নির্মুখোশ শারদ ১৪২৯

আঁতঘরার গঞ্জ-বাজারে মোট তিনজন ডাক্তারবাবু ছিলেন–বিপুল ডাক্তার, উপেন ডাক্তার, বিপিন ডাক্তার। তিন ডাক্তার তিন ধারার। বিপুল ডাক্তার ছিলেন সেকালের এল এম এফ পাশ, বিপিন ডাক্তার ছিলেন এল এম পি আর উপেন ডাক্তারের ঘরের বাইরে একটা কালো রঙের কাঠের টুকরোয় সাদা রঙ দিয়ে ঈষৎ আঁকাবাঁকা হরফে লেখা থাকত আর এম পি। এর কোনোটার মানেই ঐ জনপদের কেউ বুঝত বলে মনে হয় না। এসব বোঝা না বোঝায় কারোরই কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি ছিল না। আঁতঘরার মতো গ্রামীণ জনপদগুলিতে রোগ-রুগি-ডাক্তার–সকলেই দিব্যি সহাবস্থানে ছিল।
আঁতঘরা গঞ্জ হলেও তার একপাশে হাতার মধ্যেই ছিল দু-দুটি রাজ্য সড়ক, আর এক পাশে কংসাবতী নদীর সবচেয়ে চওড়া খাত। কাছাকাছি দু-চারটি শহরের সড়কবাহিত ও নদীবাহিত সমস্ত মাল আঁতঘরার সড়কের মোড়ে বা নদীর ঘাটে খালাস করা হতো। মনুষ্যচালিত যানে চেপে সেগুলি যেত কাছাকাছি জনপদগুলিতে। নদীর ধারের জায়গাটার নামই ছিল গোলাবাজার। এখানে বড়ো বড়ো ব্যবসায়ীদের মালের গোলা বা গুদাম ছিল। ফলে আঁতঘরার গঞ্জবাজারে লোকের আনাগোনার অভাব ছিল না। সেই সঙ্গে দেশে তখনও অভাব ছিল না ঘরে ঘরে ম্যালেরিয়া, ডায়েরিয়া, পাঁচড়া, এলার্জি, হাঁপানি, চর্মরোগ বা ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো নানাবিধ জ্বরজ্বারির। তখন এই ধরনের জনপদগুলিতে রাজকীয় রোগ হিসেবে ব্রঙ্কাইটিস আর নিউমোনিয়ার নামও খুব শোনা যেতো।
বিপুল ডাক্তারের বিপুল প্র্যাকটিস একা-হাতে সামলাতো আমাদের সর্বজনপ্রিয় ছুটকুদা। কিন্তু একা ছুটকুদাই কম্পাউন্ডার ছিল না, এই গঞ্জে তিন ডাক্তারবাবুর তিনজন কম্পাউন্ডার। ছিলেন উপেন ডাক্তারের কম্পাউন্ডার বুড়ো সুদাম খ্যাপা, এমন-কী যে বিপিন ডাক্তারের সকালে-বিকেলে দশটার বেশি রুগি হতো না– সেই বিপিন ডাক্তারেরও একজন কম্পাউন্ডার ছিলেন, ফটিকবাবু। বিপিন ডাক্তারের কম্পাউন্ডার পোষার ক্ষমতা ছিল না, কিন্তু গঞ্জের অন্য-দুই ডাক্তারের কম্পাউন্ডার থাকায় মান রক্ষার দায়ে তাঁকেও ফটিকবাবুকে রাখতে হয়েছিল। ফটিকবাবু দুবেলা বিপিন ডাক্তারের বাড়িতে খেতেন, বিপিন ডাক্তারের গরু-বাছুর-গোয়ালঘর দেখাশোনা করতেন, বাজারের পাশে যে সাপ্তাহিক হাট ছিল প্রত্যেক বিষ্যুদ্‌বার সেই হাট ভাঙার মুখে ডাক্তারবাবুর স্ত্রী মনোরমার করে দেওয়া লিস্টি-অনুযায়ী অবিশ্বাস্য কম দামে গার্হস্থ্যদ্রব্য সংগ্রহ করতেন। অন্য দিকে উপেন ডাক্তারের কম্পাউন্ডার সুদাম ঘোষের অনেক বয়স হয়েছিল। ডাক্তারবাবুর রোগীঘরের এককোণে ভাঙাচোরা আলমারির আড়াল দেওয়া জায়গায় ক্ষীণ আলোয় মোটা কাচের চশমাওয়ালা চোখ কুঁচকে তিনি ওষুধ বানাতেন। লোকে বলত– ‘সুদাম খ্যাপার বানানো ওষুধের জোর আছে।’
ওষুধ-টষুধ পরের কথা আসলে সুদাম ঘোষকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক কারণে গঞ্জের চতুর্দিশির মানুষজন পছন্দ করতেন। তিনি কথা বলতেন কম, হাসতেন আরও কম। কিন্তু এই মানুষটাই রাত্রি ন-টার পরে বাজারের শূন্য-চালায় কুপির আলোয় সঙ্গীসাথী নিয়ে যখন নিত্যি বাউল গানের আসর বসাতেন, তখন একতারা, দোতারা, খোল-পাখোয়াজ, ঢোল, ঘুঙুর, মন্দিরা, গাবগুবাগুবের সমবেত বাদন ছাড়িয়ে সুদাম ঘোষের উদাত্ত, তীক্ষ্ন কণ্ঠ পেরিয়ে যেত গ্রামের উদলা মাঠ, কংসাবতীর জল-ছুঁয়ে তা নদীর ওপারের পল্লীকেও আবিষ্ট করে তুলত। সুদাম ঘোষের থেকে তাঁর নাম সুদাম খ্যাপা হয়েছিল এই বাউল গানের কল্যাণেই। তাঁকে অনেকেই সাধকের কোঠায় ফেলে শ্রদ্ধা করত। ফলে সুদাম খ্যাপার হাতে তৈরি ওষুধ নেবে বলেই তারা উপেনবাবুর মতো ‘চিপা’ ডাক্তারের কাছে আসত, তাদের একাংশের ধারণা ছিল– সুদাম খ্যাপার হাতের ওষুধের সঙ্গে মুফতে কিছুটা ঈশ্বরের আশীর্বাদও পাওয়া যায়।
আসলে সেকালে কম্পাউন্ডারেরা কোনো কোনো ক্ষেত্রে ডাক্তারবাবুদের থেকেও জনসমাজে বেশি পরিচিত ছিলেন, তাঁদের সম্মানও ছিল খুব। সকলেরই বিশ্বাস ছিল– ডাক্তারবাবুদের মতো তাঁরাও চিকিৎসাবিজ্ঞানের অনেক খবর জানেন। এই বিশ্বাস খুব একটা অমূলক ছিল, তা বলা যায় না। কেননা, শহরের প্রত্যেকটি ওষুধের দোকানে তখন একজন করে কম্পাউন্ডার থাকতেনই। এবং শহরের অধিকাংশ কম্পাউন্ডারবাবুই ছিলেন রীতিমতো পাশ করা এবং লাইসেন্সপ্রাপ্ত কেমিস্ট। তাঁদের একটি সইয়ের মূল্য ছিল। শহরের ওষুধ ব্যবসায়ীদের কাছে এঁদের চাহিদা ও কদর ছিল খুব। অন্যদিকে একজন ব্যস্ত চিকিৎসক একজন দক্ষ কম্পাউন্ডারের মূল্য বুঝতেন। 
আঁতঘরার তিনজন কম্পাউন্ডারের ব্যাপারটা অবশ্য আলাদা ছিল। তাঁরা পাশ-করা ছিলেন না। রসায়নও তাঁরা জানতেন না। তাঁরা জানতেন সাধারণ ও প্রচলিত রোগে ব্যবহৃত ওষুধপত্রের নাম, এবং তার সহজ মিশ্রণ-পদ্ধতি। ডাক্তারবাবুরাই তাঁদের শিখিয়ে-পড়িয়ে নিতেন। পরে কাজ করতে করতে, রোগ-রুগি দেখতে দেখতে, ওষুধ ঘাঁটতে ঘাঁটতে তাঁদেরও বিস্তর অভিজ্ঞতা হয়েছিল।     

ডাক্তারবাবুর পাইলট
স্বাতী দাস 

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা

নির্মুখোশ শারদ ১৪২৯
প্রচ্ছদ ও অলংকরণ : মেখলা ভট্টাচার্য

#সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।