' শেষ মৃত পাখি ' পড়ে লিখেছেন শুভঙ্কর দাস

সুপ্রকাশ প্রকাশিত শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যর উপন্যাস ' শেষ মৃত পাখি ' পড়ে লিখেছেন শুভঙ্কর দাস। আমরা তাঁর অনুমতি নিয়ে নিজেদের টাইমলাইন থেকে শেয়ার করছি। 
...........................................

বই: শেষ মৃত পাখি
লেখক: শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য
প্রকাশনা: সুপ্রকাশ প্রকাশনা 
মূল্য: ৫২০ টাকা

গত দু'দিন ধরে যে বইটি আমাকে, আমার নিবিষ্ট অভিনিবেশকে সুতীব্র আকর্ষণে বেঁধে রেখে পাঠ করে নিতে বাধ্য করেছে, তা একটি মার্ডার-মিস্ট্রি থ্রিলার ৷ প্রতিটি সৎ-সাহিত্যের সেটাই অন্যতম প্রধান গুণ ৷ কিন্তু থ্রিলার শুনে অনেক বিদগ্ধ পাঠক-সমালোচক হয়তো ভুরু কোঁচকাবেন, নাঁক সামান্য বেঁকিয়ে বলবেন, ক্ষণিকের রোমাঞ্চ-উত্তেজনা নির্মাণে এবং মানুষের রহস্যপ্রিয় সত্তার সাময়িক তৃপ্তিবিধানে যে সাহিত্যের অভিপ্রায় নিঃশেষিত হয়ে যায়, তা আর কতখানি গভীর বীক্ষণের দাবি রাখতে পারে?

বস্তুত এই প্রশ্নের ভেতরে প্রচ্ছন্ন তুচ্ছতার, ভাবনা-চিন্তার খোরাকহীনতার দৃষ্টিভঙ্গিকে কঠিন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য তাঁর সদ্য-প্রকাশিত রহস্য-কাহিনি 'শেষ মৃত পাখি'-র মাধ্যমে ৷ কীভাবে সে-প্রসঙ্গে পরে আসছি ৷ প্রথমে মূল প্লটটুকু সংক্ষেপে জানিয়ে দিই স্পয়লার না দিয়ে ৷

পঁয়তাল্লিশ বছর আগে দার্জিলিং-এর এক প্রতিশ্রুতিবান কবি, অমিতাভ মিত্র খুন হয়েছিলেন ৷ সারকামস্ট্যানশিয়াল এভিডেন্সের ভিত্তিতে সন্দেহ ও অভিযোগের তীর ছিলো তাঁরই ঘনিষ্ঠ বন্ধু প্রখ্যাত রহস্য-ঔপন্যাসিক অরুণ চৌধুরীর দিকে ৷ কিন্তু বিশ্বাসযোগ্য এলিবাই থাকায়, তদন্তের প্রক্রিয়ায় কিছু সংগত প্রশ্নের উত্তর না মেলায় কংক্রিট প্রমাণের অভাবে অরুণ চৌধুরী সমস্ত অভিযোগ থেকে নিঃশর্ত মুক্তি পান ৷ সর্বভারতীয় সংবাদ-মাধ্যমের ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্ট তনয়া অমীমাংসিত খুনের কাহিনি নিয়ে যে জনপ্রিয় ধারাবাহিক লিখছিলেন, তার শেষতম সংযোজন হিসাবে অমিতাভ মিত্রের রহস্যময় সমাধান-না-হওয়া মার্ডারের কেস-স্টাডি করতে দার্জিলিঙে যান পঁয়তাল্লিশ বছর পর ৷ দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে যখন মূল তদন্তের অফিসার, প্রত্যক্ষদর্শী, সাক্ষ্যপ্রমাণ অনেক কিছুই কালের গর্ভে বিলীন, তখন তনয়া কীভাবে পারবে এই বিরাট ধাঁধার হারানো অংশগুলো জোড়া লাগিয়ে তার ভেতর থেকে সবচেয়ে সম্ভাব্য, সবচেয়ে বাস্তবিক, সত্যের সবচেয়ে সমীপবর্তী একটা সমাধান-সূত্র খুঁজে বের করতে? প্রায় অসম্ভব মনে হলেও ওল্ড সিনস্ হ্যাভ লং শ্যাডোজ্, আর তাই সেই প্রাচীনতর পাপের গভীরতর ছায়া লেগে থাকে অরুণের তনয়াকে দেওয়া অমিতাভ-এর লেখা শেষ রহস্যোপন্যাসটির মধ্যে, দার্জিলিঙের এক পোড়ো পরিত্যক্ত সাহেবি-বাড়িতে, তখনকার সময়ের দু'য়েকজন জীবিত মানুষের ক্ষীণ স্মৃতিতে ৷ সেই ছায়ার পিছু-পিছু যেতে যেতে পঁয়তাল্লিশ বছর আগের মূল ঘটনার কায়া-নির্মাণ এই উপন্যাসকে আলাদা মাত্রা দিয়েছে ৷ এই উপন্যাসে লেখকের ক্রাফটসম্যানশিপের আরেকটি বড় উদাহরণ মূল রহস্যকাহিনির মধ্যে অমিতাভ মিত্রের লেখা রহস্য-কাহিনির সংযোজন, সেটিও আবার লকড-রুম মার্ডার মিস্ট্রি! যে অমিতাভ মিত্র আদতে খুন হয়েছিলেন তাঁর লেখা মার্ডার-মিস্ট্রির মধ্যেই নিহিত আছে তাঁর হত্যার অন্তর্নিহিত সত্যের বিকল্প-ভাষ্য? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে গেলে আপনাকে পড়তেই হবে রুদ্ধশ্বাস পেজ-টার্নার এই বইটি ৷ পড়তে পড়তে ভাববেন, যে সত্য আপনি দেখতে পাচ্ছেন বা আপনাকে দ্যাখানো হচ্ছে তা কতখানি আল্টিমেট নাকি সত্যের ক্যামোফ্লেজে মিথ্যা দাঁড়িয়ে আছে আপনার সামনে? মনে পড়বে ক্যামুর সেই বিখ্যাত উক্তি 'দ্য ফল'-এর, "Don't lies  eventually leads to truth?"

কিন্তু স্তরে-স্তরে জটিল হত্যা-রহস্যের একটু একটু করে সূত্র ছড়ানো, পঁয়তাল্লিশ বছর পর আরেকটি হত্যা, উত্তেজনা, চমক এসবের পরেও এই উপন্যাসের একটা মননঋদ্ধ আবেদন থাকবে পাঠকের কাছে ৷ সত্তরের দশকের দার্জিলিঙ, নকশাল আন্দোলন, একটা গোটা তরুণ প্রজন্মের উপর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের নির্মমতার বিরুদ্ধে লিটল ম্যাগের কবিদের গর্জে ওঠা, তাঁদের স্বতন্ত্র স্বর-ভাষা-শৈলী, প্রতিকূল রাজনৈতিক আবহে প্রাতিষ্ঠানিক ও বাণিজ্যিক পাওয়ার-স্ট্রাকচারের বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে অবাণিজ্যিক শিল্প-দর্শনের মাধ্যমিকতায় সময়ের সেবা করা নয় বরং সময়কে নতুন পারসেপশনে সৃষ্টি করার অদম্য জেদ — সমস্তরকম স্থিতাবস্থার বিরুদ্ধে এই বৈপ্লবিক অবস্থান নিয়ে বাংলা কবিতার যে  নতুন ভরকেন্দ্র মৃদুল দাশগুপ্ত, পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল, অমিতাভ গুপ্ত, শম্ভু রক্ষিত, দেবদাস আচার্য, মণীন্দ্র গুপ্ত, নিশীথ ভড় প্রমুখ শক্তিশালী কবিদের হাতে ও নানা উৎকৃষ্ট অথচ অধুনা বিস্মৃত লিটল ম্যাগাজিনের প্রকাশে গড়ে উঠছিলো, তার সুশিল্পিত বয়ন আলোচ্য উপন্যাসকে নিছক মার্ডার-মিস্ট্রির সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে মহৎ-সাহিত্যের মর্যাদা দান করেছে ৷ ক্রুদ্ধ, শোকার্ত, হাহাকরময় সেই সময় ও তার গূঢ় টেনশনগুলিকে তৎকালীন তথাকথিত ছোট প্রচারহীন পত্রিকার কবিরা কী স্পর্ধিত জীবনবোধে লালন এবং নির্মাণ করেছিলেন তাঁদের রক্তাক্ত কাব্যশরীরে-আত্মায়, সে বিষয়ে পাঠকদের ব্যাপকতর অধ্যয়নে প্রাণিত করবে 'শেষ মৃত পাখি'৷

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।