শারদ নির্মুখোশ ১৪২৯

সমস্ত আঙিনায় নৈঃশব্দ নেমে এসেছে। হেমন্তের সন্ধ্যে। ধোঁয়া ধোঁয়া অন্ধকার। টালিখোলার দিক থেকে মাঝে মাঝে মাটি কাটা মেশিনের দূরশ্রুত ঘটাং ঘটাং। আঙিনার মানুষগুলোর শ্বাসও যেন শোনা যাচ্ছে। যেন দীর্ঘকাল অনাস্বাদিত প্রশান্তির খোঁজ পেয়েছে তারা।

ফকির কথা থামালেন। বিষাণের বউ-মেয়ে মুড়ি-চা এনে দিল, আজ মুড়ির সঙ্গে লাল মুলোর কুচি। গৌর লক্ষ্য করলেন—আজও সুজি নামের ছেলেটি বসেনি, ঠিক বাড়ির আঙিনার ভেতরেও আসেনি। সেদিনের জায়গাটাতে সেদিনের ভঙ্গিতেই দাঁড়িয়ে আছে। মুখটা ভারি কাঁচুমাচু। তার চোখ টুনাকে ততদূর অনুসরণ করছে যতদূর দেখলে অন্যদের থেকে নিজের দৃষ্টি, নিজের লক্ষ্যের গতিপথকে আড়াল করা যায়। টুনা কিন্তু মোটেও তাকে দেখছে না। কিন্তু তার চোখ দুটো হাসছে যেন।

গৌর সুনন্দর দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। সুনন্দ হেসে বললেন—'দেখেছি, দেখেছি। বিয়ে-থা করা হয়ে ওঠেনি বলে ভেবো না একেবারে কাঠখোট্টা বনে গেছি। নতুন একটা গল্পের জন্ম হচ্ছে।'
মুড়ি খেতে খেতে সকলেই পাশাপাশি মানুষটার সঙ্গে অনুচ্চ স্বরে কথা বলছে।
আজ কয়েকজন মেয়ে-বউকেও দেখা যাচ্ছে।
গৌর আর সুনন্দ এই সব কথা মধ্যে মানুষগুলোর সুখ-দুঃখের, দৈনন্দিনের খবর পেলেন। কারও কথায় তরকারির দাম, কারও কথায় গ্রামের মাঠ পর্যন্ত পৌঁছে-যাওয়া ফড়েদের উৎপাত, কারও কথায় বেজুত-শরীরের অসুবিধা। মেয়েদের আলোচনায় ছেলে-মেয়েদের স্বভাব, তাদের অবাধ্যতা, মাস্টারবাবুদের মাইনে, তেল-নুনের হিসেব, শাশুড়ির উৎপাত, ননদের অশৈল কাণ্ড, রান্নাবান্নার তরিকা বা পাশের বাড়ির গিন্নির গুমর—কতকাল যেন এরা নিজেদের মধ্যে এমনভাবে কথা বলেনি, কারও সঙ্গে এমনভাবে হেসে-গেয়ে বাঁচেনি — তাদের একটা কথার সঙ্গে আর-একটা কথা জড়িয়ে যাচ্ছে—একটা কথার পাছে আর-একটা কথা চলে আসছে। ভেঙে যাওয়া নদীঘাটের মতো ভেঙে যাওয়া সমাজে কে জানে কতদিন এমনভাবে পাশাপাশি বসতে পারবে! কে জানে আরও কতদিন পর শটের বউয়ের কাছ থেকে মুকুন্দের বউ জেনে নিতে পারবে কোমরের ব্যথার টোটকার কথা !
মুড়ি-চা শেষ করে ফকির বললে—'তোমাগের তো কথাখান বোঝানো লাগপে না। গাছের মতন অন্যজনারে ছায়া দেবে, নিজের বুকে হাঁফ ধরলে অবরে-সবরে অন্যের ছায়ায় গিয়ে গিয়ে জিরোবে।'
ঢিমে আলো-জ্বলা বিষাণের আঙিনায় ফকিরের কথাগুলো উজ্জ্বল ধাতুখণ্ডে ঠিক্রানো বিদ্যুৎ-শলাকার মতো মনে হলো গৌরের। সুনন্দ গৌরের কানে কানে বললেন—'দেখেছ! এই কম বই-পড়া মানুষগুলো ফকির বাবার কথা কেমন দিব্যি বুঝতে পারছে।' 
গৌর বললেন—‘ফকিরের অঢেল অভিজ্ঞতা। কোন ভাষায় কীভাবে বললে মানুষ বুঝতে পারবে তা তিনি জানেন।'
গৌরও কিন্তু ঠিকই বুঝলেন, বহুকাল যত্ন না পেয়ে চারপাশটা থম মেরে আছে—এখনই যত্ন নেওয়া দরকার মরা সমাজটার। সেই মরা সমাজের রাজা হতে গেলে আর প্রজার প্রয়োজন হবে না—সে কাজটা ডিজে, মুরগির ফিস্টি, কালো রঙের বোতল, গোলাপি রঙের টাকা, ঠাণ্ডা নলের অস্ত্র, রঙিন বাক্সের ছবি, খবরের কাগজের ঝলক, ভাড়াটে ইতিহাসবিদের মনগড়া লেখা, মূর্খ গুরুর অং বং চং কথা, দামি-পোশাক পরা বাবারা, সাদা-কলারের মিস্ত্রীশ্রেণীর লোকজন কিংবা ভাড়া করা বাউন্সার ধরনের দালালেরাই করে দেবে!
ফকির অন্যমনস্কভাবে নিজের কোলে রাখা দোতারাটায় একবার ‘টুং-টাং—কুডুং-কুডুং' শব্দের ধ্বনি তুলে বললেন— 'কিন্তু জানিস তো, আগাছা অমনি হয়, জমির যত্ন না নিলে অনেক ভালো চারাকেও আগাছায় ঘিরে ধরে বারোটা বেজিয়ে। এই আমাদের কিষেণের কতাই ধরো না কেন—আগাছার মধ্যে পড়ে বেচারার দু-কূলই তো যায় যায়—।' ফকির থামলেন, তারপর গলা তুললেন— 'ওরে বিষেণ, রাত হচ্ছে আমাগের মানুষ-গাচের গানটা ধরি দে দিকিনি।’ বিনাবাক্যব্যয়ে বিষাণ গান ধরে দিল, ফকিরও গলা মেলালেন—
মানুষ যদি হতেই চাও রে গাছ হও গো আগে 
গাছের মতো বেড়ে ওঠো রোদ জল হাওয়াতে।
মানুষ যদি হতেই চাও রে...... 
বক্ষ যেমন চায় না কিচুই – ফল-ফল দেয় পাতা
মরতে মরতেও কাঠ দিয়ে যায়— রোদ জলে হয় ছাতা 
মানুষ যদি হতেই চাও রে......
তরু যেমন ধরে রাখে সমুন্দরের ধারি
শিকড় দিয়ে রক্ষা করে নদী তীরের পাড়ি
মানুষ যদি হতেই চাও রে...... 

গৌর জানেন এসব গান প্রচলিত অর্থে ভাবাবেশের গান নয়। দেখলেন—তবু ফকিরের স্মিত মুখ, চোখদুটি বন্ধ। বিষাণ ও গানের বোলের অবসরে চক্ষু মুদে দোতারা বাজাচ্ছে, শটে তার লম্বা চুল ঝাঁকিয়ে ঢোলক বাজিয়ে চলেছে— চোখ খোলা, কিন্তু তারও বিশেষ কোনো দিকে লক্ষ্য আছে বলে মনে হলো না বিষাণ গাইছিল—
মানুষকেও হতে হবে এক-অপরের ছায়া 
শিকড় দিয়ে জাপটে ধরো তিন ভুবনের মায়া 
মানুষ যদি হতেই চাও রে......
হকিম আলি ফকির হলো ভেবে এসব কতা 
বক্ষেতে তার ঢেউ দিয়ে যায় সব-ভাঙানোর ব্যথা মানুষ যদি হতেই চাও রে......
হকিম বলে—একন থেকেই বাঁধনে দ্যাও মন
লোক-অলোকের নিত্যি বাঁধন সেটাই নিজির ধন
ভাঙার খেলা খেলছে যারা
(সেই) ভাঙ্-দত্যি বদাত্মাদের
তুরন্ত্ চিনে রাকো
নিজির ঘরের নিজ সমাজের
দেল-পাহারায় থাক 
মানুষ যদি হতেই চাও রে....

গান শেষ হতেই সকলে ‘হরিবল’ বলার বদলে ‘সাধু’, ‘সাধু' বলে ফুঁকরে উঠল। সুনন্দ তো উত্তেজনায় প্রায় দাঁড়িয়েই উঠছিলেন, গৌর তাঁকে হাত ধরে আবার টুলে বসিয়ে দিলেন।

বৃক্ষমানুষের ছায়া 
দুর্লভ সূত্রধর

শারদ নির্মুখোশ ১৪২৯

মহালয়ার একটু আগে

অলংকরণ : সৌজন্য চক্রবর্তী

#সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।