শারদ নির্মুখোশ ১৪২৯

"প্রথমে দেখলেই মনে হবে জায়গাটা বুঝি 'ঠাকুমার ঝুলি'র দুয়োরানির নির্বাসনের ঘর। উনুনের ধোঁয়ায় কালশিটে পড়া দেওয়াল। ভিজে ঘরের স্যাঁতসেঁতে মেঝে। ওপরের কড়িকাঠ বরাবর চারিদিক থেকে নেমে আসা ঝুল। পায়ের কাছে হেঁটে বেড়ানো দু একটা আরশোলা। কুলুঙ্গির দিকে এগিয়ে যাওয়া একটা টিকটিকি। আর এইসবের সাথে ঘুলঘুলিতে বাস করা চড়ুইয়ের পরিবার। তাদের বাসা থেকে আলগোছে ঝুলতে থাকা কয়েকটা খড়ের সুতো। কিন্তু একটু দাঁড়ালে, ভালো করে দেখলে বুঝতে পারা যাবে আসলে এইঘরটা পরম মমতায় আর আদরে সাজানো কোনো এক নিম্নমধ্যবিত্ত বাড়ির রান্নাঘর। যে ঘরে ঢুকলেই পাওয়া যায় মন ভোলানো অথচ খুব সাধারণ মুখোরোচক প্রতিদিনের সব রান্নার সুবাস। যার দেওয়ালে সিমেন্টের একটা স্থায়ী পাল্লাবিহীন আলমারি। সেই আলমারির চারটে তাক। তাতে কত কী-ই না জিনিস সাজানো, জমা করা, এদিক ওদিক রাখা। একদম ওপরের তাকে যেখানে বাড়ির ছোটোদের হাত পৌঁছবে না সেখানে আছে নারকেলের কুরনি। বহুদিনের পুরোনো ঘিয়ের শিশি। তাতে জমানো সেই কবেকার পচে যাওয়া ঘি। খাওয়ার জন্য নয় বাড়ির কারো ফোড়া হলে তাতে লাগানোর জন্য। 

শিল কী, তা নিশ্চই উইকিপিডিয়াতে এই মুহূর্তে আমরা খুঁজতে যাবো না। রান্নাঘরে রাখা এই শিলাখন্ডটি আমাদের কমবেশি প্রায় সকলের পরিচিত। পৃথিবীর যে সমস্ত পুরোনো পাথরগুলো এখনও বেঁচে আছে সেগুলো দিয়ে তৈরি হয় আমাদের সংসারের নিত্য নৈমিত্তিক কাজে ব্যবহার করা এই শিলাখন্ডটি। আর নোড়াটি যেন তার দোসর। একে অপরকে ছাড়া তাদের যে চলে না। এই নোড়ার কথা কতভাবে কত জায়গায় সাহিত্যে এমনকি দৈনন্দিন কথপোকথনে ব্যবহার হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। একটু বেচাল দেখেছে কি মা যখন তখন নোড়া দিয়ে আমার আর দাদার দাঁত ভেঙে দেওয়ার হুমকি দিতো। আমি আর দাদা রান্নাঘরের এই দুটি উপাদানকে তাই যথেষ্ট সমঝে চলতাম। আমাদের বদমাইশি এই দুটিকে ঘিরে কখনও দানা বাঁধেনি। অনেক দূর থেকে আমরা তাকে শ্রদ্ধা ভক্তি করতাম। যদিও প্রাচীন এই শিলাখন্ডটিকে মান্য করার অনেক সংগত কারণ এবং ঐতিহ্য আমাদের সংস্কৃতিতে ছিল। তাকেই বাড়ির লোকেরা মেনে চলতো। আমরাও কোন কিছু না বুঝেই তার অনুসরণ করতাম।

শিলকে পুজো করা হতো শিতল ষষ্টীর ব্রততে। বিয়েতে ছেলে এবং মেয়ে দুই পরিবারেই কাঁচা হলুদ কোটা এবং বাটার রীতি এই শিলকে ঘিরেই। শিলের ওপরে দাঁড়িয়েই কলাতলায় অন্নপ্রাশনের শিশু থেকে শুরু করে পূর্ণ যৌবনে পড়া মানুষটির বিয়ের গায়ে হলুদ এখনও সম্পন্ন হয়। তাকে স্নান করানোও। আরও কত কি যে মেয়েদের ব্রত কথা এবং মাঙ্গলিক নানা কাজে রান্নাঘরের এই উপাদানটি জড়িয়ে আছে তা এক গভীর অনুসন্ধানের বিষয় বইকি। কোথাও যেন প্রাত্যহিক জীবনে চলতে থাকা আমাদের সবাইকে ছুঁয়ে থাকে এক প্রাচীন শিলাখন্ড। এযেন এক প্রাচীন পৃথিবীকে ছুঁয়ে থাকার মতোই। যার কথা আমাদের সচরাচর মনে থাকে না। হঠাৎ হঠাৎ মনে পড়ে যায় কোনো এক বিশেষ অনুষ্ঠানে। ঠিক সানাইয়ের সুরের মতোই। কখনও যদি ইচ্ছে হয় শিলের গায়ে হাত দিয়ে দেখার, তার শীতলতা অনুভব করা যায়। মন দিয়ে শুনলে হয়তো সেই প্রাচীন পাথরের টানও বোঝা যায়। যত পুরনো বাড়ি। তাদের তত পুরনো শীল। আর তাকে নিয়ে তত নানান গল্প। সেসব অবশ্য আমার শোনা হয়নি। যদি শুনতে পারতাম তাহলে কত ভালো হতো। একবার পশ্চিম মেদিনীপুরে দিদির গ্রামে বেড়াতে গিয়ে দেখেছিলাম কোন এক গৃহস্থ উঠোনে উনানের একটু দূরে স্থাপন করেছেন তাঁদের পারিবারিক শিলটিকে। চারপাশটা গোবর মাটি দিয়ে লেপানো। জানতে চেয়েছিলাম ঠিক এখানেই কেন? উত্তর এসেছিল অবাক করে দেওয়ার মতো। ওখানে এই বাড়িতে সূর্যের প্রথম আলোটা এসে পড়ে যে। ঋতু অনুযায়ী তার হয়তো পরিবর্তন হয়। কিন্তু কোথাও এই প্রকৃতিকে, তার ভালোবাসাকে যেন স্বীকার করে নেওয়া হয় ওই স্থানটি বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে। শিলকে সেখানে স্থাপনার মধ্যে দিয়ে। সাংসারিক এই উপাদানটিকে অনবরত নিজের সাথে জড়িয়ে রাখার এমন উদাহরণ আমাদের শহুরে জীবনের দেখাকে ধাক্কা দেয় তো বটেই। ভাবতে ভালো লাগে কেউ কেউ এখনও সেই অভ্যেস করছেন। যার জন্য বাড়ির প্রাচীন শিলাখন্ডটির ওপর দিনের প্রথম আলো এসে পড়ে। সেই আলোয় তিনি এই পরিবারের, এই পৃথিবীর কুশল কামনা করেন। বরণ করে নেন নিজের সাধ্যমতো।"

বাড়ির সেই পদ্মকাটা নক্সাআঁকা শিলটা
কল্লোল লাহিড়ী

শারদ নির্মুখোশ ১৪২৯

প্রচ্ছদ ও অলংকরণ : মেখলা ভট্টাচার্য 

#সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।