দুর্লভ খুদকুড়ো ৩। লিখছেন অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী।

সুপ্রকাশ প্রকাশিত দুর্লভ সূত্রধরের ‘আহাম্মকের খুদকুড়ো’র ধারাবাহিক পাঠ-আলোচনা লিখছেন অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী। আজ তৃতীয় পর্ব।
......................................
একটি ধারাবাহিক পাঠালোচনা          
অন্নপূর্ণা মা ও দয়াবতী দিদিরা 
এই গ্রন্থের উৎসর্গপত্র ছাড়াও দু-দুটি অধ্যায় আলোকিত করে বিরাজ করছেন অন্নপূর্ণা মা এবং দয়াবতী দিদিরা। 
ক্ষুধার সংসারে “জীবনের সবচেয়ে বড়ো ব্যাপার হলো দু-বেলা দু-থালা ভাতের গল্প –”, “শুধু মা বোঝেন সন্তানের খিদের দামামা – সন্তানও বোঝে ‘মা’ নামের মহিমা”।
এই ভাতের গল্পটাকে মন্ত্রবলে যিনি জীবন্ত রাখেন, ‘বুদ্ধি, শ্রম আর কল্পনাশক্তির অসামান্য মিশ্রণ’ দিয়ে যিনি অখাদ্যকে সুখাদ্যে পরিণত করতে পারেন তিনিই হলেন মা অন্নপূর্ণা। কেবল স্বামী সন্তান নয়, অতিথি অভ্যাগতদের জন্যও তার ভাঁড়ার অফুরন্ত থাকে। এই অতিথি-অভ্যাগতদের মধ্যে যেমন মান্যগণ্য বিশিষ্ট মানুষজন থাকেন, তেমনিই থাকেন কাসুন্দ-বিক্রেতা এবং শাকওলি মাসিরাও। অন্নপূর্ণা মায়ের সংসারে ফেলনা এবং খুদকুড়ো সহযোগে জলখাবারের এমনই সমারোহ যে পুরো একটি উপাদেয় অধ্যায় লেখক রেখে দিয়েছেন পাঠকদের পাতে সেগুলি পরিবেশন করার জন্য। 
আগ্রাসী দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষার মূল স্তম্ভ যদি মা হন, তাহলে মায়ের শিক্ষায় শিক্ষিত তাঁর কন্যাদের হতেই হয় তাঁর যোগ্য সহকারী। এই কন্যারা হলেন দুর্লভ সূত্রধরের দয়াবতী দিদিরা। ভাইদের ‘অনাচার’-এ রাখা তাঁরা সইতে পারেন না। হরেক রকমের আচার তৈরি, শুকোনো এবং ‘দুর্বৃত্ত’-দের হাত থেকে রক্ষা করাই তাদের সবচেয়ে বড়ো ব্রত। কোন সুভদ্রদের রসনা বারোমাস রসস্থ রাখতে কোন দুর্বৃত্তদের হাত থেকে তাঁদেরকে আচার রক্ষা করে রাখতে হয় সে এক অন্য বৃত্তান্ত, পাঠক বইটির ভেতরে ঢুকলে তবে টের পাবেন। 
দিদিদের দয়াবতী অভিধা পাওয়ার আরও একটি নিগূঢ় কারণ আছে। মায়ের সুশৃঙ্খল সংসারে ছোটো ভাইদেরও ভাগেও পড়ত চালের কাঁকর বাছার দায়িত্ব। সেই দায়িত্ব দিদিদের ‘পকিয়ে পাকিয়ে’ তাদের ঘাড়ে যদি চাপিয়ে দেওয়া যায় তাহলে তাদের তুল্য দয়াবতী আর কে আছে এই কর্মময় সংসারে!   
অন্নপূর্ণা মায়ের দুয়ারে অভ্যাগতদের মধ্যে এক উজ্জ্বল চরিত্র বয়সের ভারে ন্যুব্জ এক কাসন্দ বিক্রেতা। পরিচ্ছন্নতার প্রতীক সেই বৃদ্ধের সঙ্গে মায়ের মুল্যের বিনিময়ে কাসন্দ বেচাকেনা আসলেই ছিল আরও মহার্ঘ সব বিনিময়ের নান্দীমুখ মাত্র। পণ্য বেচাকেনা সাঙ্গ হলে বৃদ্ধের প্রথম প্রস্থ বিনিময় হতো ছোটোদের সঙ্গে। তিন-চারটি প্রসারিত ডান হাতে কাসন্দ মাখা আমসির টুকরো একটি একটি করে তুলে দেওয়ার আগে তাঁর অবধারিত প্রশ্নটি ছিল – ‘হাত-টাত পয়ঃপোষ্কার তো?’
অন্যদিকে কী উত্তর আসবে জেনেও ছোটোদের অবধারিত প্রতিপ্রশ্ন ছিল –‘এমন কাসন্দ কে বানিয়ে দিল গো?’
- ‘আমার মা গো। আমার মা ছাড়া এ পৃথিমীতে আর কেউ কি এমন কাসন্ বানাতে পারে গো!’
যে নিজেই এতো বুড়ো তাঁর মা কতো বুড়ো – এই নিয়ে ছোটোরা যতই চিন্তিত হয়ে পড়ুক, পাঠকের নিশ্চয় জানা আছে যে মা ‘অনন্তকাল ধরে তাঁর সন্তানদের জন্য অতুলনীয় কাসন্দ বানিয়ে চলেছেন।’ 
সময় অনন্ত জানেন বলেই সেই কাসন্দ বিক্রেতার প্রশান্ত চরিত্রে কোনো অস্থিরতা নেই। এরপরেই শুরু হবে অন্নপূর্ণা মায়ের সঙ্গে তাঁর আসল বিনিময় পর্ব। তিনি মাকে শোনাবেন পুরাণকথা, রান্নার গল্প এবং বিনিময়ে মায়ের মুখে অতি অবশ্যই শুনবেন একটি রবীন্দ্র-কবিতা।
অন্নপূর্ণা মা এবং দয়াবতী দিদিদের পাশাপাশি একের পর এক অনুপম চরিত্র আঁকতে আঁকতে একটি স্রোতোধারার মতো এগিয়ে চলেছে দুর্লভ সূত্রধরের স্মৃতি-আখ্যান। সেখানে হাজির কচুরিওলা বেণী ঘোষের সঙ্গে সাফাইওলা বিজুরিয়া, কিংবা ডালপুরি সহ নবীনবাবু এবং জিলিপি নিয়ে ভুবনবাবু। সবশেষে হাজির মায়ের সবচেয়ে কাছের মানুষ, তাঁর সখিপ্রতিম শাকওলি মাসিরা। তারা নিজের অধিকারে মাকে ‘দিদি’ বলে ডেকে আতিথ্য নিয়ে যেত। বদলে, দিয়েও যেত অনেক কিছুই। সেসব অকিঞ্চিৎকর বস্তুর গায়ে লেগে থাকত অন্তরের ছোঁয়া।     
মায়ের ধম্মোকম্মো, ব্রত উদযাপন নিহিত থাকত সংসারকে এইভাবে বিস্তৃত করার মধ্যেই। মন্বন্তরের রক্তচক্ষুকে হয়তো এই পুণ্যফলেই উপেক্ষা করতে পেরেছিলেন তিনি। 
“এখন সম্পর্কের সময় কম, সুখ দুঃখ বিনিময়ের অবকাশ নেই। এখন নদী-মাঠ-ডোবায় কলমি শাকের ফুলগুলো হাওয়ায় মাথা দুলিয়ে মাসিদের ডাকে না, গরমকালের দুপুরে আকাশনিম গাছে ঝুপ্পুর পাতার আড়ালে বসে হা-ক্লান্ত খয়রাপাখ পাপিয়া আর গরমের ছুটিটাকে ভরিয়ে দিতে আসে না। পাখিগুলো এখনও টিকে আছে কী-না তারই বা ঠিক কি, গরমের ছুটির মতো সেগুলোও হয়তো বা বিলুপ্ত হয়েছে! পুরনোকালের সেই কষ্টের বোধটাই তো আজ উধাও।”
আহাম্মক “দুঃখু-দুঃখু মুখ করে ভাবে – মায়েদের অনন্ত পরমায়ু পাওয়া দরকার –” 
এইভাবেই স্মৃতিগদ্যের চলনে বাঁকে বাঁকে বদল আসে, ভাষা তরল থেকে অনুভবের ব্যঞ্জনায় গাঢ় হয়, আর তারই মাঝে আহাম্মকের নিজস্ব দর্শন উঁকিঝুঁকি দিতে থাকে। 

(চলবে)

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।