ঝিঙাফুলের কলি।। মিহির সেনগুপ্ত।।

'ঝুমুর গানের সঙ্গে সাঁওতালি বা অন্য কোনো কোলীয় গোষ্ঠীর লোকায়ত সংগীতের বিশেষ কোনো যোগ নেই। ‘ঝুমুর মূলত দ্রাবিড় ভাষাভাষী গোষ্ঠীর প্রেমসংগীত, নৃত্য এই সংগীতের অনুষঙ্গ' কোনো কোনো গবেষকের এই অনুসিদ্ধান্তটি যে তাৎপর্যপূর্ণ তা ব্যক্তিগত ভাবে আমার অভিজ্ঞতায় আমি জেনেছি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঝুমুরকে নৃত্যের অনুষঙ্গ হিসাবেই পেয়েছি।

মুন্ডারি 'পারহা প্রধানেরা' যখন জোরজবরদস্তি রাজা বা জমিদার হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেন, তখন বহিরাগত হিন্দু ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের নিকট থেকে ক্ষত্রিয়জাতির অন্তর্ভুক্তি আদায় করে নিতেন। ঝাড়খন্ডি আদিবাসী এবং কুর্মি সমাজে এরূপ উচ্চকোটির জাতিত্ব ক্রয় করার প্রভাব নিম্নকোটিতেও ক্রমে বিস্তার লাভ করে। ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগে ঝাড়খণ্ডের উপর দিয়ে চৈতন্যদেবের পুরী যাত্রার সময় সেখানকার উচ্চকোটি এবং নিম্নকোটির উপর তাঁর প্রভাব বিস্তৃতি পেয়েছিল। ফলে ঝাড়খন্ডের রাজা-জমিদারেরা রাধাকৃষ্ণের প্রেম এবং বৈষ্ণব কবিদের কীর্তন-পদাবলির দ্বারা আকৃষ্ট হয় এবং এই অঞ্চলে কীর্তনের সুরের একটা সংমিশ্রণ ঝুমুর ইত্যাদি লোকসংগীতের উপর পড়ে। সম্ভবত এই সময় থেকেই আঞ্চলিক প্রচলিত প্রেম-সংগীতের উপর কীর্তনের সুর প্রভাব বিস্তার করে বলেও অনেক গবেষক মনে করেন। লোকায়ত প্রেমের মধ্যে রাধাকৃষ্ণের প্রসঙ্গও অনুপ্রবিষ্ট হয়। রাজা-জমিদারেরা ঝুমুর গানের পৃষ্ঠপোষণা ছাড়াও অনেকেই স্বয়ং গান রচনায় মনোনিবেশ করেন। এরকম ঘটনায় গীতিকার বিষয়ে আমি খবরাখবর পেয়েছিলাম, তোপচাঁচির নিকটস্থ কাত্রাসগড় রাজবাড়িতে রাজা ত্রিদিবনারায়ণের কাছে।

তখন কাত্রাসগড়ের রাজরাজত্ব ছিল না। সেখানকার শেষ রাজ পদমর্যাদাধারী রাজা ত্রিদিবনারায়ণ সিং দেব জীবিত। রাজাসাহেব তখন বিহার বিধানসভার জনতা দলের বিধায়ক ছিলেন। আমি তাঁর সঙ্গে পরিচিত ছিলাম। রাজা সাহেবের পিতামহ প্রয়াত গঙ্গানারায়ণ সিং দেব ঝুমুর এবং কীর্তন পদাবলির খুবই জনপ্রিয় কবি ছিলেন। আমি রাজা গঙ্গানারায়ণ সিং দেবের অন্তত একটি ঝুমুর বাঁশরির গলায় রাঁচিতে বসে শুনেছিলাম। তার কিছু কলি ইতস্তত মনেপড়ে। যেমন—

‘সখিয়ারে ক্যায়সে যাওব যমুনায়। 
যমুনাকে তীরে কালা বাঁশরি বাজায়।। 
ঘরেতে গুরুজনা, কহিলে না শুনে মানা 
দিন সন্ধ্যা করবে আনাগোনা
সব্বনাশে ডুবালে আমায়। 
সখিয়া রে, ক্যায়সে যাওব যমুনায়।” 

রাজবাড়ির পুস্তকাগার থেকে রাজামশাই-এর রচিত কিছু বাংলা কুর্মালি, হিন্দি এবং মিশ্র ভাষায় গানের বই পেয়েছিলাম। সম্ভবত তার দু-একখানা এখনও আমার কাছে কোথাও আছে। তবে সেই রচনা এবং তার বিষয়বস্তু খুব যে উঁচু দরের এসব মনে হয়নি। বাঁশরির কণ্ঠে যতটুকু শুনেছিলাম, তাতে সুর, তাল, লয় এবং সহজ রাগ-রাগিণীর ব্যবহার যথেষ্টই উপভোগ্য মনে হয়েছিল। অন্তত এটা বুঝেছিলাম, গঙ্গানারায়ণজি সংগীত-রসজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন।

ঝাড়খন্ডি রাজা-জমিদারেরা, যাঁরা সংগীতপ্রেমী বা রসিক ছিলেন, অথবা ঝুমুর-কীর্তনাদির পদ রচনা করতেন, গৌরাঙ্গ বিষয়ক অথবা রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক বৈষ্ণব পদকর্তাদের বিশেষভাবে অনুসরণকারী ছিলেন। এটা বোধহয় সম্ভব হয়েছিল ঝাড়খন্ড অঞ্চলের মধ্য দিয়ে চৈতন্যের শ্রীক্ষেত্র বা পুরীধাম যাতায়াতের প্রভাবে। কিন্তু, এইসব রাজা-জমিদার বা অন্যান্য পদকর্তারা যথার্থ শিক্ষিত বা সূক্ষ্মবোধ সম্পন্ন না হওয়ায় বৈষ্ণব কবিদের মতো ইন্দ্রিয়জ স্থূলতা ব্যতিরেকী কামগন্ধহীন- পদলালিত্য-বিশিষ্ট সংগীত সৃষ্টি করতে পারেননি। ঝাড়খন্ডের লোকায়তিক স্থুল প্রচলিত ধারায়ই তা সৃষ্টি করেছেন। তবে একথাও বলব যে এই প্রচলিত ধারাটিরও বাস্তবতার দিক থেকে উপযোগিতা আছে এবং ঝাড়খন্ডি লোকয়াতিক সংস্কৃতি তাতে কম সমৃদ্ধ হয়নি। বরং তার মাধ্যমে ঝাড়খন্ডি সমাজ স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে।

আমার এই মূল্যায়ন বাঁশরির কাছে শোনা গান এবং তার অধ্যয়ন ও আঞ্চলিক অভিজ্ঞতালব্ধ তথ্য তত্ত্বের বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা থেকে জেনেছি।' 


ঝিঙেফুলের কলি
মিহির সেনগুপ্ত

প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী

মুদ্রিত মূল্য : ৪৫০ টাকা

#সুপ্রকাশ 


Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।