি থমকে দাঁড়াল, বিশ্ব নিজ কৃপাণবদ্ধ নিঃশ্বাস বুকে নিয়ে অবনত হলো কৃতাঞ্জলির সামনে। তারপর নিত্যময়ী গণেশের দিকে ফিরে ফ্যালফ্যালে হাসলেন, ‘এতক্ষণে আমার তর্পণ শেষ হলো রে!”

গণেশ কী বলবে বোঝেনি, তার আগেই এক গলা জলে দাঁড়িয়ে তাকে বুকে টেনে নিলেন নিত্যময়ী। তার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে পরম স্নেহে ননীর মতো গলে গেল তাঁর রূপহীন মুখ, ‘তুই আমার আগের জন্মের ছেলে ছিলি। সে জন্মে আমার রূপ ছিল, যৌবন ছিল, সংসার ছিল। তখন আমার কোল আলো করে এসছিলি তুই। তাই এ জন্মে মায়ের ঋণ শোধ করে গেলি গো ছেলে! তুই না থাকলে আমার তর্পণটুকু কী করে করতাম বল ? তুই সুখী হবি রে বাপ! এই আমি তোরে আশীর্বাদ করে গেলুম। সুখ তোর গলার সাতনরী হার হয়ে থাকুক।”

উদ্গত অশ্রু প্রাণপণে চেপে নিল গণেশ। সে বলতে চাইছিল, 'আমি মহাপাতকী গো মা!' তবু এক বয়স্ক পুরুষ ভেউ ভেউ করে কাঁদবে এমন হয় না। এবং নিত্যময়ীর আলিঙ্গনের মধ্যেই সে শিহরিত হলো এই উপলব্ধিতে যে এ অশ্রু পরিতাপের নয়, বরং নিষ্ফল আকাঙ্ক্ষার। এখনো তার ভেতর জুডাসের স্থৈর্যে ঘাপটি মেরে আছে বাসনা ও আশ্লেষ।..." 


অলৌকিক বাগান
শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য 

প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী

মুদ্রিত মূল্য : ২০০ টাকা



#সুপ্রকাশ


Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।