অনন্যবর্তী।। দুর্লভ সূত্রধর।।


"টুকু বা তনয় কেউ বাড়িতে নেই। ফাইনাল পরীক্ষার পর তনয়ের টিকি খুঁজে পাওয়া ভার। টুকু গেছে প্রাইভেট পড়তে। বাড়িতে একা কুসুমিতা, তাঁর গনগনে অভিযোগ—বুক পকেটে টুকুর বখে যাওয়ার অকাট্য প্রমাণ— সহসা ভারি অসহায় বোধ করলেন শচীপ্রসাদ। বাবা হওয়া তো সোজা ব্যাপার নয়!

দরজা ভেতর থেকে ভেজিয়ে দিয়ে বিছানায় বসে চিঠিটা পকেট থেকে বের করলেন। হাত কেঁপে গেল তাঁর, আত্মজার গোপন চিঠি পড়তে গিয়ে নিজেকে তস্করের থেকেও হীন বলে মনে হলো। কুসুমিতা হয়তো এক সপ্তাহ ধরে চিঠিসহ উত্তপ্ত হচ্ছিলেন, আজ অগ্ন্যুৎপাতের সবটাই শচীপ্রসাদের অঙ্গে বর্ষিত হয়েছে।

কাগজটার চেহারা দেখে আদৌ প্রেমপত্র বলে মনে হচ্ছে না। সাধারণ ময়লা ময়লা হলদেটে সাদা কাগজ। কাঁপা হাতে চিঠিটার ভাঁজ খুললেন --- বা! কী চমৎকার হাতের লেখা। ঝক্ ঝক্ করছে। সমান সুন্দর টানা টানা লাইন।

কোনো সম্বোধন নেই।

একটি মাঠের বর্ণনা।

ধু ধু করছে ফসল কাটা মাঠ, আকাশ নেমে আসছে অনেক দূরে, মাঝে মাঝে দৃষ্টি আটকে যাচ্ছে কয়েকটি এলোমেলো বাবলা গাছে। সূর্য তখন মাঝ আকাশ থেকে সামান্য পশ্চিমে হেলে পড়েছে। আমি হাঁটছি দিগন্তরেখার দিকে। শীতের এই রোদ বড়ো আরামদায়ক।

এই এত বড়ো দিগন্তবিস্তারী মাঠে একটিও ওয়েসিসের মতো ছোটোখাটো গ্রাম নেই। বাড়িঘরসহ কোনো মানুষ জনের দেখাও নেই। আমি হাঁটছি একা। পৌঁছতে হবে দিগন্ত পেরিয়ে সাতপর্ণী গায়ে।

সেখানে যাদব মাঝির ঘর। ধীবর নয়, গাঁয়ের মোড়ল। সেই অর্থে মাঝি। এই যে এতবড়ো ফসলের খেত, তারপরই সাতপর্ণী গ্রাম। এতবড়ো মাঠের চাষ-আবাদ করে এই গাঁয়ের যাদব মাঝির মতোই আদিবাসী পাড়ার মানুষজন। বেশিরভাগই ওঁরাও। বাকিরা বাগদি, কৈবর্ত্য, নমঃশূদ্র, তেলি।

মনে ভেবো না—এই সব জমি ওদের।

সব জমি ঘোষপুকুরের ঘোষবাবুদের। সান্ডেলদের জমিও আছে অনেকটা। যাদব মাঝিরা দিন মজুর বা ভাগচাষি। ওরা চাষ করে, ফসল যায় বাবুদের বাড়ি।

এখানে না এলে বুঝতেই পারবে না তুমি, তোমার মনে হবে গোটা পৃথিবী এখানে থেমে আছে। শিক্ষা-দীক্ষা নেই, গ্রামে একটাই প্রাইমারি স্কুল । ইলেকট্রিক আছে কিন্তু আলো জ্বলে না। কেরোসিনের আক্রার দিনে সন্ধ্যে হলেই গোটা গ্রাম অন্ধকার। আলো নিভিয়ে গোটা গ্রাম নিদ্রা যেতে চায়। গাঁয়ের বাচ্চা, কিশোরগুলো সারাদিন ডোবাপুকুরে মাছ ধরে বেড়ায়। দু-একটা ছাগল মুরগি পোষে, কেউ বাবুদের গরু চরায়। একটু বড়ো হলেই কাস্তে হাতে বাপের পেছন ধরে।

এমন কি সাতপর্ণীর মেয়েরাও মাঠে খাটে।

এদের বাড়িঘর দেখলে তোমার কান্না পাবে টুকু। মানুষ এমন বাড়িতে থাকতে পারে!

বর্ষাকালে ঘরে-বাইরে জল। গোটা গাঁয়ে প্রায় সব মানুষের পরনেই সামান্য নেকড়ার মতো কাপড়, সারা অঙ্গ ঢাকে না। শীত-গ্রীষ্ম এদের কাছে সমান।

একদিন তোমাকে সাতপর্ণীতে নিয়ে যাবো টুকু। দেখবে কাব্যি করে বলা "আমার সোনার বাংলা' কবেই মরে হেজে গেছে।

আমি যাচ্ছি ঐ গাঁয়ে। ওদের আলো দিতে হবে। ওদের বোঝাতে হবে, জমি চষে ওরা, আর ওরাই আধপেটা খেয়ে থাকে। একদিন এই সব জমি ওদের ছিল, আজ ওদের এক ছটাক জমি নেই। কেন? এখন গাঁ জুড়ে মানুষগুলো নিজেদের বর্গার জন্য, ফসলের জন্য লড়াই করছে।

অবনদা বলেছে-- ওদের বোঝাতে হবে, ওদের পাশে দাঁড়াতে হবে। কেননা, ওরাই তো আসল ভারতবর্ষ। ওরাই তো ভারতের আশি ভাগ। অবনদা বলেছে—হাতে-কলমে এসব কাজ শিখতে হবে। আমাদের মতাদর্শ আসলে কর্মের পথ-নির্দেশিকা।

অবনদাকে বলতে হবে, ইস্কুল করতে হলে সাতপর্ণীর মতো গাঁয়ে ইস্কুল করা দরকার।

তুমি তো জানো টুকু, আমি কী স্বপ্ন দেখি। সেই স্বপ্নে বাড়ি-গাড়ি নেই, আছে সকলের হাসি-আনন্দ গানে ভরা পৃথিবীর স্বপ্ন।

বদলানোর কাজটা কিন্তু সহজ নয়।

আমরা সবাই মিলে চেষ্টা করলে সেটা হবে না? নিশ্চয়ই হবে।

আমার পাশে থাকা চাই।

অনেক অনেক.....

অনেক অনেক... ঐ সহ তোমার....'

সবশেষে শোভন নামসই করেছে।

চিঠিটা কোলের উপর নিয়ে বসে রইলেন স্তব্ধ হয়ে শচীপ্রসাদ।

শেষ দুই ইঙ্গিতময় না বলা লাইনদুটি ছাড়া এটিকে প্রেমপত্র বলে শনাক্ত করা কঠিন।

শচীপ্রসাদ রাগ করবেন কী, সহসা একটি স্বপ্নিল ঘোরের মধ্যে পড়ে গেলেন। কোন গ্রামের কথা শোভন লিখেছে?"



অনন্যবর্তী
দুর্লভ সূত্রধর

প্রচ্ছদ ও অলংকরণ: সৌজন্য চক্রবর্তী

মুদ্রিত মূল্য: ৩২০ টাকা
#সুপ্রকাশ





Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।