শীতের দিনে পল্লীগ্রামে । সেকালের চিত্র চরিত্র

গরুর গাড়ি সুদীর্ঘ নয় ক্রোশ পথ অতিক্রম করিয়া যখন গ্রামের সন্নিহিত হইল, তখন পৌষের রাত্রি প্রায় শেষ হইয়াছে। সন্ধ্যার পর রেলের স্টেশন হইতে যাত্রা করিয়া এই গরুর গাড়িতে সমস্ত রাত্রি কাটাইয়াছি। গাড়ির 'ফড়ের' উপর নূতন ধান্যের 'বিচালি' পুরু করিয়া বিছানো আসন, তাহার উপর বিছানা আমার সর্বাঙ্গ একখানি বিলাতি কম্বলে আবৃত, আমি ‘চোদ্দ পোয়া' লম্বা হইয়া গাড়িতে নিদ্রা যাইতেছিলাম। গরুর গাড়ির নাম শুনিয়া যাঁহাদের হৃৎকম্প হয়, তাঁহারা শুনিয়া বিস্মিত হইবেন—সমস্ত রাত্রির মধ্যে আমার সুখনিদ্রা ভঙ্গ হয় নাই। এই রকম শীতের রাত্রিতে যে গরুর গাড়িতে চড়িয়া আরাম আছে— ভুক্তভোগীরা, এ কথা অস্বীকার করিবেন না। অন্ধকারে সমস্ত প্রকৃতি সমাচ্ছন্ন; সম্মুখের পথ দেখা যায় না, সুদীর্ঘ পথে—এই অন্ধকার শীতের রাত্রে —জনমানবের সাড়া-শব্দ নাই, কেবল ঊর্ধ্বে নৈশাকাশে লক্ষ লক্ষ উজ্জ্বল নক্ষত্রের শুভ্র-দীপ্তি। সপ্তর্ষিমণ্ডল স্নেহোজ্জ্বল নতনেত্রে ধরণীর দিকে চাহিয়া আছেন— যুগ যুগ ধরিয়া এমনভাবেই চাহিয়া আছেন। তাঁর অপরিবর্তনীয় ভাব।

শৈশবের সুখের কথা মনে পড়িল, যৌবনের আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা মনে পড়িল, অবশেষে জীবনের এই নিদারুণ মধ্যাহ্নে ছুটাছুটি করিয়া গলদঘর্ম হইতেছি। মাথা তুলিয়া গাড়ির এপাশে-ওপাশে চাহিলাম, ইষ্টকবদ্ধ পথে গাড়ি হন্ হন্ করিয়া চলিয়াছে, গাড়োয়ান পেল্লাদ সেখ তামাক খাইবার জন্য পোয়ালের 'বুঁদিতে আগুন জ্বালিয়া ফুঁ দিতেছে, বুঁদির আগুনের আভা তাহার কালো মুখে পড়িয়া মুখখানাকে রাঙা করিয়া তুলিতেছে; সে কলকের তামাক সাজিয়া জলহীন হুঁকার ক-একবার কষিয়া দম দিল। কলিকার উপর বুঁদির আগুন দপ্ করিয়া জ্বলিয়া উঠিল।— কলিকার অগ্নি নির্বাপিত হইলে পেপ্লাদ কলিকার ছাই ও জল পথে ঢালিয়া ফেলিয়া, হুঁকা কলিকা তাহার গেজের ভিতর রাখিল। তাহার পর, বলদ দুটির লাঙ্গুল মর্দন। করিয়া জোরে গাড়ি চালাইয়া দিল এবং কম্বলখানা ভালো করিয়া গায়ে জড়াইয়া তাহার মেঠো সুরে গাহিল—
আক্কেল গুড়ুম হয় গো আল্লা, তোমার 'বিচের শুনে, খাজনা দ্যায় রহিম ‘স্যাক', 'ল্যাল' পেড়ে খায় কণে।

—তাহার সতেজ সমুচ্চ কণ্ঠস্বরে প্রাস্তর প্রতিধ্বনিত হইতে লাগিল। পথের দুই পাশে আম, কাঁঠাল, তেঁতুল গাছ, কোথাও বাবলা গাছের সারি, কোথাও বাঁশবন। অন্ধকারে সমস্তই ভীষণাকার প্রেতের ন্যায় প্রতীয়মান হইতেছে; অসংখ্য জোনাকি পুঞ্জীভূত হইয়া বৃক্ষগুলির পত্রান্তরালে মিট্‌মিট্‌ করিয়া জ্বলিতেছে। সুন্দর শোভা। কোনো গাছের শাখায় বসিয়া একটা পেঁচক সশব্দে পাখা নাড়িল— বাদুড়ের দল নিঃশব্দ-পক্ষসঞ্চারে এক একটা গাছের উপর আসিয়া ঝপ করিয়া বসিয়া পড়িতেছে, আবার তখনই উড়িয়া যাইতেছে দূর বনে দুইটি 'হুতোম প্যাঁচা' মুখোমুখি বসিয়া প্রেমালাপ করিতেছে। কী গভীর করুণ স্বর! সে স্বরে বনদেবতার বক্ষঃস্থল যেন স্পন্দিত হইয়া উঠিতেছে। বাঁশবনের ভিতর হইতে একটা শিয়াল বাহির হইয়া পথের ধারের নয়নজুলির পাশে আসিয়া দাঁড়াইল, মাথা ঊর্ধ্বে তুলিয়া ডাকিল— 'হুয়া!' আর চারিদিক হইতে 'হুয়া' 'হুয়া' শব্দের 'কোরাস' আরম্ভ হইল ; প্রায় পাঁচ মিনিট পরে ঐকতান-ধ্বনি নীরব হইলে— দূর প্রান্তরে– গ্রাম-প্রান্তে আর একদল শৃগাল ডাকিয়া উঠিল। মাঠের ভিতর দিয়া এক-একবার শীতল বায়ু- প্রবাহ অড়হর কুঞ্জের শীর্ষদেশ আন্দোলিত করিয়া করিয়া শনশন শব্দে দূরে চলিয়া গেল—সেই উগ্র শীতল বায়ুহিল্লোল চোখে-মুখে লাগিয়া বুকের মধ্যে কম্পন উপস্থিত করিল। ভালো করিয়া কম্বল মুড়ি দিয়া শুইলাম।—তাহার পরে যে নিদ্রা—রাত্রিশেষে গ্রামপ্রান্তে আসিয়া সেই নিদ্রা ভঙ্গ হইল।


শীতের দিনে পল্লীগ্রামে 

দীনেন্দ্রকুমার রায় লিখিত 
সেকালের চিত্র চরিত্র

সংকলন, সম্পাদনা, টীকা : শতঞ্জীব রাহা

মুদ্রিত মূল্য : ৪৯০ টাকা

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।