শেষ মৃত পাখি। শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য

'মদনমোহন ধিংড়া আমাকে বহাল করেছিলেন। দিল্লির বাসিন্দা। সুপ্রিম কোর্টের উকিল ছিলেন। বাড়িটা  বানিয়েছিলেন ছুটিছাটায় আসবেন বলে। প্রতিদিন সকালবেলা ছটার মধ্যে চলে আসি। দশটার মধ্যে ফিরে যাই। যখন সাহেবরা থাকতেন, তখন সারাদিন। না থাকলে, ওই তিন-চার ঘণ্টার জন্য। তবে আজকাল তো কাজ থাকেও না তেমন। ধিংড়া সাহেব চোখ বোজার আগেই একটা ট্রাস্ট বানিয়ে গিয়েছিলেন, যার থেকে বিভিন্ন এনজিও, সমাজসেবামূলক প্রকল্প ইত্যাদিতে অনুদান দেওয়া হতো। আমার মাইনেও আসত সেই ট্রাস্ট থেকেই।  দিব্যি চলছিল। কিন্তু সাহেব চোখ বুজবার পর কিছুদিন যেতে না যেতেই সম্পত্তির দখল নিয়ে ধিংড়ার তিন ছেলের মধ্যে লাগল লাঠালাঠি। সাহেব যেহেতু উইলে এই বাড়ি কোন ছেলের ভাগে পড়বে লিখে যাননি, তিনজনেই বলে এই বাড়ি তার। মাঝখান থেকে হলো কী, বাড়ি ডিসপুটেড হয়ে গেল। কেউ তার রক্ষণাবেক্ষণ করে না। মেরামতির টাকা দেয় না। ইলেক্ট্রিকের লাইন কেটে দিল। জল বন্ধ করে দিল। কিন্তু আইনের কী একটা মারপ্যাঁচে ট্রাস্টের টাকা আমার কাছে আসা আজও বন্ধ হয়নি। প্রতি মাসে নিয়ম করে ব্যাঙ্কে টাকা জমা পড়ে। ধিংড়া সাহেব ঝানু উকিল ছিলেন, এমন কলকবজা করে গিয়েছিলেন যে ডিসপুটেড ল্যান্ডের কেয়ারটেকার এখনও মাইনে পায়। তাঁর মৃত্যুর পঁচিশ বছর পরেও।' কপালে হাত ঠেকিয়ে নমস্কার করলেন রামবীর। 

'ভেতরটা দেখা যায়?'  

'চলুন। টুরিস্ট পার্টিরা আগে এসে থাকত এখানে। সাহেব ভাড়া দিতেন। আমি সকালবেলা এসে তাদের ফাই-ফরমাশ খেটে দুপুরে নিজের ডেরায় ফিরে যেতাম। ডিসপুট হবার পর থেকেই সব বন্ধ। তবে হ্যাঁ, দেখার মতো বাড়ি বানিয়েছিলেন বটে! জানালার কাচ প্রতিদিন পরিষ্কার করবার কঠোর নির্দেশ ছিল। যাতে কুয়াশা লেগে লেগে ঝাপসা  না হয়ে যায়। সাহেবের শখ ছিল দামি কাচ দিয়ে বাড়ি সাজানো। একবার আমাকে বলেছিলেন, ‘রামবীর, তোমার মাইনে জানালার কাচ পরিষ্কার করবার জন্যই আসে। ওটা মন দিয়ে করে যাও।’ আসুন, এইদিক দিয়ে। সাবধানে আসবেন, ঝোপে বড্ড কাঁটা।'

বাড়ির ভেতর বড়ো হলঘরটা, ড্রইং রুমই বলা চলে, ধ্বংসস্তূপ। ধুলোয় আচ্ছন্ন পরিবেশ। পেল্লায় সোফা উলটে আছে। মেঝের ওপর লুটোচ্ছে ভাঙা বালবের কাচ। দুটো ফ্যান ব্লেডবিহীন অবস্থায় একপাশে রেখে দেওয়া। শুধু কয়েকটা চেয়ার এখনও আস্ত আছে। একটা গোল টেবিলকে ঘিরে সাজানো। হলের যেদিকে দরজা তার ঠিক উলটোপ্রান্তে মুখোমুখি বড়ো জানালা। জানালার নীচ দিয়ে খাদ নেমে গেছে। কাচ ভেঙে ছড়িয়ে আছে এখানে ওখানে। মাঝখান থেকে উঠে গেছে সিঁড়ি। আমরা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠলাম। 

'সাহেবের এক মেয়ে ছিল। অল্প বয়সে মারা যায়। বাবার নয়নের মণি ছিল সে। তার ঘরটা এই বাড়ির সেরা ঘর ছিল। সে চলে যাবার পর সাহেব ওই ফাঁকা ঘর সহ্য করতে পারতেন না। বলে দিতেন, টুরিস্ট পার্টি ভাড়া নিলে যেন ওই ঘরটায় রাখি। তাতে যদি মেয়ের সব স্মৃতি মুছে যায়, তাতেই সাহেব স্বস্তি পাবেন। এই যে, সেই ঘর।'

ঠিক সিঁড়ির মুখেই তালাবন্ধ দরজা। কোমর থেকে চাবির গোছা খুলে একরাশ চাবির মধ্যে থেকে বেছে বেছে বার করলেন রামবীর। ক্যাঁচ করে দরজা খুলে গেল। বড়ো ঘরের মধ্যে কিং-সাইজ সেগুন কাঠের খাট। দুই দেয়াল ভরতি টানা ওয়ার্ডরোব। দেখলে বোঝা যায়, সময়কালে জাঁকজমক ছিল এই ঘরের। দুটো বড়ো জানালা। অ্যাটাচড বাথরুম। বর্তমানে ধুলোয় ছেয়ে আছে সমস্তকিছুই। বাথরুমের দরজা জ্যাম হয়ে আছে। আয়নার কাচে কয়েক দশকের ঝুল পড়ে প্রায় কিছুই দেখা যাচ্ছে না। দুটো উঁচু ফ্যান। পুরো জায়গাটার মধ্যেই একটা দমচাপা ভাব। সম্ভবত অনেকদিন বাদে দরজা খোলা হলো। 

'সাহেবের মেয়ের ছিল বার্নিশের গন্ধে অ্যালার্জি। এই ঘরে কাঠ বলতে তখন কিছু ছিল না। সব স্টিলের। অনেক পরে সাহেব একবার ভেবেছিলেন বাড়ি বিক্রি করে দেবেন। তখন পাহাড়ে অশান্তি শুরু হয়েছে। অনেক ফ্যামিলি  নীচে নেমে যাচ্ছে। কিন্তু কিছুদিন পর যখন শান্ত হল সবকিছু, মত বদলে ফেললেন। ঠিক করলেন রিটায়ারমেন্টের পর এখানেই মেয়ের স্মৃতি নিয়ে বাকি জীবনটা কাটাবেন। এই খাট, ওয়ার্ডরোব, সব কিছু স্পেশাল অর্ডার দিয়ে বানালেন। ভাগ্যের ফের। এক বছরের মধ্যেই চলে গেলেন। কে আর ভোগ করবে এসব! ভূতের বাড়ি হয়ে গেল আস্তে আস্তে।' 

সিদ্ধার্থ ফিসফিস করে বলল, 'আর কতক্ষণ দাঁড়াবেন এখানে? আমার ডাস্ট অ্যালার্জি আছে। আপনার সময় লাগলে আমি নীচে গিয়ে অপেক্ষা করছি।'

 'যাচ্ছি।'

বেরোতে যাব, হঠাৎ খাটের পাশের দেয়ালটায় চোখ চলে গেল এবং স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। 

আমার মুখের অবস্থা দেখে 'কী হয়েছে' বলে সিদ্ধার্থ  আমার চোখের দৃষ্টি অনুসরণ করে নির্বাক হয়ে গেল কয়েক মুহূর্তের জন্য। 

খাটের যে দিকটা মাথার দিক, তার দেয়ালে, খাটের সামান্য ওপরেই লাল আর কালো রং-পেনসিল দিয়ে দুটো মূর্তি আঁকা। একটা মূর্তি দুই হাত তুলে দাঁড়িয়ে। আর-একটা টুপি পরা মূর্তি তাকে গুলি করছে। তার হাতে বন্দুক। দুই হাত তুলে দাঁড়ানো মূর্তির মাথার ওপর ইংরেজিতে লেখা, ‘অমিতাভ’। 

শেষ মৃত পাখি
শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য

প্রচ্ছদঃ সৌজন্য চক্রবর্তী
মুদ্রিত মূল্যঃ ৫২০ টাকা

#সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।