দুর্লভ খুদকুড়ো ২। লিখছেন অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

সুপ্রকাশ প্রকাশিত দুর্লভ সূত্রধরের ‘আহাম্মকের খুদকুড়ো’র ধারাবাহিক পাঠ-আলোচনা লিখছেন অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী। আজ দ্বিতীয় পর্ব।  তাঁর অনুমতি নিয়ে আমরা নিজেদের টাইমলাইন থেকে শেয়ার করছি। এমন পাঠ-আলোচনাও দুর্লভ। 
....................................................

একটি ধারাবাহিক পাঠালোচনা 
                                   ২ 
শিয়ালে খাওয়া কুলে পোকার সোনার নাগরা দর্শন 

যাকে শিয়ালে খায় তার ‘কুলে পোকা’ হতে বাধ্য এবং সোনার নাগরা দর্শনও তার অবধারিত। এ-সবই আহাম্মকের সাধারণ লক্ষণ। 
শিয়াল প্রসঙ্গে আমার ছোটবেলার কথা মনে এসে যায়। আমি একদা অজ গাঁয়ের এক হাঁ-করা বালক ছিলাম। এই হাঁ করে থাকা অতি সন্দেহজনক লক্ষণ এবং সর্বদা যার মুখ হাঁ হয়ে থাকে তাকেও যে আহাম্মক আখ্যা দেওয়া যায়, সেটা দুর্লভ সূত্রধর প্রকারান্তরে একটু পরেই বলে দেবেন। 
তো আমাদের বাড়িতে হাঁস পোষার চল ছিল। গোয়ালের এক পাশে হাঁসের খোঁয়াড়। সেই খোঁয়াড়ে নদী-বাঁধের লকগেটের মতো কাঠের পাতলা তক্তার দরজা ছিল। উপরের দিকে আটকানো দুটি বাঁশের ফাঁক দিয়ে দরজাটিকে নামিয়ে দিলেই খোঁয়াড় বন্ধ। ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই খোঁয়াড়ের ভেতরে প্রবল প্যাঁকপ্যাঁক। কেউ একজন ছুটে এসে দরজাটিকে টেনে উপরে তুলে দিতেন। অমনি তারা খোঁয়াড় থেকে বেরিয়ে লাইন দিয়ে খিড়কির পুকুরের দিকে হেলেদুলে চলতে শুরু করত। মরাল-গমনের মাঝে মাঝে কেউ কেউ আবার দুই ডানা মেলে দ্রুতগামী হয়ে আগেভাগে পুকুরের জলে ঝাঁপ মারত। আবার দিনের আলো নিভে গেলেই পুকুর ও তার আনাচকানাচ থেকে সব হাঁস খোঁয়াড়ে ঢুকে যেত। একজন কেউ গুনতির দায়িত্বে থাকতেন। গুনতিতে কম পড়লেই শিয়ালে খাওয়া নিয়ে হইচই হত। বর্ষা-হেমন্তে ঝোপঝাড়ের বাড়বাড়ন্ত, মাঠও ভর্তি বেড়ে ওঠা ধানগাছে। সেই দুর্ভেদ্য ক্ষেত্রে শিয়ালের খোঁজে কুকুরের পাল সহ দুরন্ত বালকবাহিনীও সুবিধে করত পারত না। হাঁসেদের মধ্যেও আহাম্মক থাকে, তারা আবার গেঁড়ি-গুগলি বা ধানের কচি দানার লোভে ধানভরা মাঠে ঢুকে পড়ে এবং শিয়াল ‘স্পেশালিষ্ট’ ডুমাটোলার দাদুর ভাষায় শিয়াল তাদের ‘বড়ি সাফাইসে’ তুলে নিয়ে চলে যায়। কখনও কখনও এমনকি, রাতের বেলায় রহস্যজনকভাবে খোঁয়াড়ের গেট আলগা করে দু-একটাকে নিয়ে বহুত বড়ি সাফাইসে ভেগে যায়। 
হাঁস নিয়ে এত কথা কেন? কেননা হাঁস না থাকলে শিয়াল আসবে না। এবং শিয়াল নিয়ে চর্চা না হলে এমন কোনো বালকের কথা মাথায় আসার সম্ভাবনা নেই যাকে কিনা শিয়ালে খেয়েছে। এই প্রসঙ্গে ইতি টানার আগে দুঃখের সঙ্গে স্বীকার করছি, আমার গ্রামের এমন কোনো বালকের কথা আমার মাথায় এল না, যে শিয়ালের শিকার হয়েছিল। 
অতএব শিয়ালে খাওয়া বালক বিখ্যাত হতে বাধ্য। এমন অদ্ভুতকর্মা বালককে দেখতে জনে জনে ছুটে আসবে বা তাকে দেখলেই মনে পড়বে এই সেই বালক যাহাকে শৃগালে খাইয়াছিল – এ তো বলাই বাহুল্য। 
ডুমোটোলার দাদু বলেছিলেন, “শেয়ালের কামড় ইতনা  খরাব নেহি”। 
দুঃখের বিষয় তিনি যতটা পণ্ডিত ও দার্শনিক, ততটা রসিক বোধহয় ছিলেন না। তাই তিনি বালকের বিখ্যাত হওয়ার গৌরবকে গুরুত্ব না দিয়ে দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে শেয়ালের কামড়কে শংসাপত্র দিয়েছিলেন।
ইস্কুলে যাওয়া না-যাওয়ার ‘কান্না বিষয়ে মনীষী-বাক্য’ জানে না বলে সেই বিখ্যাত বালকের ইস্কুল যাওয়ার বায়না করে কান্না জুড়তে কোনো সমস্যা হল না। অতএব বালককে ইস্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হল। কিন্তু প্রথম দিনেই হাঁ করে(যা বলেছিলাম)দরজার দিকে তাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মাস্টারমশাই তার মাথায় টোকা দিয়ে জীবনের জটিলতম প্রশ্নটি করে বসলেন, “মন থাকে কোথায়?” 
লেখকের কৌতুকবোধ নিমেষেই কীভাবে গভীর নান্দনিকতার সঙ্গে মিলেমিশে এগিয়ে যেতে পারে পাঠক এখানে তার ছোট্ট একটু নমুনা পেয়ে যাবেন। এরপরই বালকের ‘কুলে পোকা’ জনিত কান্না বা পরবর্তী সময়ে সোনার নাগরা জুতোর ছাইদানিতে বদলে যাওয়ার আজব কাণ্ড ইত্যাদি বৃত্তান্ত বিশদ করলে বইটি পড়ার টাটকা আনন্দলাভ থেকে পাঠককে অনেকটাই বঞ্চিত করা হবে। এই পর্বে লেখকের হিউমার-এর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়াই উদ্দেশ্য ছিল। বাকি যেসব অবান্তর প্রসঙ্গ এল সেসব তাঁর লেখার ধরনকে অনুকরণ করার চেষ্টা মাত্র। পাঠক নিজের চোখে খুদকুড়ো চেখে দেখলে তবেই তার প্রকৃত আস্বাদ পাবেন। 
(ক্রমশ)

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।