নাইনটিন নাইনটি আ লাভ স্টোরি। কল্লোল লাহিড়ী। পাঠ প্রতিক্রিয়া : আদিত্য ঢালী

সুপ্রকাশ প্রকাশিত কল্লোল লাহিড়ীর উপন্যাস ' নাইনটিন নাইনটি আ লাভ স্টোরি ' পড়ে লিখেছেন আদিত্য ঢালী। আমরা তাঁর অনুমতি নিয়ে নিজেদের টাইমলাইন থেকে শেয়ার করছি।
.....................
নাইনটিন নাইনটি আ লাভ স্টোরিঃ ফেলে আসা সময়ের এক অরাজনৈতিক পাঠ

মফস্বলের নস্টালজিয়ায় মুহূর্তেরা লোডশেডিং-এ জড়ো হয়। সেই লোডশেডিং এখন শহর এবং শহরতলী থেকে লুপ্ত। আসলে যা কিছু লুপ্ত তাইই হারিয়ে যাওয়ার সমান। তাই প্রথম প্রেম যখন শিয়রে চুম্বন করে জানিয়ে দেয় এই চুম্বনই শেষ চুম্বন, ভালোবাসার ভাড়ার শূন্য, তখন কালপুরুষ দেখার কথা মনে পড়ে। কারণ যারা কালপুরুষ দেখে তারা সর্বদা হারিয়ে যাবেই। এটাই নিয়তি। সে যৌবনে হোক কিংবা বয়সকালে। হারিয়ে যাওয়া তার কপালে লেখা আছে। হারিয়ে যাবে বলেই একটা গোটা দশক জোড়া নস্টালজিয়ায় ভোগে সে। কারণ মিলেনিয়াল আকাঙখায় নস্টালজিয়া নেই। মিলেনিয়াল আকাঙখায় স্মৃতি আঁকরে বেঁচে থাকার চাহিদা নেই। দ্রুত গতিবেগে শুধু সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে আছে। সেই দিকে যার কোনো দিকনির্দেশ নেই, আছে শুধু বাহ্যিক কর্পোরেট চাকচিক্য। তাই আমাদের কাছে ফেলে আসা দিনগুলো বরাবরই সোনালী আর নস্টালজিয়া মানেই নব্বই। আর এই প্রেক্ষাপটেই কল্লোল লাহিড়ীর নতুন উপন্যাস "নাইনটিন নাইনটি আ লাভ স্টোরি"।

বিধু বিনোদ চোপরার ছবি থেকে ধার করে নেওয়া নাম আসলে সময়কে উপভোগ্য করে তোলার জন্যই মনে হয়। সময় আমাদের কাছে এখন ত্রি-মাত্রিকতার অবয়ব। যার চেতনাহীন ধূসর প্রতিলিপিতে আমরা আমাদের নিজস্ব ছায়া দেখতে পারি। স্মৃতির সাগরে ডুব দিতে পারি, ভবিষ্যতের স্বপ্নে বিলীন হতে পারি।  সময়যানে চেপে ঘুরে আসতে পারি নিজেদের ফেলে আসা দুঃখ যন্ত্রণা ভালোবাসার পিরিয়ডে। লেখকও এই আখ্যানে সময়যানে চেপে ফিরে যান নিজের শৈশবে। সেখানে তিনি কিংশুক। আর তার চারপাশে একটা গোটা মফস্বল। সেই মফস্বলের একদিকে বয়ে চলেছে গঙ্গা নদী। যার পার ধরে হেটে গেলে কৈশোরের প্রেমপত্র খুজে পাওয়া যায়। বৈকালিক চায়ের আসরে এখানে রাজনীতির পাঠ নেওয়া যায়। টেস্ট পেপার সলভ্ করার বাহানায় এক চক্কর ঘুরে আসা যায় প্রেমিকার বাড়ির সামনে থেকে। আড় চোখে দেখে নেওয়া যায় ছাঁদের ধারে সে এসে দাঁড়াল কিনা! কিংবা মাঝমাঠ থেকে ড্রিবল করে চারজনকে কাটিয়ে বলকে জালে জড়িয়ে ম্যাচ উইনিং গোল করলে এখানে সকলের কাঁধে করে বাড়ি ফেরা যায়। সারা আকাশ জুড়ে মফস্বলি  বাতাস বয় এখানে। হারিয়ে যাওয়ার বাসনা জাগে গোটা একটা প্রজন্মের মনে।

লেখক দৃশ্যকল্পের ভাষান্তরে এই দৃশ্যগুলিই রচনা করেছেন চরিত্রদের অন্তরালে। স্কুল পালানো আনন্দ। বাড়িতে বকা খাওয়ার ভয়। যৌনতার দৃষ্টি আকর্ষণ, প্রেমিকাকে দেওয়া প্রথম প্রেমপত্র কিংবা হারিয়ে ফেলা প্রেমের যন্ত্রণা এইসবই বারবার নতুন নতুন দৃশ্যকল্প হয়ে ধরা দিয়েছে এই আখ্যানে। অনেকটা সিনেমার জাম্পকাটের মত। এক সিকোয়েন্স থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি সিকোয়েন্সে আগের সিকোয়েন্সের বক্তব্য পূর্ণ হওয়ার আগেই চলে যাওয়া। সবচেয়ে আশ্চর্য এবং আধুনিক বিষয় হল নব্বইএর প্রেক্ষাপটে রচিত এই আখ্যানে হয়ত ভারতীয় বাজার মুক্ত হওয়ার আগেই ও শ্রেণী সংগ্রামের স্লোগানের মাঝেই এই মফস্বলে যায়গা পায় সমপ্রেম, সমকাম। যা নিয়ে এই বিশ শতকের গোড়া থেকেই তুমুল শোরগোল পরে যাবে গোটা দুনিয়া জুড়ে। কিন্তু তার আগে মুক্ত চিন্তার প্রেক্ষাপটেও যা ছিল নিষিদ্ধ, সেই নিষিদ্ধতার মায়ায় হাবুডুবু খায় দুই কিশোর। যাদের ঘামের গন্ধ মিশে যায় একে অপরের সাথে। আর এই সবের সাক্ষী থাকে জ্বলজ্বল করে জ্বলে থাকা কালপুরুষ। যার হাতছানিতে একসময় হারিয়ে যাবে এরা।
এই আখ্যানের ভাষা লেখকের অনান্য লেখার থেকে আলাদা। এখানে চলচ্চিত্র রচনার ভাষার বহুল ব্যবহার চোখে পড়ে। বারেবারে ফ্ল্যাশব্যাক ব্যবহার করে ভাষার মাধ্যমে দৃশ্য নির্মাণের যে কৌশল এই আখ্যানে উঠে এসেছে তা বলা বাহুল্য এক ননলিনিয়ার উপন্যাসের জন্ম দিয়েছে। যেখানে কাহিনীই একমাত্র অবলম্বন নয়। ভাষার মাধ্যমে আমাদের ধূসর অবয়বে যে দৃশ্যের জন্ম হচ্ছে তার উপলব্ধিরও সঠিক মূল্যায়ন করা। আর তা হচ্ছে বলেই আমরা সকলে পাঠক হিসেবেও একই নস্টালজিয়ায় ভুগছি। স্মৃতির কোঠর থেকে আমাদেরও সোনালী দিনগুলো মনের মাঝে উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। আমার মনে হয় লেখকের কাছে এটাই চরম প্রাপ্তি। 

কিন্তু চরম অপ্রাপ্তি থেকে যায় প্রধান চরিত্রের পূর্ণ চরিত্রায়ন না হওয়ায়। এটি নব্বইএর ইরানিয়ান নিউ ওয়েভ চলচ্চিত্র নয় যে এখানে চরিত্ররা শুধুমাত্র রোল প্লে করে বাস্তবকে রিপ্রেসেন্ট করবে। এটি একটি অঞ্চলের আখ্যান, একটি সময়ের অবয়ব, বেশ কিছু চরিত্রদের জীবন। তা কখনও অপূর্ণ থাকতে পারে না। হেরে যাওয়া জীবনেও পূর্ণতা থাকে। 
নব্বই-এর দশক ভারতীয় সমাজে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। বহু কিছুর বদল শুরু হয় এই সময় থেকে। কাশ্মীরের পরিবেশ উত্তপ্ত হওয়া থেকে শুরু করে বাবরি মসজিদ ভেঙে দেওয়া। মুক্ত বাজারের ঘোষনা থেকে শুরু করে কেবল টিভির আমদানি। হিন্দুতব্বাদীদের মসনদে বসা থেকে শুরু করে কারগিল যুদ্ধ। এইসব কিছুর আঁচ কি একটা গোটা মফস্বলে কারোর উপর পরে না? যখন সময়ের চিত্র চিত্রায়ন করাই উদ্দেশ্য। শুধুমাত্র কোকাকোলা আর পারফিউমই  পুঁজিবাদি পণ্যের উদাহরণ যেমন হতে পারে না তেমনি দৃশ্যের ভাষান্তরের মায়াজাল থেকে বক্তব্যের রাজনীতি হারিয়ে যেতে পারে না। আখ্যানের শুরুই যেখানে এক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট থেকে, চরিত্র যেখানে আপাদমস্তক রাজনৈতিক, সেখানে গোটা উপন্যাস জুড়ে কোনো রাজনৈতিক বক্তব্য পেশ না করা কি শুধুমাত্রই মধুরেণ সমাপতন নাকি রাজনৈতিক মতাদর্শের ক্ষয় হয়ে যাওয়ার ভয়!

প্রথম উপন্যাস "গোরা নকশাল" থেকেই লেখক নিজের সক্রিয় রাজনৈতিক বক্তব্য রেখে চলেছেন। তদুপরি এক সমান্তরাল রাজনীতির পাঠ দিয়ে চলেছেন পাঠকদের। প্রথম উপন্যাসে বিপ্লবের পাঠ, চিন্তা ও চেতনায় বিপ্লবকে কীভাবে লালন করা যায়, কীভাবে একটি রাজনৈতিক আন্দোলন ফ্যান্টাসির ঊর্দ্ধে উঠে আমাদের জীবন ধারণের পাঠ হতে পারে, তার পাঠ।  দ্বিতীয় উপন্যাস "ইন্দুবালা ভাতের হোটেল"-এ সমাজবিজ্ঞানের পাঠ। সামাজিক রাজানীতি উঠে এসেছে পাতা জুড়ে। অতিবাস্তব ও পরাবাস্তবের মেলবন্ধনে রচিত হয়েছে সমসাময়িক বিভিন্ন বৈপ্লবিক কার্যকলাপের চিত্র। পরের উপন্যাস " বাবার ইয়াসিকা ক্যামেরা"-এ পরিবারতন্ত্রের সামাজিক বহিঃপ্রকাশ হয়েছে। সমাজ ও রাজনীতি কীভাবে পরিবারিক চিন্তাভাবনায় লব্ধ হতে পারে তার পাঠ এই উপন্যাস। একাধারে তা যেমন বাঙালি সমাজে সময়ানুক্রমে পরিবারের ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যাওয়ার ইতিহাস আবার স্মৃতির প্রেক্ষাপট থেকে হারিয়ে যাওয়া মানুষদের পুনরুদ্ধার।
কিন্তু এই উপন্যাস কৈশোর ও শৈশবের জাদুবাস্তবে আদ্যন্ত রাজনৈতিক হতে পারত। কিন্তু এটি শুধু রোম্যান্টিক হয়ে থেকে গেছে। শ্রেণী সংগ্রামের নামে বুর্জোয়া নীতির প্রচলন, লুম্পেনদের আস্কারা, কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার প্রকোপ ইত্যাদি আরও অনেক চিত্র এই আখ্যানে এই মফস্বলের অংশ হতে পারত। কীভাবে মানুষ আদর্শচ্যুত হয়ে যায় লোভের কাছে, লালসার কাছে, ক্ষমতার কাছে সেই রচনাও অধরা থেকে গেছে। শুধুমাত্র দৃশ্য রচনার প্রয়োজনে চরিত্ররা ফিরে ফিরে এসেছে। কেউ কারো বক্তব্য রেখে যায়নি। স্যাডিস্টিক আনন্দ পাওয়া গেছে কেবল। চেতনায় বক্তব্য পরিস্ফুট হয়নি। এই উপন্যাস নব্বইয়ের বাম জমানার দলিল হতে পারত, ক্ষয়ে যাওয়া বাম-মতাদর্শের রচনা হতে পারত, ক্ষমতার কাছে আদর্শের বলি দেওয়া কমিউনিস্টদের গাঁথা হতে পারত। কিন্তু এই রাজনৈতিক পাঠই গোটা উপন্যাস জুড়ে অনুপস্থিত। তাই উপন্যাস শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও মনে এক দ্বিধা থেকে যায়, অপ্রাপ্তির দ্বিধা, অসম্পূর্ণতার দ্বিধা। এই দ্বিধা এইজন্যই থাকে কারন লেখকেরই "মন্টু অমিতাভ সরকার" নামক এক দীর্ঘ কলাম এই অন্তর্জালে পাওয়া যায়। যার প্রেক্ষাপটও নব্বইএর দশক এবং যার প্রধান চরিত্রও মন্টু,  কিন্তু তা আপাদমস্তক রাজনৈতিক। অরাজনৈতিকতার কোনো ভূষণ সেখানে লেখক নেননি।

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।