দুর্লভ খুদকুড়ো ১। লিখছেন : অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

সুপ্রকাশ প্রকাশিত দুর্লভ সূত্রধরের ‘আহাম্মকের খুদকুড়ো’র ধারাবাহিক পাঠ-আলোচনা লিখছেন অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী। তাঁর অনুমতি নিয়ে আমরা নিজেদের টাইমলাইন থেকে শেয়ার করছি। এমন পাঠ-আলোচনাও দুর্লভ। 
....................................................

একটি ধারাবাহিক পাঠালোচনা 

 ১
 দুর্লভ খুদকুড়ো

মিহির সেনগুপ্তের সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম যখন সুপ্রকাশ থেকে নবরূপে প্রকাশিত হল, তখন আমি ‘পরবাস’ ওয়েবজিনে বইটি নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। মিহিরের স্মৃতিগদ্যের স্বরূপ নির্ধারণ করতে গিয়ে সেখানে বলেছিলাম যে বাংলাসাহিত্যের স্মৃতিগদ্যের নবকিশোরীর মতো সলজ্জ মেদুর চলনরেখায় মিহিরের গদ্য বাঁধভাঙ্গা জলের মতো তৎসম-চান্দ্রদ্বীপি বাকবন্ধের ঢেউ তুলে এক পৌরুষ গতির সঞ্চার করেছে।আজ দুর্লভ সূত্রধরের আহাম্মকের খুদকুড়ো পড়া শেষ করার পর প্রথম যে কথাটা মাথায় আসছে, সেটা হল, স্মৃতিগদ্যের আরও একটি স্বতন্ত্র এবং বিশিষ্ট চলন যুক্ত হল বাংলাসাহিত্যে। 
মিহিরের গদ্যের সঙ্গে দুর্লভ সূত্রধরের গদ্যের মিল যৎসামান্য। যেটুকু আছে সেটা কৌতুকপ্রবণতায়। কিন্তু প্রথম জনের উচ্চকিত পরিহাস যেখানে রক্ষণশীলতার বেড়া ভেঙ্গে আলি সাহেবের রঙ্গরসিকতাকে মনে করিয়ে দেয়, দুর্লভের কৌতুকবোধ সেখানে এক স্নিগ্ধ রসসিঞ্চনে তাঁর গদ্যকে সরসতায় ভিজিয়ে রাখে। এই কৌতুকের বেশিটাই নিজের এবং তাঁর নিজকৃত সংজ্ঞালব্ধ আহাম্মকদের প্রতি সস্নেহ বিদ্রুপ-সঞ্জাত। 
কে বা কারা আহাম্মক? লেখক তিনটে সূত্র ধরিয়ে দিয়েছেন পাঠককে। এক তো খুদকুড়ো জমানোর মস্তকহীন আহাম্মক, যার হাত থেকে কাকেরা জিলিপির ঠোঙা কেড়ে নেয়, লুডো খেলতে গিয়ে যে ছক্কার বদলে কেবলই পুট ফেলে যায়, যে বিড়াল-কুকুরের আঁচড়-কামড় খায়, এমনকি শেয়ালও যাকে শিকার করার তালে থাকে এবং যার কপালে লেমনি স্নিকেটের ব্ল্যাক কমেডির নায়ক হওয়া অবধারিত থাকে। দ্বিতীয় আহাম্মক হল ফ্লবেয়ার সংজ্ঞায়িত ইডিয়ট, ‘দোজ় হু ডিফার উইথ ইউ’; হাওয়া না বুঝেই যে নিজের মত প্রকাশ করে বসে। তিন নম্বর আহাম্মক হল এথেনিয়ান রিপাবলিকের দাস-রূপী লেখকের স্কুলের সাদামাটা ছাত্ররা, যারা চিরকাল মঞ্চের আলোর বাইরে থেকে মঞ্চকে আলোকিত করার যাবতীয় দায়িত্ব পালন করার ফুর্তিতে ডগমগ হয়ে থাকে।
এই তিন সুত্রের বাইরে আমরা অন্য এক ইডিয়টকেও জানি যার কথা লেখক সরাসরি বলেননি কিন্তু লেখকের ডুমোটোলার দাদু সেটা প্রকারান্তরে বলে আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছেন লেখক ঠিক কোন গোত্রের আহাম্মক। এই ইডিয়ট দস্তয়ভস্কির, যে মনশ্চক্ষে দেখতে পায় মানুষের ভেতরে লুকিয়ে থাকা তার আনন্দ-বেদনার মণিমুক্তামণ্ডিত অবিকৃত হৃদয়টিকে। দাদু বলেছেন, “…তোমার জমানো খুদকুড়োর মধ্যে আছে কত লোকের জীবনের দিনরাত,…কতজনের কত কথার কত শব্দ, দিল কি বাত, কতজনের কত গান…,”। তাই শেষ পর্যন্ত স্নিকেটের ‘ধারাবাহিক দুর্ভাগ্যমালা’ না হয়ে আহাম্মকের স্মৃতির সেইসব খুদকুড়োই সময়ের এপারে এসে অন্য এক গল্প-কাহিনি হয়ে উঠেছে। 
এসব নাকি নেহাতই অনাবশ্যক কথা আর এই অনাবশ্যক কথা দিয়েই দুর্লভ তাঁর এই স্মৃতিগ্রন্থের সূচনা করেছেন। তবে পাঠকের মনে হতে পারে সূচনার অনাবশ্যক কথা দিয়ে তিনি সমগ্রের সুরটি বেঁধে দিলেন। পাঠকমনকে তিনি এক সরস অথচ ব্যঞ্জনাময় স্মৃতিগল্প পাঠের জন্য প্রস্তুত করে তুললেন। 
(চলবে)

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।