নির্মুখোশ শারদ ১৪২৯

জানুয়ারির শেষ সপ্তাহের একটি রাত্রিবেলা আমাদের টাউনের গা ঘেঁষা কান্ট্রি রোডস অ্যাসাইলামে আগুন লেগে হাসপাতাল, ডাক্তারখানা ও রোগীদের বাসগৃহ ভস্মীভূত হয়ে গেল। চার মৃতদের মধ্যে দুজন ছিল হাসপাতালের স্টাফ, একজন বুড়ো রোগী ছিল। চতুর্থজন পুবের পাহাড়ের প্রান্তবর্তী রেজারেকশন ভিলা নামক হোমস্টের কর্ত্রী ধৃতি সান্যাল, তাকে সবাই নিনি বলে চিনত। এছাড়া কয়েকজন খাতায় কলমে নিখোঁজের তালিকায়, যাদের মধ্যে ছিল চোদ্দ বছর বয়েসের কিশোর রোগী সায়ম অগাস্টিন গোমস। 

আমাদের টাউন পাহাড় ও জঙ্গলের কোল ঘেঁষে, যার হলুদ মাঠ ও মহুয়ার বন নীল আকাশ কাঁধে হাহা অন্তরঙ্গে ছুটে আসে, বুকের ঠিক মাঝখানে প্রকাণ্ড রক্তক্ষতের মত সূর্য, সূর্য ঝরে যায়। দীর্ঘ গোলাপের অবসানের মতো সে পেছনে চলে গেলে শালমহুয়ার জঙ্গল, শুকনো নালা, জমজমে মাঠে আগুন জ্বলে ওঠে। আলু ক্ষেতে সন্ধ্যা ঘুলিয়ে উঠলে ধোঁয়ার পরত আচ্ছন্ন রাখে টাউনকে, জমাট অন্ধকারে আমাদের শ্বাস ঘন হয়ে আসে। তখন দেহাতীপাড়ার ছোট্ট খোকা জন্মের সাতদিনের মাথায় শ্বাস টানতে টানতে নীল হয়ে মরে গেলে তাকে ক্যাথাকানি শুদ্ধ গোর দেওয়া হয় শিশুদের কবরখানায়। ঝুরঝুরে কালো মাটির নীচে চাপা পড়ে যায় হলুদ সব। অনেকদিন পর মাটি খুঁড়লে দেখা যায়, কঙ্কালের মাথায় ছোট্ট শিং গজিয়েছে দুটো। গুনগুন করে যেদিন থেকে এই গল্পগুলো ঘন হয়ে এল, তবে থেকেই সন্ধেগুলোও অন্যরকম হয়ে গেল। শিংওয়ালা বুড়িটা, যে অ্যাসাইলামে কাজ করত আর বিকেলবেলা কোথায় উধাও হয়ে যেত কেউ জানে না, সে কিছু টের পেত কিনা কে জানে ! সকালের ঝিকানো আলোয় খুব হাসত। 

অ্যাসাইলাম ছিল জঙ্গলের ধারে। তার রাত্রিবেলা উজাড় করে দিত অসংখ্য অদম্য গাছগাছালির দেয়ালা। তার উঁচু দেওয়াল সদর্পে ঘিরে রাখে ওধারের অপর, সহসা তাকালে শূন্যপুরাণ আকাশ বাদে কিছু চোখে পড়ে না। পাঁচিল ছিল পাথরের, পাশ ঘেঁষে ওয়াচটাওয়ার। সশস্ত্র রক্ষীদল সেখান থেকে শহর দেখত– সাপের মতো পাহাড়ি রাস্তা ওঠে পাক খেয়ে, তার ধারে জঙ্গলে ঢাকা সেন্ট অলবানস গির্জাকে দেশলাই বাক্স মনে হয়। আরেকটা ওয়াচটাওয়ার ছিল কম্পাউন্ডের পাঁচিল জঙ্গলের যেদিকে মিশে গেছে তার কোলে, আমরা পাগলাটাওয়ার বলতাম, যেহেতু উন্মাদভবনের রোগীদের কেউ কেউ সেখান থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। আর ছিল কমপাউন্ডের ভেতর মাঠ, ক্ষেত, বাজার, কোয়ার্টার। রাত্রে সেখান থেকে পাগলদের চিৎকার ভেসে আসে, খুলে ছড়িয়ে যায় গোটানো স্তব্ধতার উল, আমরা ঘুমের মধ্যে পাশ ফিরে শুতে শুতে হাই তুলব জানি। মেঘ ও মশাদের দল আমাদের শহরকে স্মৃতির মত জাপটে ধরার কয়েকবছর পেরিয়ে গেল। 

উপন্যাস

গোলাপ ও উন্মাদের সুসমাচার
শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য 
 
নির্মুখোশ শারদ ১৪২৯

অলংকরণঃ ইন্দ্রনীল বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রচ্ছদঃ মেখলা ভট্টাচার্য
#সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।