একটি শিশির বিন্দু

পায়রা ওড়াতে পারতো বাবুদা। বাড়ির উঠোন থেকে পায়রা উড়িয়ে, নিখুঁত হাততালিতে আবার নামিয়ে নিয়ে আসতো তাদের। তারপর ভাড়া বাড়ি ছেড়ে বাবুদারা নিজেদের নতুন বাড়িতে উঠে গেলে, নিভে গেল একটা যোগাযোগ। স্কুল পড়ুয়া সিক্স-সেভেনের কাছে হাইস্কুলের বাবুদা ছিল একজন নিখাদ বিস্ময়। ফুটবল মাঠে ঘামে ভেজা শরীরের মতো আকর্ষণ।

তার দীর্ঘদিন পরে এই নিভে যাওয়া যোগাযোগ বাতি পায় লাস্ট লোকাল ট্রেনে। শীতকাল, তবু দরজাতেই দাঁড়ায় দু’জন। হাতে লাল তাগা। সেই ঠোঁট ছড়ানো হাসি। শৈশবের সেই ম্যানড্রেক! “কতদিন পর দেখা হল বাবুদা! পায়রা ওড়াও এখনও?” “ধুর, পাগল! তোর চশমা হল কবে? বাড়িতে আয় একদিন, গল্প হবে!”

বাড়িতে যাওয়া হয়। বলে ফেলা হয় না-পারাগুলো সব। কলেজ, বাড়ি, টিউশন, আড়চোখ। সবাইকে লুকিয়ে কবিতা। একা একা গঙ্গার ধার।

— বড় হওয়াটা ভাল লাগছে না বাবুদা। চারপাশে এত ভিড় ভাল লাগছে না।
— তাতে কী? তুই একটু একলা হাঁট, বাবুদা বলে। নিজের সঙ্গে একলা হওয়া একটা আর্ট। নিজের ধর্মটা বুঝতে পারলেই নিজেকে খানিকটা বুঝতে পারবি তুই।
— ধর্ম কী বাবুদা? আমি তো ঠাকুর মানি না!
— আরে ধুর! ঠাকুর-দেবতা মানাটা ধর্ম নাকি? ধর্ম হল, যা ধারণ করে। তুই তোর ভিতরে ভালবাসা ভরে নে, সেটাই তোর ধর্ম। ক্ষমা ভরে নে তোর ভিতর। অবশ্য ভরতেই হবে তার কোনও মানে নেই। রাগ, হিংসা, ঘেন্না এগুলোও ভরতে পারিস। তোর চয়েস।
— তোমার ব্যাগ গোছানো কেন বাবুদা?
— আরে চেন্নাই যাব। ছোট একটা অপারেশন আছে। মাথায় একটা টিউমার…
— ওহ্! ঠিক হয়ে যাবে তো?
— ইজিলি! যাওয়ার আগে একবার গঙ্গার ধারটা ঘুরে আসতে ইচ্ছা করছে। চল তো…

বাবুদার সঙ্গে দেখা হয় না আর। কিন্তু যোগাযোগের বাতিটা নেভে না তবু। চারপাশ দেখে আজও ধর্মের ধারণা গুলিয়ে যেতে চায় তার। গুলিয়ে যেতে চায় ইতিহাস। “ইতিহাস ভুলে গেলেও, গল্পে থাকিস…” বাবুদা কথা বলে ওঠে কোথা থেকে যেন।

গল্প? শুয়ে শুয়ে মাথা নাড়ালে এপাশ-ওপাশ, গল্পের সঙ্গে সময়-কালও গুলিয়ে যায় কেমন যেন। একপাশে অতীত পড়ে থাকে, অন্য দিকে ভাবীকাল। বর্তমান হাতড়ে যায় শুধু। হাতড়াতে হাতড়াতে সন্দেহ করতে থাকে নিজের যাবতীয় যা খোঁজ, সবকিছুকে। এই যেমন এক্ষুনি তার মনে হল, টং আছু চিঠিতে যে জায়গা চেয়েছিল, সেটাকে তো বলেছিল বালিয়া পরগণার অন্তর্ভুক্ত। বালিয়া পরগণা? সেটার খোঁজ কোথায় তাহলে? পিছোতে হবে কি আরও একটু?

১৫৮২ সাল। রাজস্ব আদায় করতে নতুন ভাবে কাগজপত্র তৈরি করছেন আকবরের রাজস্ব সচিব টোডরমল। উড়িষ্যা সহ সুবে বাংলাকে ভাগ করলেন তিনি চব্বিশটা সরকারে। চব্বিশটা সরকার আবার ভাগ হল প্রায় আটশোটা মহাল বা পরগণায়। মুর্শিদাবাদ থেকে নদীয়া, চব্বিশ পরগণা হয়ে ডায়মন্ডহারবার পর্যন্ত এলাকা নিয়ে ছিল সাতগাঁও সরকার। এই সাতগাঁওয়ের মধ্যে তিপ্পান্নটা পরগণার মধ্যে বালিয়া ছিল অন্যতম। পরগণা হত গ্রাম বা মৌজা নিয়ে। এই বালিয়া পরগণার মধ্যে ছিল বজবজ, পুজালি, আছিপুর বা নুঙ্গী, সন্তোষপুরের মতো গ্রাম।

১৭২২ সালে মুর্শিদকুলি খাঁয়ের সময়ে এই বালিয়া পরগণা আবার ভাগ হল উত্তর আর দক্ষিণ বালিয়ায়। এইসব অঞ্চল স্থায়ী হল দক্ষিণ বালিয়াতেই অতএব।

তারপর জনবিন্যাসের সাধারণ নিয়ম মেনেই যেন কবে থেকে জনবসতি বাড়তে লাগল এই এলাকার। দুর্গের কাজে এসে হাবিলদার গোষ্ঠী হয়ে গেলেন এতদঅঞ্চলের হালদার সম্প্রদায়। এলেন পাঁজাল বা ঘোষেরাও। নদীর পাড়ের গাঁ-ঘর সব। চাষবাসের সঙ্গেই কুমোর বা জেলে সম্প্রদায়ের আদি বাসিন্দাও খুব কম কিছু নেই এলাকায় তখন। কিন্তু বাইরে থেকে আসা এই সম্ভ্রান্ত সম্প্রদায় ধর্মাচারণের মাধ্যমেই যেন মিশে গেলেন এলাকার বাকি জনগোষ্ঠীর সঙ্গে। গ্রাম্য দেবতার পুজো শুরু করলেন তারা।

ধর্মের গতিপথ আসলে শাসক বা ক্ষমতারই প্রতিফলন যেন। একাদশ শতকে হিন্দু সেন রাজাদের আমলে দুর্বল হয়ে পড়ল বৌদ্ধধর্ম। হিন্দুধর্মের আচার অনুষ্ঠান ঢুকে পড়ল বৌদ্ধধর্মের অন্দরমহলে। স্বয়ং ভগবান বুদ্ধ হয়ে পড়লেন হিন্দু দেবতার অবতার। মূর্তি বানিয়ে পুজো শুরু হল বুদ্ধের। শুধু তাই নয়, পুজো শুরু হল এমনকি স্বয়ং ধর্মেরও! এই ধর্মঠাকুরই হয়ে উঠলেন লৌকিক দেবতা।

ধর্মঠাকুর বা বাবাঠাকুরের প্রতিষ্ঠা হল পাঁজাল পাড়া, পাইকপাড়া, শ্যামপুর বা সারেঙ্গাবাদেও। এই ঠাকুরের আবার নাম বদলে যায় স্থান বিশেষে। আসলে, দেবতা তো মানুষেরই! মানুষের গানেই তাঁর নাম! তাই পাঁজাল পাড়ার ধর্মঠাকুরের নাম হয় বিনোদ রায়। সারেঙ্গাবাদে আবার সেই তিনিই কালু রায়। হিন্দুধর্ম জেগে ওঠে ভগবান শিবের হাত ধরেই যেন। শিবের গাজন ধর্মঠাকুরের পুজোর অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে দাঁড়ায়। হালদার পাড়ায় প্রতিষ্ঠা হয় শিব মন্দিরেরও। ঘটা করে পুজো শুরু হয় হালদারদের কুলদেবতা রাজরাজেশ্বরের, যা একটি বিশেষ শালগ্রাম শিলা।

এই ধর্মের হাত ধরেই পোঁছে যাওয়া যায় আরও অতীতে কত! বৌদ্ধধর্মে তো জাতিভেদ ছিল না। ধর্মঠাকুরের পুজোও তাই যেন হিন্দু নিম্নবর্গের মধ্যে প্রচলিত থাকলেও, ক্রমশ তা প্রবেশ করলো উচ্চবর্ণেও। জানা যায়, একাদশ শতকের মাঝামাঝি রামাই পন্ডিত নামের এক তান্ত্রিক সাধক তাঁর ‘শূন্যপুরাণ’ আর ‘ধর্মপূজা বিধান’ নামের দুটো বইতে নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিলেন এই পুজোর পদ্ধতির। এই রামাই পন্ডিত জাতিতে ছিলেন ডোম। এদিকে বজবজ অঞ্চলে ভিড় বাড়ছিল যে সকল এলাকা থেকে, সেই বর্ধমান, হাওড়া, হুগলি অঞ্চলে ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল ধর্মপূজা। তাই, ধর্মঠাকুরের পুজোর জন্য হালদারেরা যে উপাসক নিয়োগ করেন, তিনিও যে তান্ত্রিকই হবেন, তাতে আর আশ্চর্য কী!

বজবজে এমনকি পাথর রূপেও পুজো পেতে দেখা গেছে ধর্মঠাকুরকে। পরে পাথরের জায়গায় ঘট আর আরও পরে এসেছে মূর্তি। পাথর পুজো সাধারণত প্রাথমিক যুগেই দেখা যায়। সেই হিসেবে, বজবজের আদি জনবসতি প্রাচীনতর অবশ্যই।

এখন গেলে দেখা যায়, পাঁজাল পাড়ায় ধর্মঠাকুরের মন্দিরের চাল টিনের। মন্দিরের সামনে কয়েকজন তাস খেলছে বিকালে। আবহাওয়া দফতর বললেও, দেখা মেলেনি কালবৈশাখীর। বাতাসের গরম তবু অনেকটাই ঠান্ডা দুটো পুকুরের কারণে। পাশাপাশি দুটো পুকুরের মাঝ দিয়ে এগিয়ে যাওয়া সরু রাস্তার শেষেই ধর্মঠাকুরের মন্দিরের চত্বর। চারপাশে অনেক সবুজ। বাঁশবন। পানা পুকুরও একটা। বাচ্চারা মোবাইল নিয়ে নয়, বরং রেলগাড়ি সেজেছে উঠোনে। ধর্মঠাকুরের মন্দিরের পাশেই লক্ষীমায়ের মন্দির একটা।

মন্দিরের সামনের এই ফাঁকা চত্বরেই চৈত্রমাসে হয় চড়কের ঝাঁপ। কিন্তু পুজো শেষ না হওয়া অবধি সেই ঝাঁপ হবে না কিছুতেই। নিয়ম নেই। কীসের নিয়ম? ধর্মঠাকুরের?

আসলে, কিংবদন্তী বলে, ধর্মঠাকুরের কাজ হল ধর্মের জয়ধ্বজা উড়িয়ে চলা। ধর্ম, অর্থাৎ, অন্যায়ের বদলে ন্যায়। পথ যেখানে হতেই হবে সঠিক সবসময়। তাই সকাল থেকে ধর্মের কাজ সেরে দুপুরের একটা নির্দিষ্ট সময়েই বাবাঠাকুর এসে বসেন আসনে, আর তখনই শুরু হয় পুজো। পুজোয় সংস্কৃত মন্ত্র নেই কোনও। মূলত নিম্নবর্গের পুজো হলেও, জেলে, ডোম বা চাঁড়ালদের সঙ্গে এই পুজোর আবহে মিশে যেতে অসুবিধা হয়নি কখনোই বাকি তথাকথিত উচ্চবর্ণের। পুজোয় দেবতাকে সম্বোধন করা হয় দেশীয় ভাষাতেই। দেবতার থানে, একটা নির্দিষ্ট জায়গায় রাখা হয় ফুল। ফুলের নিচে অনেকের মতোই হাত পেতে দাঁড়ান মূল উপাসকও। ওদিকে ঝাঁপের জন্য তৈরি ঝাঁপানের দলও। কিন্তু সেই ফুল হাতে না পড়া অবধি শুরু হবে না ঝাঁপ। বাবাঠাকুরের কাছে প্রার্থনা চলতে থাকে। “ফুল ফেলো বাবা! ফেলো!” সময় চলে যেতে থাকলেও অধৈর্য হয় না কেউ। ধর্মঠাকুর অধর্মের কাজ করতেই পারেন না। হঠাৎ গুঞ্জন শুরু হয় একটা। একসময় হাতে এসে পড়ে সেই ফুল। পড়ে সেই উপাসকের হাতেই। ঝাঁপ শুরু হয় এবার। রব ওঠে, “জয় বাবা ভোলেনাথের চরণে সেবা লাগি...”

একটি শিশির বিন্দু
(বজবজ ও বাটানগর সংলগ্ন অঞ্চলের ছুঁয়ে দেখা গল্প-কথা-রাজনীতি-ইতিহাস)
................................................
শুভদীপ চক্রবর্ত্তী

প্রচ্ছদ ও অলংকরণ : সুলিপ্ত মণ্ডল

মুদ্রিত মূল্য : ২৯০ টাকা 
#সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

প্রতিযাত্রা।। দুর্লভ সূত্রধর।। সুপ্রকাশ।।

লেটারপ্রেসের কম্পোজিটর : এক বিষাদান্ত পরম্পরা।। অনন্ত জানা।। সুপ্রকাশ।।

সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম।। মিহির সেনগুপ্ত।। সুপ্রকাশ।।