একটি শিশির বিন্দু

সম্ভবত ইংরেজরা কিছুতেই চিনা সাহেবের নাম ঠিক মতো উচ্চারণ করতে পারত না। ইংরেজদের উচ্চারণে ইয়াং দাইজাং হয়ে যান টং আছু। সেই থেকেই চিনা আছু সাহেবের নামেই এলাকার নাম হয়ে যায় ‘আছিপুর’। যদিও পরবর্তীতে সেই চিনা বসতি সরে যায় কলকাতারই ট্যাংরা অঞ্চলে, যে জায়গা এখন চায়না টাউন হিসেবে বিখ্যাত। কিন্তু সব ঠিক থাকলে আছিপুরই হতে পারত একটা বিশিষ্ট শিল্পাঞ্চল এবং ভারতে চিনা মানুষদের বাসভূমি।

বস্তুত, একটা সময় পর্যন্ত চিনা জুতো ছাড়া মন ভরত না অনেক বাঙালিরই। কাঠের কাজ বা কাঁচ শিল্পেও কাজ করতেন অসংখ্য চিনা শ্রমিক। কিন্তু চিনি, চিনামাটি, চিনাবাদাম ইত্যাদির ব্যাপক প্রচলন এই দেশে চিনাদের অস্তিত্বকে প্রমাণ করলেও, অষ্টাদশ শতাব্দীর আগে ভারতবর্ষে কোনও চিনা উপনিবেশের সন্ধান পাওয়া যায় না। বর্তমানে চিনা বসতি হিসেবে বিখ্যাত কলকাতার যে অঞ্চলটা, সেটাও গড়ে ওঠে অনেক পরে। অথচ শুধু কলকাতা বা বাংলাই নয়, ভারতবর্ষেই প্রথম চিনা বসতি গড়ে উঠেছিল যেখানে, সেই জায়গা এবং তার স্থপতির নাম প্রায় মুছে যাওয়ার জোগাড় এখন ইতিহাস থেকে।

সেই সময় কলকাতার ইংরেজ সাহেবরা পা বাড়িয়েই আছে চিনের সঙ্গে ব্যবসায়িক যোগাযোগ বাড়ানোর উদ্দেশ্যে। ক্যান্টনের বিখ্যাত ইংরেজ সওদাগর জেমস ফ্লিন্টের সঙ্গে ভালই দহরম-মহরম ছিল আছুর। আছুর কথা পৌঁছেছিল তখন কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়ামের গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের কাছেও। তার কাছেই চিঠি লিখে প্রায় তিনশো বিঘা জমির পাট্টা চেয়ে বসলো আছু। সালটা ১৭৭৮।
জমি পেতে অসুবিধা হবে না, বুঝতে পেরেছিলেন আছু। এমনকি হেস্টিংস নিজে বলেছিলেন যে, চিনাদের মতো পরিশ্রমী জাতিকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য এই আবেদন মঞ্জুর হওয়া দরকার। তাই জমি পাওয়ার নিশ্চয়তা নিয়েই দেশে ফিরে গেলেন আছু। উদ্দেশ্য, চিন থেকে কৃষিকাজে দক্ষ আরও কিছু দেশবাসীকে সঙ্গে নিয়ে আসা।

প্রায় বছর তিনেক পরে ফিরে এলেন আছু। সঙ্গে একশোর বেশি চিনদেশীয় মানুষ, পালিতা কন্যা এবং চৈনিক বৌদ্ধরীতির দুটো মূর্তি। সঙ্গে কয়েকটা পেটিতে ভর্তি করে প্রচুর চা। ফিরে এসেই আছু আবার জমির জন্য তাড়া দিলেন সরকারকে। জমি চাইলেন কলকাতার বাজারের কাছে আর যেখানে জলপথে যাতায়াতের সুবিধা পাওয়া যায়, এমন জায়গায়। সেইসময়ই বজবজের দক্ষিণে একটা জমিকে চিহ্নিত করা হয়েছে জনৈক বেনারসী ঘোষের জমি হিসেবে, যা পড়ে আছে অনাবাদী আর পতিত অবস্থায়। এই জমিটাই তিনি চেয়ে বসলেন, যাতে সেখানে তিনি একটা চিনির কারখানা খুলতে পারেন। জমির পরিমাণ প্রায় তিনশো বিঘা। কিন্তু আছু পেলেন তার অনেক বেশি জমি। প্রায় সাড়ে ছশো বিঘা। এই সব জায়গাই তখন আবার বর্ধমানের রাজার এস্টেটের মধ্যে। বর্ধমানের রাজা, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং আছুর মধ্যে সমঝোতা হল। শেষমেষ ওই সাড়ে ছয়শো বিঘা জমির পাট্টা পাওয়া গেল বাৎসরিক পঁয়তাল্লিশ টাকা খাজনার বিনিময়ে।

কিন্তু চাষবাসটা হবে কিসের? বিষয়ী আছু বুঝতে পেরেছিলেন যে, চা ব্যবসার সঙ্গে চিনির ব্যবসা চালু করতে পারলে ভবিষ্যতে আর্থিক উন্নতির সুযোগ অনেক বেশি। ইংরেজ সরকারের দেওয়া জমিতে আখের ক্ষেত আর চিনির কল স্থাপন করার পর চিন দেশ থেকে আরও মানুষ এসে শ্রমিক হিসেবে যোগ দেন সেখানে। এভাবেই গোটা একটা এলাকা জুড়ে গড়ে ওঠে চিনা বসতি।

একটি শিশির বিন্দু
(বজবজ ও বাটানগর সংলগ্ন অঞ্চলের ছুঁয়ে দেখা গল্প-কথা-রাজনীতি-ইতিহাস)
.....................................
শুভদীপ চক্রবর্ত্তী

প্রচ্ছদঃ সুলিপ্ত মণ্ডল

মুদ্রিত মূল্যঃ ২৯০ টাকা

#সুপ্রকাশ

নীচের ছবিতেঃ হেস্টিংসকে লেখা আছুর চিঠির প্রথম পৃষ্ঠা

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।