নাম তার কমিউন। অনন্ত জানা। মেস হোস্টেল ঘটিত এ বাঙালি জীবন

"রুশ বিপ্লবের অভিঘাত, সমাজতান্ত্রিক তাত্ত্বিকতার প্রসার, সংগঠন গড়ে তোলার তাগিদে সর্বক্ষণের রাজনৈতিক কর্মী হওয়ার দায় এবং সর্বোপরি 'পেশাদার বিপ্লবী' হওয়ার লক্ষ্যে ক্রমান্বয়ে পার্টি অফিস ও অন্যান্য কমিউনিস্ট রাজনৈতিক কর্মীদের যৌথাবাস গড়ে তোলা হয়। হয়তো কমিউন অভিধাটি রুশ বিপ্লবের উদ্দীপনার অবদান। পার্টি-বিভাজনের আগে পরে ছোটোবড়ো নানা ধরনের যৌথ আবাসে— এই সব কমিউনে স্থায়ী বা অস্থায়ীরূপে থেকেছেন মুজফ্ফর আহমদ, সরোজ মুখোপাধ্যায়, মুহম্মদ আবদুল্লাহ রসুল, মহাদেবপ্রসাদ সাহা, নীরদ চক্রবর্তী, প্রমথ চক্রবর্তী, প্রমোদ দাশগুপ্ত, জ্যোতি বসু, কমল সরকার, প্রমোদ দাশগুপ্ত, রবীন সেন, হাসি দত্ত, বাসবপুন্নাইয়া, বি টি রণদিভে, পি সুন্দরাইয়া, নাম্বুদ্রিপাদ, সুকুমার গুপ্ত, বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায়, নন্দগোপাল ভট্টাচার্য, মহম্মদ ইসরাইল, রণেন সেন, বিনয় রায়, কনক দাশগুপ্ত, মলিনা সরকার, বিভূতি গুহ, শচী লাহিড়ী, বেলা চট্টোপাধ্যায়, সোমনাথ লাহিড়ী, বঙ্কিম মুখোপাধ্যায়, ঊষা দত্ত, জলিমোহন কল, মণিকুন্তলা সেন— পরবর্তী যুগের বিমান বসু প্রমুখ অজস্র নেতা-কর্মী এমন-কী পরবর্তী যুগের বিখ্যাত শিল্পী সোমনাথ হোরও এখানে মুজফ্ফর আহমদের সঙ্গে একই কমিউনে থাকতেন। মনে রাখা দরকার— কমিউনে থাকা নেতা কর্মীদের এই উল্লেখ নিতান্তই নমুনামাত্র।

স্বাধীনতাপূর্ব ও পরবর্তীকালে পার্টি নিষিদ্ধ হলে কিংবা রাষ্ট্রীয় দমনমূলক আইনের প্রকোপ এড়াবার জন্য বার বার কমিউনিস্ট কর্মীদের গোপন আশ্রয় গ্রহণ করতে হয়েছে—সেই আশ্রয়গুলিও ছিল কমিউনেরই নামান্তর। পার্টি নিষিদ্ধ হওয়া ও নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হওয়ার এমন এক সন্ধিক্ষণের কমিউন জীবনের বর্ণনা নিয়েছেন সরোজ মুখোপাধ্যয়—

"১৯৪২ সালের ২৩ শে জুলাই। সে ছিল এক আনন্দের দিন। বাইরে থেকে কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা শ্রদ্ধেয় নেতা মুজফ্ফর আহমদের কাছে একখানা চিঠি এল। চিঠিতে লেখা ছিল— আজ থেকে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ও তার সমস্ত শাখা প্রশাখার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার
করে নেওয়া হয়েছে। চিঠিখানি পাঠ করে কাকাবাবু (মুজফ্ফর আহমদ) আনন্দে আটখানা ...

আমাদের ডেনে (গোপন আবাসস্থান) কাকাবাবু সেদিন ভালো যাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করলেন। অর্থাৎ ভাত আর মাংস, দই আর সালাদ। কাকাবাবু নিজে খুব ভালো মাংস রান্না করতে পারতেন। গোপন যুগের আবাসস্থলে আমাদের সব কাজের ভাগ ছিল। আমি, জ্যোতি বসু, ভূপেশ গুপ্ত, জলি কল— আমরা সবাই ঘর ঝাড় দেওয়া, বাসন ধোওয়া, কাপড় কাচা ইত্যাদি কাজ করতাম। কাকাবাবু, আব্দুল হালিম আর রসুল সাহেব (মুহম্মদ আবদুল্লাহ রসুল মাঝে মাঝে আমাদের ডেনে আসতেন) এবং বিভূতি গুহ রাঁধতে পারতেন ভালো। প্রমোদ দাশগুপ্ত ভালো রাঁধতেন। অবশ্য তিনি প্রকাশ্যে ছিলেন ও গ্রেপ্তার হয়ে হিজলী জেলে চলে যান। ডেনে দু একদিন এলে রাঁধতেন। সোমনাথ লাহিড়ী অবশ্য ডেনে এসব কিছু করতে ভালোবাসতেন না। তিনি লেখাপড়া, বইপড়া নিয়ে থাকতেন অথবা শুয়ে থাকতেন। এই সময়টায় গোপন আবাস থেকে আমাদের মহিলা কমরেডরা বেরিয়ে প্রকাশ্যে চলে গেছেন।" (ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ও আমরা, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ. ১)

পার্টি পরিচালিত কমিউনগুলি কেমন ছিল, কেমনভাবে সেগুলির কৃচ্ছ্র শাসিত জীবন চলত তার একটু আভাস পাওয়া যায় এমন বিবরণে : প্রমোদ দাশগুপ্ত একসময় কলকাতা কর্পোরেশনের এন্টালি গ্যারেজে ফোরম্যানের চাকরি করতেন। সেই সময়ে তিনি বারবার মুজফ্ফর আহমদের কাছে চাকরি ছেড়ে সর্বক্ষণের পার্টি কর্মী হওয়ার আপনার করতেন। কিন্তু মুজফ্ফর আহমদ তাঁকে বুঝিয়েছিলেন যে, তিনি চাকরি ছেড়ে দিলে আর্থিক-সংকটগ্রস্ত পার্টির আরও বেশি আর্থিক সংকট দেখা দেবে। কেননা, প্রমোদ দাশগুপ্তের বেতনের টাকাতেই পার্টির একটি কমিউন চলে। কমিউনটি চালানোর মতো অর্থের সংস্থান করে নেবার পর মুজাফ্ফর আহমদ, সকলের কাকাবাবু প্রমোদ দাশগুপ্তকে চাকরি ছাড়বার অনুমতি দেন এবং তাঁকে সর্বক্ষণের কর্মীও করা হয়। বিভিন্ন সময়ে পার্টির সাপ্তাহিক মুখপত্র 'জনযুদ্ধ' আর দৈনিক 'স্বাধীনতা' পত্রিকার প্রকাশনা ও পরিকল্পনার দায়িত্ব, কিংবা সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সারা জীবন প্রমোদ দাশগুপ্তের স্থায়ী ঠিকানা ছিল পার্টি অফিস বা পার্টি কমিউন। পার্টির দেওয়া একটা ঘরে থেকেছেন, আজীবন তাঁর পরনে যে যোগ-দুরস্ত ধুতি-পাঞ্জাবি শোভা পেয়েছে তা গেঞ্জিসমেত নিজে হাতে কেচেছেন— সকলের জন্য নির্ধারিত কমন কিচেনের খাবার খেয়েছেন।"

নাম তার কমিউন
অনন্ত জানা

মেস হোস্টেল ঘটিত এ বাঙালি জীবন
সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রচ্ছদ ও অলংকরণ : মেখলা ভট্টাচার্য

মুদ্রিত মূল্য : ৬২০ টাকা
#সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।