পূজার ছুটি। সেকালের চিত্র চরিত্র

"সারাবছর বিদেশে কাটাইয়া পূজার ছুটিতে যেদিন বাড়ি আসিলাম, সেদিন শারদীয়া শুক্লা তৃতীয়া। আমার কার্যস্থান হইতে বাড়ি আসিতে হইলে একটা নদী পার হইতে হয়, এই নদী পার হইয়াই আমাদের গ্রাম। অন্যান্য বারের ন্যায় এবার আমাদের এই নদীতে বেশি বান হয় নাই, জল অল্প বাড়িয়াছিল, এখন শুকাইয়া যাইতেছে। দূরবর্তী পদ্মাতীরে থাকিয়া নদী সম্বন্ধে আমার ধারণাটা কিছু প্রশস্ত হইয়াছে ; বর্ষার সেই বিশালকায়া, পলিতোয়া, কলগামিনী, কামচারিণী, পর্বতনন্দিনীর ক্রোড়দেশে কালাতিপাত করিয়া তাহার এই ক্ষুদ্র শাখাটিকে আর নদী বলিয়া ধারণা হয় না। তথাপি এই ক্ষুদ্র তরঙ্গিনী আমাদের গ্রামের নদী, আমরা আবাল্য তাহার সহিত পরিচিত, এখনও মনে। পড়ে কতদিন আমরা সকাল সকাল পাঠশালা হইতে পালাইয়া এই নদীর জলে বাল্যসাথীগণের সঙ্গে মাতামাতি করিতাম, এবং বৈশাখের বৈকালে ঝড় উঠিলে পাঁচ-সাত বন্ধুতে একত্র হইয়া পরিধান বস্ত্র আজানু উত্তোলনপূর্বক ইহার সংকুচিত জল পার হইতাম এবং বর্গির হাঙ্গামার মতো ওপারের দত্তদের আমবাগানে ছুটিয়া পড়িতাম।

সন্ধ্যাকালে যখন নদীর ধারে আসিয়া আমার গাড়ি থামিল, তখন সন্ধ্যা অতীত হইয়াছে ; তখন চন্দ্র পশ্চিম আকাশে অশ্বত্থ গাছের অন্তরালে নামিতেছিল, সেই ক্ষীণকায় চন্দ্রতনুর ম্লানজ্যোতি ক্ষুদ্র নদীর নিস্তরঙ্গ বক্ষ, দূরান্তরন্যস্ত আম কাঁঠালের বাগান, সবুজ মাঠ এবং স্থানে স্থানে সমাকীর্ণ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নিবিড় গুল্মের ওপর পড়িয়া স্তব্ধ প্রকৃতির মধ্যে একটা মোহন মায়াচিত্র প্রস্ফুট করিয়া তুলিতেছিল।

নদী পার হইয়া ঘনসন্নিবিষ্ট তেঁতুল গাছের মধ্যবর্তী মেঠো পথ ধরিয়া আবার গাড়ি চলিল। দুইদিকে প্রচুর বৃক্ষসমাচ্ছন্ন বাগানে পুঞ্জীকৃত খদ্যোত ক্ষীণ আলো বিকীর্ণ করিতেছিল, পথের ওপর, ঘন বনের মধ্যে ঝিল্লিদলের আশ্রান্ত শব্দ; এই খদ্যোতখচিত ঝিল্লিমুখরিত পথ শেষ হইলেই আমাদের বাড়ি।

রাত্রি নয়টার সময় বাড়ি আসিলাম। আমাদের পল্লীগ্রাম — বাড়ির চারিদিকে কতরকমের গাছ; কোনো দিকে নারিকেল ও সুপারি গাছের সারি, কোনো দিকে আমড়া, সজনে, ডুম্বুর গাছে ঘেরা বেড়, বাগানের মধ্যে জাম পেয়ারা ও বাতাপি লেবুর গাছ, লিচুর কলম, গোলাপ জাম ও নারিকেল কুলের চারা এবং তাহারই অদূরে গহ্বরস্থ সতেজ সরস কচুবনের ওপর শাখাবাহু বিস্তার করিয়া বিস্তর নোনা-আতার গাছ বিশৃঙ্খলভাবে অবস্থান করিতেছে, ফাল্গুন-চৈত্র মাসে সেই সকল গাছে নোনা পাকিলে দিনের বেলা তাহাদের ওপর পাড়ার ছেলেদের এবং রাত্রিকালে দেশের বাদুড়ের উৎপীড়ন চলে। এখন আর অন্য ফল দেখিবার যো নাই, কেবল একটা ছোটো জলপাই গাছে থোকাকত জলপাই, আর লেবু গাছে গোটাকত বাতাপি লেবু ফলিয়া আছে, এবং সকল গাছগুলিই বর্ষার নবজলধারায় পরিপুষ্ট দেহে গাঢ় শ্যামল যৌবনশ্রী ধারণ করিয়া প্রচুরোদ্গাত পত্র পল্লবে সবল ঘন আলিঙ্গনে আবদ্ধ হইয়া পরম পুলকে মাথা তুলিয়া দাঁড়াইয়া আছে এবং গোয়াল ঘরের পাশের একটা কামিনী ফুলের গাছ হইতে সদ্যবিকশিত পুষ্পস্তবকের মৃদুগন্ধে মধ্যে মধ্যে রাত্রির এই তরল অন্ধকার ভরিয়া উঠিতেছে।

চারিদিকে পল্লীবাসিনীদিগের চিড়া কুটিবার ধুপধাপ শব্দ, রাত্রি ক্রমে অধিক হইয়া আসিল কিন্তু এ-শব্দের বিরাম নাই, ষষ্ঠীর পর হইতে লক্ষ্মী পূজা পর্যন্ত আর ঢেঁকিতে পাড়া দেওয়ার নিয়ম নাই—তাই রমণীগণ পূর্ব হইতেই ঢেঁকির কাজ সারিয়া রাখিতেছেন; লক্ষ্মীপূজার সময় সকলের বাড়িতেই চিড়ার বিশেষ দরকার, যাহারা সুবিধা অনুসারে চিড়া বিক্রয় করে, তাহাদেরও এই সময় চিড়া কোটা লাভজনক। তাই সকল বাড়িতেই সবেগে ঢেঁকি চলিতেছে এবং ষষ্ঠী যতই নিকটবর্তী হইতেছে ততই বেশি রাত্রি পর্যন্ত ঢেঁকি পড়িতেছে ; পঞ্চমীর দিন দিবারাত্রি আর ঢেঁকির বিশ্রাম ঘটে না।"


পূজার ছুটি

দীনেন্দ্রকুমার রায় লিখিত
সেকালের চিত্র চরিত্র

সংকলন, সম্পাদনা, টীকাঃ শতঞ্জীব রাহা

মুদ্রিত মূল্যঃ ৪৯০ টাকা

#সুপ্রকাশ


Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।