মেস-হোস্টেল ঘটিত এ বাঙালি জীবন।। সম্পাদনা: সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।

"পরদিন সকালে কিন্তু ঠাকুরকে মাছের কথা বলবার সুযোগ পেলাম না। তাকে একান্তে পেলাম একেবারে খাবার সময়ে। রাত্রিকালে সকলে একত্রে আহার করে দিনের বেলা কিন্তু সে যার প্রয়োজনমতো যখন সুবিধে খেয়ে নেয়। সে সময়ে বেলা এগারোটায় সময়ে প্রেসিডেন্সি কলেজ আরম্ভ হতো, বাকি সব কলেজই শুরু হতো সাড়ে দশটা বেলায়। সুতরাং আমি যখন খেতে বসলাম, তখন প্রায় সকল সদস্যই আহারাদি সমাপন করে বেরিয়ে গেছে।

ঠাকুর থালা এনে আমার পাতের সামনে রাখলে। পরিপাটি ক'রে বাড়া অন্ন, বেশি বেশি ব্যঞ্জন, চার খণ্ড মৎস্য। তা-ও প্রত্যেক খণ্ডই বৃহদাকার, পূর্বরাত্রে যে আকারের মাছ খেয়েছিলাম তার অন্তত দেড়া। 

থালা রেখে আমার সামনে বসে স্মিতমুখে ঠাকুর বললে – বাবু, যদি রাত্রেও এখানকার মতো একটু আগে-পাছে করে বসেন, তা হলে একটু জুৎ করে খাওয়াতে পারি।' 

চারখানা মাছ দেখেই মেজাজ বিগড়ে গিয়েছিল, তার উপর এই কথা শুনে পিত্ত জ্বলে গেল। তথাপি নুতন লোক আমি, কতকটা নরম সুরেই বললাম—'তুমি কি মনে করছ ঠাকুর, মাছের লোভে আমি সকলের পরে খেতে বসেছি?' 

সবেগে মাথা নেড়ে জিভ কেটে ঠাকুর বললে — 'রাম। রাম। তাই কখনও মনে করতে পারি? মাছের আপনার কি অভাব? আপনি একা বসলে আমি একটু জুৎ পাই।' 

বললাম—“কিন্তু জুৎ তো আমারও পাওয়া দরকার। কাল রাত্রে তুমি লুকিয়ে দু-টুকরো মাছ আমাকে বেশি দিয়েছিলে, তা খেতে আমার ভারি খারাপ লেগেছিল।' 

অবাক হয়ে বিস্ফারিত নেত্রে ঠাকুর বললে—'কেন?'

ঠাকুরের কথার সুরে বুঝতে পারলাম, আমার মন্তব্যের আসল তাৎপর্যই সে গ্রহণ করতে পারেনি। চিরদিন বাবুদের বঞ্চিত করে মাছ খেয়ে খেয়ে যে রসনা পাকিয়েছে, চুরি-করা মাছ খেতে কারও খারাপ লাগতে পারে, এমন কথা তার ধারণারই অতীত। ঠাকুরের কথার কোনো সোজা উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম—'আজ বাবুদের কখানা করে মাছ দিয়েছিলে ঠাকুর ??

ঠাকুর বললে— 'দুখানা করে।'

-তা হ'লে আমাকে চারখানা কেন?"

-আপনার সঙ্গে বাবুদের তুলনা? এঁরা হলেন মেম্বার, আপনি গেস্টো (guest )।

—ওঁদেরও কি এমনি বড়ো বড়ো টুকরো দিয়েছিলে ??

মৃদু হেসে ঠাকুর বলেন—‘উনিশ-বিশ।

-কার বিশ? আমার, না ওঁদের?"

সোজা উত্তর না দিয়ে, বোধ করি আমাকে কিছু খুশি করবারই মতলবে ঠাকুর বললে- 'আপনার জন্যে একটু বেছে-বুছে রেখেছিলাম।'

বেছে-বুছে আদৌ নয়। মাছ কোটবার সময়ে চাকরকে দিয়ে ঠাকুর বড়ো বড়ো কয়েক খণ্ড কুটিয়ে নিয়েছিল, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই, রাত্রের জন্যও নিশ্চয় এই রকম চার টুকরো মাছ আমার জন্যে পৃথক করা আছে। এইরূপ বৃহদাকার আট টুকরো মাছের দ্বারা যে পরিমাণ ন্যায়সঙ্গত মাছ হতে মেসের মেম্বারদের বঞ্চিত করেছি, তার কথা ভেবে মনের মধ্যে গভীর গ্লানির গ্লানি উপস্থিত হলো। বললাম- "শোনো ঠাকুর, আমি গেস্টোই হই আর যা-ই হই, মেম্বারদের যেমন মাছ দেবে আমাকে ঠিক তেমনিই দেবে। তুমি তো দু-টুকরো মাছ ভাতের ভেতর আর ডালের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে খালাস, আমিও না হয়। তোমার মান আর আমার নিজের মান বাঁচাবার জন্যে কোনো রকমে বাড়তি মাছ দু-খানা লুকিয়ে খেলাম—কিন্তু কাঁটা? থালার পাশে চারখানা মাছের কাঁটা যে দু-খানা মাছের কাঁটার ডবল আকারে উঁচু হয়ে ওঠে, তার কী করবে বলো? মান বাঁচাবার জন্যে মাছ না হয় লুকিয়ে খেলাম, কিন্তু লুকিয়ে কাঁটা খেলে প্রাণ বাঁচবে কি? অতএব ওসব লুকোচুরিতে আর কাজ নেই, দু-টুকরো মাছেই আমি খুব খুশি হব, এবার থেকে তুমি আমাকে মেম্বারদের সঙ্গে ঠিক একভাবে মাছ দেবে। আপাতত তিনখানা মাছ তুলে নাও।'

সবিস্ময়ে ঠাকুর বললে—'মাত্র এককানা খাবেন।'

বললাম, 'এ একখানা মাছ বাবুদের দেওয়া দু-খান মাছের সমান হবে।' 

-"কিন্তু বাবুরা তো এখন কেউ নেই, তবে আপনার আপত্তি কিসের?' 

– সে কথা তুমি বুঝবে না ঠাকুর। তিনখানা মাছ তুমি তোলো।' 

কাতরকণ্ঠে ঠাকুর বললে-- 'সে তিনখানা মাছ কার মুখ দোব বাবু? বাবুদের দেওয়া চলবে না, আমাদের মুখেও রুচবে না।' 

বললাম—“তা যদি একান্তই না রোচে, তোমাদের মেসে তো একটা বৃহৎ সাইজের বেড়াল আছে, তাকে দিয়ো; তার মুখে বাধবে না।'

পাত থেকে একখানা মাছ তুলে নিয়ে ব্যগ্রকণ্ঠে ঠাকুর বললে — আর কোনো আপত্তি করবেন না বাবু,—আপনার কথা রাখলাম।'

পাপের ফাঁসে মানুষ যদি একবার মাথা গলায়, আর তার রক্ষা থাকে না ; নৈতিক শক্তি হারানোর ফলে পাপ যখনই টান দেয় তখনই সে অনিচ্ছা সত্ত্বেও পাপের দিকে এগিয়ে যায়, পরিপূর্ণ শক্তি দিয়ে প্রতিবাদ করতে পারে না। কাল রাত্রে চোরাই মাছ দুটি ভক্ষণ করার ফলে আমিও আমার নৈতিক শক্তি হারিয়েছিলাম, ঠাকুরের সহিত রফায় সম্মত হতে হলো।" 




মেসের ঠাকুর
উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়

মেস - হোস্টেল ঘটিত এ বাঙালি জীবন
সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়

প্রচ্ছদ ও অলংকরণ : মেখলা ভট্টাচার্য
মুদ্রিত মূল্য : ৬২০ টাকা 
#সুপ্রকাশ


Comments

Popular posts from this blog

প্রতিযাত্রা।। দুর্লভ সূত্রধর।। সুপ্রকাশ।।

লেটারপ্রেসের কম্পোজিটর : এক বিষাদান্ত পরম্পরা।। অনন্ত জানা।। সুপ্রকাশ।।

সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম।। মিহির সেনগুপ্ত।। সুপ্রকাশ।।