সমর ভট্টাচার্য রচনা সংগ্রহ।। সম্পাদনা: শতঞ্জীব রাহা।।

"সার্কিস্তাবয় মাইকেল শিবু মুর্মুর মৃতের উদ্দেশে ঘন্টাধ্বনি শুনে ঘুম ভেঙে গেল যোশেফ ইউসুফের।

এখনও রাত্রি শেষ হয়নি।

তাকিয়ে দেখল চারিদিকে। এখনও রাত্রি ধূসর চাদর গায়ে খোলা জানালার বাইরে দণ্ডায়মান। মনে করবার চেষ্টা করল, শব্দটা সে নিদ্রায় না জাগরণে শুনেছে। স্বপ্নের ভিতর নয় তো? কিন্তু না, শব্দটা এখনও হচ্ছে। ধাতব শব্দ... সেই একই লয়ে, পরিচিত সুরে বেজে চলেছে ঢং-ঢং-ঢং-ঢং-ঢং...

ইউসুফ মরিয়মকে ডাকল—'এই ওঠো, ওঠো—'

—'কী হলো?' ধড়মড়িয়ে উঠে প্রশ্ন করল মরিয়ম।

—'কেউ গেল মনে হচ্ছে। শুনতে পাচ্ছ না ঘন্টা বাজছে।'

—'হ্যাঁ, তাই তো—চলো বাইরে বেরিয়ে দেখি।'

যোশেফ ইউসুফ আজকাল লাঠি ছাড়া হাঁটতে পারে না। মাথায় পিথেনের পাশেই রাখা আছে সেটা। মরিয়ম আগে উঠেই দরজা খুলেছে।

যোশেফ লাঠি ঠুকে ঠুকে এসে দাঁড়ায় মরিয়মের পাশে। গির্জেতে যাওয়ার সদর রাস্তার পাশেই তাদের বাড়ি। বাঁ হাতে চৌমাথা। ডান হাতে সোজা গির্জেতে যাওয়ার ইট বাঁধানো রাস্তা। ভোর হয়ে আসছে। পূর্বদিকে একটি দিন শুরু হওয়ার আশ্চর্য দ্যুতি। এসময় চৌমাথায় গাব্রিয়েল তার চায়ের দোকানের উনুনে আঁচ দেয়। ধোঁয়া ওঠে। ওপাড়ায় রাজমিস্ত্রী-জোগালেরা সকলেই গাব্রিয়েলের দোকানে চা আর সেকাঁ-পাউরুটি খেয়ে কাজে যায়। আজ ধোঁয়া বেরুচ্ছে না উনুন দিয়ে। তবে কি কোনো বড়ো ধরনের মানুষ চলে গেলেন পৃথিবী ছেড়ে? একটু পরেই দু-জন মানুষকে দ্রুত গির্জের দিকে যেতে দেখে জিজ্ঞেস করল যোশেফ –'কোথায় যাচ্ছ? কী হলো?'

হাঁটতে হাঁটতেই তাদের একজন জবাব দিল—'ফাদার গীলবার্ট দেহ রেখেছেন।'

—'এ্যাঁ!' যোশেফের অভিব্যক্তিতে কোনো খাদ ছিল না। সে বলল – 'বড়ো মহাপ্রাণ ছিলেন।' উদাস কণ্ঠ বাজল যোশেফের—'এত স্নেহ ছিল ভিতরে ওঁর—খুব কম দেখা যায়...'

সাদা পোশাক পরা, একমুখ কাঁচাপাকা দাড়ি গীলবার্ট সাহেবকে যেন দেখতে পেল যোশেফ। কথা শুনতে পেল তাঁর—'আমরা সকলে ক-দিনের জন্যে এখানে বেড়াতে আসি, আবার চলে যাব।' 

মরিয়ম এবং যোশেফ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করল, বুকে রুশ আঁকতে আঁকতে উচ্চারণ করল :

পিতা পুত্র পবিত্র আত্মা নামে তথাস্ত
হে আমাদের স্বর্গস্থ পিতঃ 
তোমার আত্মা যেমন স্বর্গে তেমনি মর্তো পুণ্য হোক
আমেন....

একটু বেলা বাড়তেই গির্জের রাস্তায় ভিড় শুরু হয়। স্ত্রী-পুরুষ, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, সকলে যাচ্ছে। ফাদার গীলবার্টকে শেষ শ্রদ্ধা, ভালোবাসা জানাতে। যিনি স্মিত হেসে সকলকে বলতেন— 'কোনো ধর্ম নয়। মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা হচ্ছে পরম ধর্ম। তুমি যদি আমাকে ভালোবাসো, আমি তোমাকে ভালো না বেসে থাকতে পারব না। দয়াময় প্রভু যিশুও তাই বলতেন'— সেই মানুষটিকে।

মরিয়ম আর যোশেফ ইউসুফও প্রস্তুত হচ্ছিল গির্জে যাওয়ার জন্যে। কিন্তু যাওয়া হলো না। এ সময়েই ব্রাদার সোবাস্তিন ওদের কফিনের দোকানে ঢুকলেন গির্জের কিছু কর্মচারিকে নিয়ে। তাঁকে দেখে মরিয়ম এবং যোশেফ যীশুপ্রণাম জানাল।

—'যীশুপ্রণাম'—ব্রাদার সোবাস্তিন প্রণাম গ্রহণ করলেন। তারপর করলেন কুশল প্রশ্ন- "ভালো আছ তো যোশেফ ?'

—'আজ্ঞে হ্যাঁ।'

—'শুনেছ তো, ফাদার চলে গেলেন। একটা ভালো কফিন লাগবে।'

—'হ্যাঁ, তা তো লাগবেই!'

ব্রাদার সোবাস্তিন ঘুরে ঘুরে কফিন দেখতে দেখতে এক সময় যোশেফের আর মাইকেল শিবু মুর্মুর কফিনের কাছে দাঁড়ালেন। চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল তাঁর। 'বাঃ! সুন্দর...!'

বুকের মধ্যেটা চমকে উঠল যোশেফ ইউসুফ মিস্ত্রীর। মাইকেল শিবু মুর্মুর জন্যে যে কফিন এতদিন ধরে তৈরি করেছে, কাঁচ, গালা, স্পিরিটের ওপর শুকনো ন্যাকড়া ঘসে ঘসে এমন পালিশ তুলেছে এখন মুখ দেখা যায়, সেটিই খুব পছন্দ হয়েছে ব্রাদারের।

ব্রাদার সোবাস্তিনের সারা মুখমণ্ডল প্রসন্নতায় ভরে উঠল—'সুন্দর। অমন মহাপ্রাণ মানুষকে এরকম কফিনেই শ্রদ্ধা জানানো যায়।'

— 'কিন্তু ব্রাদার, আমি যে ওটা আমার বন্ধু মাইকেল শিবু মুর্মুর জন্যে তৈরি করেছি। তার চেয়ে বরং এটা নেন—এটাও কম ভালো নয়। এর কাজও চমৎকার!' মৃদু আপত্তি জানিয়ে নিজের কফিনটা দিতে চাইল যোশেফ ইউসুফ ব্রাদার সোবাস্তিনকে। 

—'না না, এটাই ভালো হবে। আর তাছাড়া তুমি তো এখনও ভালো কাজ করতে পার। এর চেয়েও ভালো কারুকার্যময় কফিন তুমি বানাতে পারবে যোশেফ।' বলে গির্জের কর্মচারিদের নির্দেশ দিলেন—'নাও তোলো, দেরি হয়ে যাচ্ছে, এখনও বহু কাজ বাকি।'

যোশেফ ইউসুফ তাকিয়ে থাকল কফিন নিয়ে এগিয়ে যাওয়া রাস্তার দিকে। মনে মনে বলল—'ব্রাদার তুমি তো জানো না যে কতখানি আন্তরিক ভালোবাসা নিয়ে ওটা বানিয়েছিলাম, এখন যতই মন দিই না কেন অমনটি আর হবে না। শিল্প বারবার এক হয়ে ফিরে আসে না। কোনো কিছুই না।'

বেলা বারোটা নাগাদ ফাদার গীলবার্টকে নিয়ে শোকযাত্রা বেরুলো। রাস্তার দু-পাশে মানুষের ভিড়।

শোকযাত্রাটি সমস্ত রাস্তা ঘুরে শেষে সমাধিস্থ করা হবে।

আগে চলেছেন ধর্মযাজক, পুরোহিত সম্প্রদায় সাদা পোশাকের ওপর কালো ওড়না জড়িয়ে। বাইবেল পাঠ করতে করতে।

তার পিছনে মিশনারি ইস্কুলের ছেলেমেয়েরা ক্রুশের কাজ করা পোশাক গায়ে দিয়ে প্রার্থনামন্ত্র উচ্চারণ করে চলেছে।

পিছনে ফাদার গীলবার্ট শুয়ে আছেন সার্কিস্তাবয় শিবু মুর্মুর কফিনের ভিতর নিশ্চিন্ত নিদ্রায়। কার কফিনের ভিতর শায়িত হয়ে আজ যে তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছেন এটা জানবার কোনো উপায় থাকলে নিশ্চয় প্রতিবাদ করে উঠতেন, বলতেন—'এ তোমরা কী করছ? ভালোবাসা কী তা তোমরা কি আজও শেখোনি, কোনোদিন শিখবে না!'

শোক মিছিলটা সর্পিল গতিতে এগিয়ে চলেছে।

যোশেফ, মরিয়ম দাঁড়িয়ে আছে বারান্দাতে। প্রার্থনামন্ত্রও উচ্চারণ করতে ভুলে গিয়েছে তারা। মিছিলটার দিকে তাকিয়ে যোশেফের মনে হচ্ছে—স্বর্গের বাগানে যে শয়তানবেশী সাপটা আদম-ইভকে জ্ঞানবৃক্ষের ফল খেতে অনুপ্রাণিত করে তাদের রিপু জাগ্রত করেছিল, সেই সাপটা এখনও বেঁচে আছে। ঘুরে বেড়াচ্ছে গোটা পৃথিবীময়। মানুষের কানে কানে বলছে, তোমরা এখনও যথেষ্ট সভ্য হতে পারনি। আরও সভ্য হও...... নগ্ন, হিংস্র, বর্বর তোমরা—সভ্য হও। কিন্তু সাপটাকে কেউ মারছে না। সাপটা কি কোনোদিন মারা যাবে না। কে মারবে? কোনো আগামী প্রজন্ম ?

যোশেফ-মরিয়ম দাঁড়িয়ে থাকে পাশাপাশি। যোশেফের বাঁ-চোখ জ্বালা করে দু-ফোঁটা অশ্রু ঝরে পড়ে। মরিয়মের মুখখানা দেখায় কঠিন কর্কশ। চোখ দুটো স্থির।"



বাইবেলের সাপ 

সমর ভট্টাচার্য রচনা সংগ্রহ
সম্পাদনা: শতঞ্জীব রাহা

প্রচ্ছদ ও অলংকরণ : মেখলা ভট্টাচার্য
মুদ্রিত মূল্য : ৩৯০ টাকা

#সুপ্রকাশ
 


Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।