দুর্লভ খুদকুড়ো ৪। লিখছেন অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

সুপ্রকাশ প্রকাশিত দুর্লভ সূত্রধরের ‘আহাম্মকের খুদকুড়ো’র ধারাবাহিক পাঠ-আলোচনা লিখছেন অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী। আজ চতুর্থ পর্ব।
তাঁর অনুমতি নিয়ে আমরা নিজেদের টাইমলাইন থেকে শেয়ার করছি। এমন পাঠ-আলোচনাও দুর্লভ। 
....................................................

একটি ধারাবাহিক পাঠালোচনা    
সপ্তকাণ্ড রিপাবলিক 
রিপাবলিকের উপাখ্যান – হ্যাঁ, সাত পর্ব যুক্ত এই গ্রন্থের দীর্ঘতম এবং আশ্চর্যতম এই অধ্যায়টিকে উপাখ্যান ছাড়া অন্য কিছু আখ্যা দেওয়া অসম্ভব। আগাগোড়া স্নিগ্ধ কৌতুকে মোড়ানো বর্ণাঢ্য সব চরিত্র নিয়ে তৈরি হয়েছে এই উপাখ্যান। 
একটি ইস্কুলকে সমর-শৃঙ্খলায় আবদ্ধ স্পার্টান রাষ্ট্রের বিপ্রতীপে ঢিলেঢালা জনতান্ত্রিক এথেনিয়ান নগররাষ্ট্রের মহিমান্বিত রূপে দেখতে গেলে কল্পনার যে স্ফুরণ দরকার হয়, বুঝতে অসুবিধে নেই, দুর্লভ সূত্রধরের মধ্যে তা রীতিমতো বিদ্যমান। 
ঠিক কীরকম এই ইস্কুলটি? ‘পুরনো ঘর, আদ্যিকালের মতো গড়ন, ভাঙা ভাঙা দরজা, সংকীর্ণ অফিসঘর, …প্রায় ঘাসহীন অতীব ছোটো অঙ্গন, দেওয়ালে দেওয়ালে পরীক্ষায় টুকনক্রিয়ার কালিমা…’ 
সে এমনই এক ইস্কুল, যার ‘মান নিয়ে শহরজোড়া বাঁকা হাসি’; যে ইস্কুলে শহরের প্রতিটি পাড়ার সমস্ত সরকারি ও মিউনিসিপ্যালিটির প্রাইমারি স্কুলের ছেলেদের ‘ঝেঁটিয়ে’ এনে ভরে দেওয়া হয়; যে ইস্কুলে পাঠ্যসূচির বাইরে বহুতর বিষয় কিছু কম গুরুত্ব পায় না; যে ইস্কুলে ‘ফার্স্টবয় হরিদাস বা গ্রন্থ-বৈরি বুধো ঘোষের প্রতি’ স্কুলের ‘নির্দেশক নীতি’র সমান মনোযোগ; যে স্কুলের ছাত্ররা ‘তুচ্ছ ও মলিন দিনলিপির বাইরেও জীবনের অন্যতর মানে’ শিখতে পারে, যারা ‘জীবনের যাবতীয় অসাফল্য ও অসম্পন্নতাকে’ হেসে উড়িয়ে দিতে পারে; যে ইস্কুলের হেডমাস্টার বাগানের আম চুরির অভিযোগকে সূক্ষ্ম এক স্ট্রোকে অভিযোগকারীদের দিকেই ঘুরিয়ে দিতে পারেন; যে ইস্কুলে একমাত্র শাস্তিযোগ্য অপরাধ হল ‘হিংসুটে টুকলি’; যে ইস্কুলে যেতে পারা প্রতিটি ছাত্রের কাছে ‘মরণপণ সংগ্রাম’ – দু’একদিন যেতে না পারলে ছাত্রদের ভেতরে ছটফটানি জাগে। তেমনই এক স্কুল যদি আদর্শ রিপাবলিক না হয়, তবে তো পাঠককে প্লেটোর নামই ভুলে যেতে হবে। 
এই রিপাবলিক বা ইস্কুলের বিশিষ্ট আত্মাটির নির্মাতা ও রক্ষক হলেন ইস্কুলের স্যাররা, লেখক যাঁদেরকে ‘আর্কন’ অভিধা দিয়েছেন। 
কী সব স্যার এই ইস্কুলের! দু-চারটি মজাদার রেখার টানেই লেখক প্রত্যেকটি স্যারের চরিত্রকে স্বমহিমায় এঁকে ফেলেছেন। প্রথমত আছেন ‘অল ইন ওয়ান’ হেডস্যার। তাঁর পাণ্ডিত্যের কোনো ‘ছিরিছাঁদ’ নেই। তিনি ম্যাথ ও সংস্কৃত সমছন্দে পড়াতে পারেন। আবার প্রয়োজন হলে অর্থনীতির ক্লাসে ঢুকে ডায়াগ্রাম সহ দুরূহ সব তত্ত্ব বোঝাতেও তাঁর অসুবিধে হয় না। অন্যান্য শিক্ষকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে অথবা নিজের বাড়িতে উপাদেয় জলখাবারের টোপ দিয়ে এনে সাহিত্য, দর্শন, অর্থনীতি, হিসাবশাস্ত্র ইত্যাকার বিষয়ে তাঁদের জ্ঞানের ভারা পূর্ণ করে দেওয়া তাঁর অবসর সময়ের ব্রত ও বিনোদন। 
 
তারপর আছেন নিজের নামের ‘লক্ষণার্থকে ব্যর্থ করা’ রুদ্রবাবু স্যার। তিনি স্বয়ং এই রিপাবলিকের ‘নির্দেশক নীতি’। তারকাভর্তি সার্টিফিকেট নিয়ে যখন প্রথম তিনি এই ইস্কুলে যোগ দেন, তখন সবাই তাঁকে ‘ক্ষণিকের অতিথি’ ভেবেছিল। কিন্তু বৃদ্ধা মাকে দেখাশুনার অজুহাতে, না কি এই রিপাবলিকের মোহে পড়ে তিনি এখানেই স্থায়ী হলেন তা বোধ হয় স্বয়ং লেখকেরও জানা নেই। ক্লাসরুমের বাইরে বেরোলে তিনি গলায় সাইলেন্সার লাগিয়ে নেন, অথচ তাঁকে অফিসঘরের বারান্দায় দেখলেই ছাত্রদের যাবতীয় হট্টগোল স্তব্ধ হয়ে যায়, এমনই ছিল তাঁর ‘নীরবতার আদেশ’।
মণিবাবু স্যারের কথা বলাই বাহুল্য। তাঁর অনর্গল দর্শনাত্বক উপদেশাবলি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত দুর্লভ-সঙ্গি। আছেন ‘হিংসুটি টুকলি’ আবিষ্কারক পুরঞ্জয়বাবু স্যার, যিনি হেডস্যারের মাথাজোড়া টাককেই তাঁর বহুধাবিস্তৃত পাণ্ডিত্যের জন্য দায়ি করেন। আছেন চিরুনির অক্ষয় পরমায়ু-কামী সুধন্যবাবু স্যার, যাঁর ‘কোঁকড়া কোঁকড়া কুড়ো-লাগার মতো’ চুলে তিনি চিরুনি না লাগিয়ে দু-হাতের আঙুল দিয়ে বশে রাখেন।  
অতঃপর চুলকে ভরকেন্দ্রে রেখে এক একজন স্যারের বৈশিষ্ট্য উদঘাটন করার দুর্লভ কৌতুকীর সূচনা হল। নীরেনবাবু স্যার নিজের শখের চুল সত্ত্বেও টাকের গুণগান গেয়ে আনন্দ পান। সুমথবাবু স্যার সহশিক্ষকদের চুল দেখে ভবিষ্যবাণী করেন কে হবেন আইনস্টাইন, কে-ই বা রবিঠাকুর। আর নিজের নাতিবিস্তৃত টাক নিয়ে আক্ষেপ করে যান কেন তাঁর টাক হেডস্যারের মতো নির্চুলা হলো না! যার ফলে তাঁর পাণ্ডিত্যও হেডস্যারের মতো বহুধাবিস্তৃত হতে হতেও মাঝপথে আটকে গেল।
আরও আছেন ‘ব্যক্তিত্ববান ও নিষ্ণাত পণ্ডিত’ গোপেনবাবু স্যার, যিনি সর্বদাই নিজেকে গোপনে রেখে রিপাবলিকের সমস্ত অনুষ্ঠানকে সর্বার্থে সফল করে তোলেন। তাঁর অনুপ্রেরণায় বিশ্বকর্মা পূজার প্রদর্শনীতে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির মডেল তৈরিতে নামী ইস্কুলদের ম্লান করে দেয় রিপাবলিকের পাবলিকরা। দুঃস্থ ছাত্রদের এমনভাবে তিনি সাহায্য করেন যে কাকপক্ষীও জানতে পারে না সাহায্যকারীর পরিচয়। জীববিজ্ঞানের শিক্ষক গোপেনবাবুর দৃষ্টির গভীরতা, পড়ানোর ধরন ছাত্রদের আলাদাভাবে ছুঁয়ে যায়। তারা বোঝে, ‘পৃথিবীটা শুধু মানুষের নয় – সব প্রাণীর, সীমাহীন জীববৈচিত্র্যের, বস্তু ও প্রাণ নিয়ে বিরাট এই বিশ্বব্যবস্থা’। 
সুধন্যবাবু যথার্থই বলেন, “গোপেনদার ব্যাপারই আলাদা, বাজারের ফিতে দিয়ে ওঁকে মাপা যায় না”। 
 “আবার এই রিপাবলিক-কমিউনিটিতে চোরা-গোপ্তা অনেক বিপরীত স্রোতও ছিল। স্যারেদের মধ্যে বন্ধুত্ব আর মতভেদের এক চমৎকার মিশেল ছিল।” 
স্যারেদের উপাখ্যানের এই হল উপসংহার। কিন্তু রিপাবলিকের গল্প এখনও বাকি। সে কথা হবে পরের পর্বে।

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।