মেসবাড়ির সত্যান্বেষী। মেস-হোস্টেল ঘটিত এ বাঙালি জীবন

এ শহরের বয়স তো কম নয়। এ শহর তার বুকে ব্রিটিশদের পদধ্বনি সয়েছে, সাক্ষী থেকেছে দুটো বিশ্বযুদ্ধের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সাম্প্রদায়িক রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা, দেশভাগ, ছিন্নমূল উদ্বাস্তুদের হাহাকার— এ শহর সবকিছুরই নীরব সাক্ষী। প্রাচীন বট বৃক্ষের মতো সব কিছুকেই প্রত্যক্ষ করেছে সে। আবার বটবৃক্ষ যেমন পাখালিদের আশ্রয় দেয়, তেমনি বিভিন্ন সময় আশ্রয় দিয়েছে এ শহরে আসা মানুষদের। উৎপাটিত চারাগাছকে নতুন মাটিতে প্রোথিত করলে যেমন দিব্যি শিকড় গজিয়ে নতুন স্থানকে আপন করে নেয়, বাইরে থেকে আসা মানুষজনও একটু করে তার হৃদয় মূল প্রোথিত করেছে এ শহরের বুকে। ক্রমে এ শহর হয়ে উঠেছে তাদের ভালোবাসার শহর।

এমনি ভাবেই আজ থেকে প্রায় একশো পাঁচ বছর আগে মুঙ্গের থেকে এক কিশোর এসেছিলেন ও শহরে। উচ্চশিক্ষার জন্য। থাকবেন কোথায় এ শহরে? বহিরাগত মানুষজনের জন্য এ শহরে সস্তায় থাকার ব্যবস্থা- এ শহরের হস্টেল আর মেসবাড়ি। এ কিশোরও আশ্রয় নিলেন সেখানেই। ক্রমে এ শহরের কাছে কিশোর আর বহিরাগত রইল না। পড়াশুনায় ছেলের তেমন মন নেই। প্রতি সপ্তাহে সিনেমা থিয়েটার, টেনিস, ক্যারাম, মেসের বন্ধুদের সাথে রাত জেগে আড্ডা আর অফুরান কাব্যচর্চা আর দেশ বিদেশের সাহিত্য চর্চা। সাহিত্যিকের দূরদৃষ্টি ছিল এ কিশোরের। এ শহরই গড়ে দিয়েছিল এক ভবিষ্যৎকালের সাহিত্যিকের বুনিয়াদ। কিশোরের এই মেস জীবনের বন্ধুত্বই বাংলা সাহিত্যকে দিয়েছে চির অমলিন এক বন্ধুত্বের জুটি, ব্যোমকেশ আর অজিত। হোমস, ওয়াটসন জুটির সাথেও যার তুলনা চলে না। কলকাতা শহরে পড়তে আসা কিশোরের নাম নতুন করে বলবার দরকার আছে কি? তিনি শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। 
১৯১৫ সালে মুঙ্গের থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে কলকাতার বিদ্যাসাগর কলেজে ভর্তি হলেন শরদিন্দু। তারপর প্রায় বছর ছয়েক এ শহরের সকাল সন্ধ্যের রূপ রস গন্ধকে রন্ধ্রে রন্ধ্রে আত্মস্থ করেছেন তিনি। ছাত্রজীবনে তাঁর এ শহরের রসাস্বাদনই উপাদান হয়েছে তাঁর বেশিরভাগ ব্যোমকেশ কাহিনীর।

'সকালবেলা বুড়ো জমাদার ২টা ডিম এনে দিলে তাই খেলাম। তারপর কিঞ্চিৎ চা এবং টোস্ট। বারোটার সময় স্নানাহার এবং তারপর কিয়ৎকাল নিদ্রা। প্রায় চারটের সময় আমি এবং অজিত বেরুলাম বায়োস্কোপ (ইং) দেখতে।'— এটুকু পড়ে চমকে উঠতে হয়। ভ্রম হয় ব্যোমকেশ কি তবে নিজের বয়ানেই নতুন কোনো ব্যোমকেশ কাহিনীর অবতারণা করছে? এই গুটিকয়েক শব্দ শরদিন্দুর ৮ ফেব্রুয়ারি ১৯২০ তারিখে লেখা কলকাতার হোস্টেল, মেস জীবনের দিনলিপি। জমাদারের জায়গায় পুঁটিরাম থাকলে পাঠক হয়তো সন্দেহও করতেন না।

ব্যোমকেশ অবশ্য বায়োস্কোপে তেমন ইন্টারেস্টেড নয়। কিন্তু ব্যোমকেশ কাহিনীতে বহুক্ষেত্রে উল্লেখিত

বায়োস্কোপ প্রসঙ্গ শরদিন্দুর কলকাতার মেসজীবনের বায়োস্কোপ প্রীতিরই ছায়ারূপ।

কিন্তু এই অজিতটি কে? শরদিন্দু ৩১ ডিসেম্বর, ১৯৫০ তারিখের দিনলিপিতে অজিতেরই স্মৃতিচারণ: দ্বিতীয় বর্ষে একটি নতুন ছেলে হস্টেলে আসিল। তাহার নাম অজিত সেন। অর্জিত ভালো গান গাহিতে পারিত, কবিতা লিখিত এবং অফুরন্ত হাসিতে পারিত। তাহার সহিত শীঘ্রই বন্ধুত্ব গাঢ় হইল। আমাদের উদ্যোগে হস্টেলে হাতে লেখা কাগজ বাহির হইতে লাগিল।

এই অজিত সেনই ব্যোমকেশ সুহৃদ অজিত। বাংলার ১৩৩১ সালে তাঁদের প্রথম পরিচয়। তারপর ব্যোমকেশের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ অজিত। সে ছাত্রজীবনের সাহিত্যচর্চাকেই জীবনের ব্রত করেছে। তার বন্ধু ব্যোমকেশ আসলে আর কেউ নন। স্বয়ং শরদিন্দু। সৃষ্টি আর সৃষ্টিকর্তা অভিন্ন। ব্যোমকেশ, শরদিন্দুরই ‘সেলফ প্রজেকশান'। নিজেরই আত্মকৃতি—— লম্বা, নাতিস্থূল চেহারা, ইস্পাতের ফলার মতো ধারালো নাক, বুদ্ধিদীপ্ত চোখ। শরদিন্দুর চেহারা ছবির সাথে ব্যোমকেশকে একটিবার মিলিয়ে নেওয়া যেতে পারে।

শরদিন্দু তখন থাকেন মেছুয়াবাজারের ওয়াই এম সি এর হোস্টেলে। সেই সময়েই মুঙ্গেরের বেলুনবাজার নিবাসী পারুলবালা দেবীর সাথে বিবাহ হলো শরদিন্দুর। বিয়ের তারিখ বাংলার ১৩২৫ সালের ১৪ আষাঢ়। বিবাহের দিন কয়েক বাদে নব বিবাহিত বধূকে ছেড়ে আবার কলকাতার হোস্টেলে ফিরে এলেন শরদিন্দু। তারপর নবোঢ়ার সাথে নিরন্তর পত্র-বিনিময়। এই তরুণ দম্পতির প্রথম দাম্পত্য জীবনের মান-অভিমানের কয়েক টুকরো ধরা রয়েছে শরদিন্দুর হোস্টেল আর মেসজীবনের ডায়েরিতে। কয়েকদিন পত্র না পেলেই পারুলবালার অভিমান মাখা পত্রাঘাত। ছদ্ম রাগ, অনুরাগ। প্রত্যুত্তরে শরদিন্দু করেছেন মানভঞ্জন। ঠিক যেন ব্যোমকেশ কাহিনীর ব্যোমকেশ-সত্যবতীর অম্লমধুর দাম্পত্য চিত্র।

শরদিন্দু পত্নী পারুলবালা (ডাকনাম রাণু), তখন অন্তঃসত্ত্বা। মুঙ্গেরে শরদিন্দুর পরিবারের সকলেই ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত। শরদিন্দু তখন কলকাতায়। পত্নীকে নিয়ে উৎকণ্ঠা। হঠাৎ একদিন রাত এগারোটার সময় টেলিগ্রাম এসে হাজির। শরদিন্দুর বাবা তারাভূষণ পাঠিয়েছেন। ২৭ জানুয়ারি, ১৯২০ তারিখের দিনলিপিতে শরদিন্দু লিখেছেন :

রাত্রি প্রায় এগারটার সময় শুয়ে পড়েছি এমন সময়ে টেলিগ্রাম (ইং) এসে হাজির। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে

খুলে দেখি—

'পারুল সেফলি ডেলিভারড বয়,

ফাদার। (ইং)

শরদিন্দুর পুত্রলাভ। এর প্রায় বত্রিশবছর বাদে শরদিন্দু লিখলেন—‘দুর্গরহস্য'। সত্যবতী তখন 'ডিম ভরা কৈ'। অজিত আসন্ন ভ্রাতুষ্পুত্র লাভের আশায় খুশিতে ডগমগ। এই সময় হঠাৎ পুরন্দর পাণ্ডের চিঠি। সত্যবতীকে তার দাদার কাছে পাঠিয়ে ব্যোমকেশ আর অজিত বেরিয়ে পড়ে দুর্গ রহস্যে। 

ছাত্রজীবনে এ শহরে শরদিন্দুর তিনটে আস্তানা ছিল। প্রথমদিকে ওয়াই এম সি এর হোস্টেল। পরে কিছুদিন বাদুড়বাগানের মেসে এবং তারপর ৬৬ হ্যারিসন রোডের প্রেসিডেন্সি বোর্ডিং। সেই হ্যারিসন রোড, ব্যোমকেশ বক্সীর বাড়ি। আগের বছরই ১৯১৯-এ শরদিন্দু বি. এ. পাশ করেছেন। আইন পড়তে ভর্তি হয়েছেন ল' কলেজে, শরদিন্দু এসে উঠলেন প্রেসিডেন্সি বোর্ডিং এর তিন তলার ছাদের ঘরে। ২১ নভেম্বর, ১৯২০-র দিনলিপিতে শরদিন্দু লিখছেন—'শিফটেড টু এ হোটেল—প্রেসিডেন্সি হোটেল- ৬৬ হ্যারিসন রোড, খতু ইজ উইথ মি। উই অকুপাই ওয়ান রুম অন দি টপ ফ্লোর চার্জেস ২৩/৮' (ইং)। আনন্দ পাবলিশার্স প্রকাশিত শরদিন্দু অমনিবাসের দ্বাদশ খণ্ডে মুদ্রিত শরদিন্দুর ১৯২০ সালের দিনলিপির ফুটনোট থেকে জানতে পারছি, এই আস্তানাটিকে লেখক বারবার 'মেস' বলে উল্লেখ করতেন। শরদিন্দুর এই উল্লেখে সম্ভবত কোনো ভুল নেই। প্রেসিডেন্সি বোর্ডিং প্রতিষ্ঠিত ১৯১৭ সালে। শরদিন্দু যে বছর এই মেসে আসেন, সেই বছরেরই ১৯২০-তে থ্যাকার্স ইণ্ডিয়ান ডাইরেক্টরি'-তে কলকাতার রাস্তাঘাট ঠিকানার তালিকায় ৬৬ নম্বর হ্যারিসন রোডের এই বাড়িটা 'দি প্রেসিডেন্সি স্টুডেন্টস মেস' নামেই নথিভুক্ত করা হয়। এর বেশ কয়েক বছর বাদের ডিরেক্টরিতে এর নাম উল্লেখ রয়েছে, প্রেসিডেন্সি বোর্ডিং হাউস। তৎকালীন সুপারিনটেনডেন্ট ছিলেন নন্দলাল দত্ত।

মেসবাড়ির সত্যান্বেষী
গৌরব বিশ্বাস

মেস - হোস্টেল ঘটিত এ বাঙালি জীবন
সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়

প্রচ্ছদ ও অলংকরণ : মেখলা ভট্টাচার্য
মুদ্রিত মূল্য : ৬২০ টাকা 
#সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।