সমর ভট্টাচার্য রচনা সংগ্রহ পড়ে পাঠ-প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন সুপ্রিয় ঘোষ।

সমর ভট্টাচার্য রচনা সংগ্রহ পড়ে পাঠ-প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন সুপ্রিয় ঘোষ। আমরা তাঁর অনুমতি নিয়ে নিজেদের টাইমলাইন থেকে শেয়ার করছি। 
............................................

সমর ভট্টাচার্য  এক অনাস্বাদিত মোহ 
সুপ্রিয় ঘোষ 

বিহারের কোনো এক হরিজন বস্তি থেকে চুমকি আর বিরজু ঘর বাঁধতে চলে এসেছিলো নিম্নমধ্যবিত্ত গল্প কথকের মফস্বল শহরে। তারা দুজনেই ঝাড়ুদার।  বাড়ির সামনের রাস্তা ঝাঁট দিতে আসার সূত্রে কথকের সঙ্গে তাদের সখ্যতা।চুমকির অভিযোগ কথকের কাছে তার স্বামী বিরজুর বিরুদ্ধে। বিরজু অকারণে অনেক খরচ করে। সে যেন বিরজু কে নিষেধ করে। চুমকির সাফ যুক্তি - ' এখন যদি খরচা না কমাই তবে কমাইবে কবে? ঘরে যে নতুন আদমি আসছে তার জন্য ভাবতে হোবে না? ' অথচ গল্পের কথককেই স্ত্রীর ঠুনকো মান বাঁচাতে বেচে দিতে হয় পিতার শেষ স্মৃতি সোনার ঘড়িটা। একটা ঝাড়ুদার দম্পতির ভালোবাসার কাছে হেরে যান কথক যখন দেখেন বিরজু চুমকির মাতৃত্বকে অভিনন্দিত করেছে ডুরে শাড়ি কিনে দিয়ে। গল্পকার সমর ভট্টাচার্য তাঁর 'ক্যাকটাস ' গল্পে এইভাবেই তুলে ধরেছেন নিম্নমধ্যবিত্ত সমাজের অসহায়তা ও ঠুনকো মানের জন্য হৃদয়হীনতাকে। ' আমি সে ও একটি বিষণ্ণ সন্ধ্যা ' গল্পে সমর আমাদের শুনিয়েছেন পূর্ববঙ্গ থেকে ছিন্নমূল হয়ে আসা নিবারণের করুণ কাহিনী। অকৃতদার মাস্টার মশাই অন্নদাশঙ্কর বাবুর জীবনের একাকিত্বের যন্ত্রণা আর শিক্ষক হিসেবে সম্মান- শ্রদ্ধা এ দুয়ের অম্ল-মধুর সহবস্থান ঘটেছে ' মাস্টারমশাই' গল্পে। কফিনের কারিগর যোশেফ ইউসুফ মিস্ত্রী, আর কেউ মারা গেলে গির্জার বড় ঘণ্টাটা বাজানো যার কাজ সেই সার্কিস্তাবয় মাইকেল শিবু মুর্মু দুজনেই বন্ধু। মৃত্যুকে কেন্দ্র করে তাদের বৃত্তি। যোশেফ নিজেদের জন্য অর্থাৎ শিবু আর তার জন্য দুটো সুন্দর কারুকার্যময় কফিন বানায়। এ দুটো তাদের শেষের সঙ্গী হবে। কিন্তু শিবুর জন্য ভালোবেসে বানানো কফিনটা ব্রাদার সোবাস্তিনের পছন্দ হয় ফাদার গিলবার্টেরকে সমাধিস্ত করার সময়। শিবুর কথা বললেও ব্রাদার যোশেফের ভাবাবেগকে আমল দেননি। তাই সোবাস্তিনকে যোশেফের স্বর্গের বাগানের শয়তানবেশী সাপ বলে মনে হয়েছে। অদ্ভুত এক হদয়ভেদী গল্প হয়ে ওঠে ' বাইবেলের সাপ '। 

'অক্ষয়বট ' গল্পে মধ্যবয়সী অবিবাহিত গরীব পুরোহিত তারাপদ, যুবতী বিধবা লক্ষী আর বড়ো লোকের ব্যাটা ভোম্বলকে কেন্দ্রকরে গল্পকার পৌঁছে গেছেন আমাদের মনের গোপন ঘরে। যেখানে কিলবিল করছে কামরাঙা ইচ্ছেরা । গল্পে তারাপদর উক্তি - ' জানলে লক্ষীদিদি, মানুষও ঐ বটবৃক্ষের মতনই। দেখা যায় না। কিন্তু মানুষের গায়েও ঝুলছে অমনি কত যে কামনা-বাসনা ঢেলা -- । '
'তাপচুল্লি' গল্পে লেখক জীবনকে দেখেছেন বহুকৌণিকতায়। গল্পের প্রধান চরিত্র গণেশ। সে এক চায়ের দোকানদার। ভোরবেলা চুলা জ্বালিয়ে যার কাজ শেষ হয় মধ্যরাতে। তাপ চুল্লির সামনেই তার কর্মযাপন। কিন্তু এই গণেশ দত্ত যৌবনের তাপ চুল্লিতে হারিয়ে ছিলেন জমজমাট মুদিখানা ব্যবসা। ছেলেকেও ঐ বাপের মতো মেয়ে ছেলে রোগে ধরেছে। যা গণেশের জীবনকে তাপ চুল্লিতে পরিণত করেছে। পাল্কির মতো বারবণিতার তাপিত জীবন কথা বেদনা বিধুর। তার যৌবনের আগুন নিভন্ত। গণের মুখে লেখকের অমোঘ উচ্চারণ - ' যতদিন ওই আগুন, ততদিনই জীবন। ' 
এইভাবে একের পর এক গল্পে সমর দৈনন্দিন জীবন চিত্রের মধ্যেই এঁকে দেন মহাকালের পদচিহ্ন, খুঁজে ফেরেন বৃহত্তর জীবন। 

' গাঙের মানুষ ' গল্পে গরীব জেলেদের ওপর মহাজন ভোলা বিশ্বাসের শোষণ এবং ধীবর রাজেনের বিদ্রোহ বর্ণিত হয়েছে। বর্ণিত হয়েছে গাঙের প্রতি রাজেনের গভীর ভালোবাসা। রাজেনের কথায় -- ' জানিস, নিশুতি রাত্তিরে যখন গাঙের মধ্যিখানে শুয়ে থাকি চিত হয়ে, আকাশের তারা ওঠে, জোছনায় ভরে যায় সমস্ত জগৎ - সমসার। গাঙের জল চিকচিক করে চাঁদের আলোতে। দূর থেকে ভেসে আসে ভিনগাঁয়ের মাছধরার গলার ভাটিয়ালি সুর। তখন মনে হয় এই জল এই মাটি এই মাছ - সব আমার। ' 
' ভুঁইচাপা ' গল্পের ভুঁইচাপা শব্দের অর্থ হলো - উবি বা কাছিম। দুমুঠো অন্নের জন্য কাছিম শিকারী বুধনকে উবি বিক্রি করতে যেতে দেখেও তার সন্তান সম্ভবা স্ত্রী ময়নার উবির মাংস খাওয়ার ইচ্ছাকে হত্যা করতে হয়। নিজেকে গালমন্দ করে সে বলেছে - ' গরীব মানুষের অত নুলা ভালো নয়। ' 
গ্রন্থটির আরো উল্লেখযোগ্য গল্প হলো - অসুখ, পদ্মপাতার জল, পরাণহাটির লালচাঁদের বউ, সজনে ফুলের বাসনা, বিবি পছন্দ ইত্যাদি।
' সমর ভট্টাচার্য রচনা সংগ্রহ ' বইটিতে রয়েছে মোট কুড়িটি গল্প। এছাড়াও রয়েছে একটি পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস ' রাবণের সিঁড়ি ' আর একটি ছিন্নোপন্যাস ' জলছবি '। রাবণ স্বর্গে যাবার সিঁড়ি বানাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সেকাজ সম্পূর্ণ হয়নি। উপন্যাসে সমর ভট্টাচার্য এঁকেছেন বেকার যুবক সোমনাথ বেকারত্বের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে অর্থাৎ সুখ-স্বর্গের সন্ধান পেতে কিভাবে সীমান্ত চোরাচালানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পরে এবং জীবনে কিভাবে তার বিপর্যয় নেমে আসে তার করুণ ছবি। জলছবি উপন্যাসে রয়েছে অংশুর চোখে দেখা এক উত্থান-পতনময় জনজীবনের চালচিত্র। এ যেন বিভূতিভূষণের অপুর পথচলা। নদীয়া জেলার লোকায়ত সংস্কৃতির উজ্জ্বল ফসল পালাগান নিয়ে লেখা ' গ্রামবাংলার পালাগান ' নামক প্রবন্ধটি। এই পালাগান গুলি মাঠপালা  নামেও পরিচিত। কৃষ্ণযাত্রা, নিমাই সন্ন্যাস, বেহুলার পালা এসব চিরায়ত বিষয় নিয়ে গড়ে ওঠা পালাগানগুলির কথা প্রাবন্ধিক তুলে এনেছেন উক্ত প্রবন্ধে। আপাং-দুলালের মতো মাঠপালা আজো প্রচলিত রয়েছে নদীয়া জেলাতে। ১৮৮০-৮৫ সাল নাগাদ নদীয়ার বিস্তৃত অঞ্চল ম্যালেরিয়ার প্রকোপে প্রায় জনশূন্য হয়ে পরেছিলো। ঐ সময় নদীয়া ফিবার কমিশন গঠিত হয়। এই প্রেক্ষাপটে সমর রচনা করেছেন তাঁর মুক্ত-গদ্য ' ইয়াসিন মিঞার জবানীতে '। ভারতবর্ষের জন্মহার অপেক্ষা মৃত্যুহার অনেক কমে গেছে। এর কারণ খুঁজতে গিয়ে ইয়াসিন মিঞার জবাব আগে জন্ম হতো কিন্তু গ্রামে কথিত পেঁচোপেঁচিই আক্রান্ত হয়ে অধিকাংশই শিশুই মারা যেতো। তারপর ম্যালেরিয়ার ডিপো বন-জঙ্গল, খানাখন্দ পরিষ্কার করে পেঁচোপেঁচি তাড়াতেই জন্মহার বেড়ে গেলো। 
শতঞ্জীব রাহা সম্পাদিত সমর ভট্টাচার্য রচনা সংগ্রহ এই রকম বিচিত্র স্বাদের গল্প-উপন্যাস আর প্রবন্ধের সমাহার। প্রচ্ছদ ও অলংকরণে শিল্পী মেখলা ভট্টাচার্য বেশ অভিনবত্বের পরিচয় রেখেছেন। সুসম্পাদিত গ্রন্থটি সংগ্রহযোগ্য তার নিজস্বগুণে। 
প্রকাশক - সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।