সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম। মিহির সেনগুপ্ত

বেলা ডুবুডুবু। ফকির সাহেব তার কাজেকামে ব্যস্ত। মাঝে মাঝে দু-একটা মামুলি কথা বলছেন। আমরা যে এতগুলো মানুষ অনাহূত অতিথি হলাম, তার জন্য কোনো উত্তেজনা দেখছি না তাঁর। মুখের ভাব দেখে বেশ বোঝা যায় তাঁর খুব আনন্দ হয়েছে। বাইরে হাটের ভিড় ক্রমশ কমে আসে। ব্যাপারীরা তাদের অবিক্রীত মাল নৌকায় তুলছে। কারুর বা নৌকা নোঙর তুলে চলতে শুরু করেছে। নদীর জলে শেষ সূর্যের লাল। অজস্র কচুরিপানার কাফেলা প্রবল স্রোতে সাগরের দিকে ছুটে চলেছে। মাঝে মাঝে দু-একখানা যাত্রীবাহী লঞ্চ বা রকেট এসে নোঙর করেছে। মানুষজন উঠছে-নামছে। হইচই হট্টগোল হচ্ছে। ফকিরের মোকাম থেকে সব দেখতে পাচ্ছি। ছোটো ছোটো মাছমারা ট্রলারগুলো দক্ষিণে সাগরের দিকে যাচ্ছে। ছোটো ডিঙিগুলোতে হাটুরেরা যে যার বাড়ি ফিরছে। আস্তে আস্তে ছইওলা নৌকাগুলোতে ডিবরি বা হারিকেন জ্বালানো হচ্ছে। সব মিলিয়ে এক বিগত কালের স্বাদ, অনুভূতি পাচ্ছি, নদীর ধারের এই পরিবেশ আমার কাছে শাশ্বত-প্রায় ছবি। এর প্রতিটি রঙ, শব্দ, ছন্দ, ভাষা বা এর পুরো অবয়ব এবং আত্মাটিও যেন আমার একান্ত পরিচিত। মাঝের কয়েক বছরের নাগরিক বিচ্ছিন্নতা বাদ দিলে আমিও তো এর অংশ, অথবা সব মানুষই কি তাই নয়?

হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়ি আমরা। কয়েক কদম এগোলেই লঞ্চঘাটের জেটি। এখন হাট একেবারেই ভাঙা। সবাই যে যার ঘরে ফিরে গেছে তাদের বাকি পসরা আর সওদা করা জিনিসপত্র নিয়ে। স্থায়ী দোকানে ঝাঁপ পড়ে গেছে। দু-একটা দোকানে শুধু ইলেকট্রিক আলোর বাল্ব জ্বলছে। দূরের একটা আলোকবর্তিকা থেকে দিকনির্দেশকারী উজ্জ্বল সার্চলাইটের ঘূর্ণন দেখা যাচ্ছে। মাঝনদীতে এ ধরনের আলোকস্তম্ভ দেখলে বড় অলৌকিক আশা জাগে। মনে হয়, কেউ যেন কোথাও আছে যে সীমাহীন অন্ধকার নদীর মধ্যেও পথ দেখায়।
দুজনে বসে থাকি সেই কচা বলেশ্বর ঘাটে, যার নাম কালীগঙ্গাও বটে। এরকম এক প্রায়-দিগন্ত বারিধি নদীর কিনারের মৌনে এসে মানুষ বোধহয় তার তাবৎ লব্ধজ্ঞান, ইতিহাসচেতনা, সমাজবিকাশের অগ্রগতির অহংকার-- সব হারিয়ে ফেলে। তখন বোধহয় তার চেতনায় এক অনন্ত নিঃশব্দ কল্লোলই শুধু থাকে। সে যেন এক মহাশরীরী শূন্য যা স্রোতস্বতী আবার নিশ্চলও বা। আমাদের এখন সেই মহাশরীরী শূন্যে নিমজ্জনদশা।

আকাশে মেঘ যেটুকু আছে, তা একান্ত শারদী নিয়মরক্ষা। পঞ্চমীর চাঁদ আছে একফালি, আর আছে তারারা। একসময়ে এরাই সেই মহাশরীরী অনন্ত শূন্যে সীমায় প্রতীক হয়। মোকছেদ আর আমি জেগে উঠি কালের পল অনুপল বিপলের হিসাবে বাঁধা রোজনামচায়।
একসময় মোকছেদ বলে-- এই নদী মোগোর বেয়াক সুখ-দুঃখের কতা জানে। কত যে লহু আর লাশ এনার বুকে ভাইসে গেছে তার আর ইয়ত্তা কী, আর খালি এ নদীর কতাই বা বলি ক্যান। এ দ্যাশে তো নদী খালের কমি কিছু নাই। সব নদী খালেরই একই বেত্তান্ত।

সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম
মিহির সেনগুপ্ত

প্রচ্ছদ : তিস্তান
মুদ্রিত মূল্য: ৪৮০ টাকা
#সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।