দুর্লভ খুদকুড়ো ৫। লিখছেন অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

সুপ্রকাশ প্রকাশিত দুর্লভ সূত্রধরের ‘আহাম্মকের খুদকুড়ো’র ধারাবাহিক পাঠ-আলোচনা লিখছেন অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী। আজ পঞ্চম পর্ব।
তাঁর অনুমতি নিয়ে আমরা নিজেদের টাইমলাইন থেকে শেয়ার করছি। এমন পাঠ-আলোচনাও দুর্লভ। 
....................................................

একটি ধারাবাহিক পাঠালোচনা     
                           ৫
দাসদের মজারু তত্ত্ব এবং অনাদরের স্বাধীনতা 


রিপাবলিকের দাসদের যোগ্য প্রতিনিধি শিবহরি। কেননা দাস দশা থেকে কোনোদিন উত্তরণ ঘটেনি তার। তা সত্ত্বেও সে কিন্তু নিজের জন্য একটি সচ্ছল ও আনন্দময় জীবন নিজের যোগ্যতায় তৈরি করে নিয়েছিল।  
তার আগে জানানো দরকার, কারা রিপাবলিকের দাস। পঞ্চম থেকে সপ্তম শ্রেণির অগণন ছাত্র যারা রিপাবলিকে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ তারাই রিপাবলিকের নীতি অনুসারে দাস শ্রেণিভুক্ত। সপ্তম শ্রেণিতেই ঝরে যাওয়া শিবহরির শিক্ষার ভারা যে অপূর্ণ থাকেনি তার মূলে ‘অনাদরের স্বাধীনতা’। সেই গল্প পাঠক বইটি খুলে পড়ে নেবেন, আমি শুধু এটাই জানিয়ে রাখি যে এই শিবহরিই উপযুক্ত সংজ্ঞা সহযোগে আহাম্মকের চরিত্র তারই সামনে উদঘাটন করতে পেরেছিল। 
রিপাবলিকের ‘আর্কন’-রা যদিও অভিজাত শ্রেণি হিসাবেই গণ্য হতেন, তাঁরাও আসলেই ছিলেন এক একটি ‘বুনো রামনাথ’। ফলে সারা বছর ধরে রিপাবলিকে যে ‘সাড়ে সতেরো’ মজার আমদানি ঘটত, তার ভাগ তাঁরা সমান তালে ভোগ করতেন। এই সব মজার বাহক ছিলেন ম্যাজিসিয়ান, ম্যাজিক লন্ঠনওয়ালা, পটুয়া, পুতুল-নাচিয়ে, বাউল শিল্পী, বায়স্কোপওয়ালা, ব্যায়ামবীর ইত্যাদি বিনোদনকারীরা। 
ম্যাজিক লন্ঠনওয়ালার নাম রহিমুদ্দি যে ‘হিরণ্যকশিপু বধ’, ‘দুর্যোধনের ঊরুভঙ্গ’ ইত্যাদি হিন্দু পৌরাণিক পালা আস্তিনে নিয়ে ঘোরে। পালাশেষে বিষ্ণু বা কৃষ্ণের নামে তার উচ্চকিত জয়ধ্বনিকে ছাত্ররা সুরসহ সম্পূর্ণ আত্মস্থ করে তার যে প্রয়োগ-বৈচিত্র্য দেখিয়েছিল তাঁকে বিশেষিত করার সাধ্য নেই এই আলোচকের। 
পটুয়ারা যমের পট দেখিয়ে সহসা যখন গেয়ে উঠেন – ‘দোষ নিয়ো না, মাস্টাররাও ছাত্তরদের যম। 
                                      বেত্র হাতে শাস্ত্র পড়ান, পৃষ্ঠে দমাদ্দম।।’ 
কিংবা, পুতুল-নাচিয়ে যখন গান ধরেন – ‘ঘণ্টা বাজে ইস্কুলেতে কেলাস শুরু কই?
                             কেলাসেতেই হাট বসেছে খুশির অন্ত নাই – 
                             তাই রে নাই রে না বাবা, তাই রে নাই রে নাই!’ 
তখন দাসদের সঙ্গে হাততালি দিয়ে রসগ্রহণ করতে আর্কনদেরও বিন্দুমাত্র বাধে না। 
মাণিক্য দ্য গ্রেট (‘দ্য গ্রেট’ উপাধি আলোচকের দেওয়া, লেখক কোনো কারণে সেটা উহ্য রেখে দিয়েছেন) প্রথম থেকেই আহাম্মকের সঙ্গে আছেন। আলোচনায় তাকে টেনে আনার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু ইস্কুলের দেওয়াল পত্রিকার কথা এসে পড়ায় সেখানে প্রকাশিত তার একটি সাহিত্যকর্মের কথা না বললেই নয়। তবে এটা নেহাতই হিম-চূড়ার আভাস, মাণিক্যের আসল রূপ আমি পাঠকের জন্য বাঁচিয়ে রাখলাম। 
দেওয়াল পত্রিকায় ‘স্কুলের প্রতি প্রেম নিবেদন করে চার চরণের পয়ার’ লেখার সহজ রাস্তায় তো আর মাণিক্য হাঁটতে পারে না! অতএব সে রচনা করল ‘পিঁপড়ে পোষার উপকারিতা’ শিরোনামে এক মর্মস্পর্শী নিবন্ধ। পিঁপড়ে যে মানবসভ্যতার এক পরম উপকারী প্রাণী, বিভিন্ন উদাহরণ সহযোগে সেই তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত করেই তাদের প্রতি মানুষের অত্যাচারের বিবরণে সে লেখে – ‘মায়েদের চিনির শিশিতে হানা দিয়ে কয়েক দানা চিনি খায় বলে তাদের তাড়ানো হয়, কেরোসিন তেল ঢেলে মারা হয়, বড়োরা চায়ের চিনির সঙ্গে কত পিঁপড়েকে নিষ্ঠুরভাবে গিলে খান।’ অবশেষে ‘পিঁপড়েদের ওপর অত্যাচার বন্ধ করে তাদের গৃহপালিত জীবের মর্যাদা’ দেওয়ার দাবি ঘোষণার মাধ্যমে লেখাটি উপসংহার করে সে। 
‘এ হেন তত্ত্ব ইস্কুলে সেনসেশন এনে দিল’। সেই সেনসেশনের বর্ণনা দেওয়া আলোচকের সাধ্য নয়। আমি বরং ক্লাস নাইনের এক মেধাবী ছাত্র, অমৃতর ‘ইলিনার তত্ত্ব’ উল্লেখ করি। এই তত্ত্বও দেওয়াল পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটু অন্য ধরনের আলোড়ন তুলল। এই তত্ত্বের নাম শুনে পাঠকের যদি দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের কথা মনে পড়ে তবে তাঁকে দোষ দেওয়া যায় না। কারণ এই তত্ত্বের নামেই আছে দ্বন্দ্ব সমাস এবং সমাসবদ্ধ বস্তু দুটির উপাদেয়তা নিঃসন্দেহে, বস্তুবাদের উপাদেয়তা(যদি কিছু থাকেও)কে ম্লান করে দিতে বাধ্য। এই তত্ত্বের সঠিক স্বাদ পেতে হলে অবশ্য পাঠককে খুদকুড়ো ঘেঁটে একে বের করতে হবে। 
আপনাদের জানিয়ে রাখি এই দুটি মৌলিক তত্ত্ব প্রকাশিত হওয়ার পর দেওয়াল পত্রিকায় মৌলিক রচনার বান ডাকে, যেমন – ‘বালিশ-ব্যবহারের নানা পদ্ধতি, ভেকের ডাকের অর্থভেদ, বাংলা প্রবাদের ভ্রান্তি, গৃহপালিত জীবজন্তুদের ডাকের বাংলা অনুবাদ, কবি হওয়ার সহজ উপায়, বেত্র-ব্যবহার বিধি, উন্নত মানের ঘুঁটে প্রস্তুত প্রণালী…’ ইত্যাদি ইত্যাদি।  
এই লেখকের যে-বৈশিষ্ট্য পাঠকদের মুগ্ধ করবে, তা হল হাসি-মজার ভেতর থেকে চকিতেই গভীর দার্শনিকতার একটি ঝলক বের করে আনা। ম্যাজিক লন্ঠনওয়ালার ‘শব্দ প্রক্ষেপণ’ তাঁর আয়ত্বে। তিনি উদাত্ত, অনুদাত্ত এবং স্বরিত স্বরকে অবলীলায় নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। ফলত, ‘সাড়ে সতেরো মজা’র মধ্যেই তিনি ‘ছোট্ট নগররাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে বৃহত্তর পৃথিবীর দিগন্ত ছুঁয়ে দেখবার আকাঙ্ক্ষা’র কথা বলতে পারেন; বলতে পারেন ‘অনাদরের স্বাধীনতা’র মতো অনন্য দর্শনের কথা; বলতে পারেন রিপাবলিক থেকে সংগৃহীত ‘আঘাত পাওয়ার এবং সহ্য করার উপাদান’ গুলির কথা, যেমন বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ – ‘ভুলগুলো সব আন রে রে বাছা বাছা’…।

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।