গদাই পণ্ডিত। সেকালের চিত্র চরিত্র

গোবিন্দপুরের গদাই পণ্ডিত বিখ্যাত লোক। তাঁহার পূর্ণনাম গদাধর দে। কিন্তু গদাই পণ্ডিত না বলিয়া গদাধর দে বলিলে কেহ তাহাকে চিনিতে পারে না। গদাই পণ্ডিতের বেতখানি গদারই সূক্ষ্ম সংস্করণ। তিনি যখন স্কুলের ছোটো ছোটো ছেলেদের ওপর কারণ-অকারণে সেই ভীষণ গদা উদ্যত করিতেন, তখন অনেক বালকের মূর্ছার উপক্রম হইত। গদাই পণ্ডিতের গদা-চালন-কৌশল জ্ঞাত হইয়া স্কুলের সম্পাদক একদিন তাঁহার একটাকা জরিমানা করিয়াছিলেন—সেইদিন হইতে দুগ্ধপোষ্য বালকবৃন্দের পৃষ্ঠে তিনি তাঁহার গদার শক্তি পরীক্ষার প্রলোভন ত্যাগ করিলেও তাঁহার প্রহরণখানির মায়া ত্যাগ করিতে পারেন নাই; এবং এখনও তিনি স্কুলে আসিয়া যখন-তখন তাহা মস্তকের উপর আন্দেলনপূর্বক শিশু হৃদয়ে মহা ত্রাসের সঞ্চার করেন।

গদাই পণ্ডিত ষোলো বৎসর বয়সের সময় গোবিন্দপুরের মধ্য বঙ্গবিদ্যালয়' হইতে ছাত্রবৃত্তি পাশ করিয়া গত সিকি শতাব্দীর অধিককাল গোবিন্দপুর ইংরেজি বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় পণ্ডিতের পদে নিযুক্ত আছেন। এই ত্রিশ বৎসর কাল চাকরি করিয়া তাঁহার বেতন আট টাকা হইতে মাসিক দশ টাকা হইয়াছে। কিন্তু এই দশ টাকা মূল্যের পণ্ডিতের কথাবার্তা শুনিয়া মনে হয় বিশ্ব সংসারটিকে তিনি 'মধুপর্কের বাটি’ অপেক্ষাও ক্ষুদ্র দেখেন। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে একমাত্র তিনিই মানুষ, অন্য সকলে

পিপীলিকা।

পণ্ডিত মহাশয়ের বৃহৎ পরিবার ; সংসারে একটি উপার্জনক্ষম ছোটো ভাই আছে, সে জমিদারি সেরেস্তায় মুহুরিগিরি করিয়া যে পনেরো টাকা বেতন পায়, তাহা সমস্তই দাদার হস্তে প্রদান করে। কিন্তু পণ্ডিত মহাশয় ইহাতে অসন্তুষ্ট, পণ্ডিত মহাশয়ের ধারণা, তাঁহার ভ্রাতা লোকনাথ মুহুরিগিরি করিয়া মাসে বিশ-পঁচিশ 'টাকা 'উপরি' পায় এবং সেই টাকা সে গোপনে তাহার স্ত্রীর নামে ডাকঘরের 'সেভিংস ব্যাঙ্কে জমা করে। তাহার এই সন্দেহ ক্রমশ এরূপ প্রবল হইল যে, একদিন তিনি স্থানীয় পোস্টমাস্টারকে এ সম্বন্ধে প্রশ্ন করিতেও কুণ্ঠিত হইলেন না। কিন্তু পোস্টমাস্টার বলিলে — 'কেহ 'সেভিংস ব্যাঙ্কে টাকা জমা রাখিলে অন্যের নিকট সে কথা প্রকাশ করা নিষিদ্ধ। ইহাতে গদাই পণ্ডিতের সন্দেহ দৃঢ়মূল হইল। কিন্তু পাছে ভ্রাতার উপার্জনের পঞ্চদশমুদ্রা হাত ছাড়া হয় এই ভয়ে তিনি ভ্রাতার সহিত বিবাদ করিতে সাহস করিলেন না। তিনি বিবেচনা করিয়া দেখিলেন, তাঁহার ভাই যে, পনেরো টাকা তাঁহাকে মাসিক সাহায্য করে, তাহার মধ্যে দশ টাকাতেই তাঁহার ভ্রাতার ও ভ্রাতৃবধূর গ্রাসাচ্ছাদন সম্পন্ন হয়, অবশিষ্ট পাঁচ টাকা তো তাঁহারই ছেলেমেয়ের ভরণপোষণে ব্যয় হয়। এই মহার্ঘতার দিনে এ সুবিধাটুকু ত্যাগ করা দূরদর্শী পণ্ডিতের সঙ্গত মনে হইল না, তাই তিনি এখন পর্যন্ত ভ্রাতার সহিত পৃথক হন নাই; কিন্তু তিনি যখন-তখন দুঃখ প্রকাশ করিয়া বলেন— ‘ছোঁড়াটাকে সস্ত্রীক পুষিতেই আমি সর্বস্বান্ত হইলাম!'
লোকনাথ একবার নিলামে সস্তাদরে একটা গাই গরু কিনিয়াছিল—তাহার তিন পোয়া দুধ হয় গদাই পণ্ডিতের সুযোগ্য সহধর্মিণী আধ সের দুধ জ্বাল দিয়া তদ্বারা স্বামীপুত্রের দুগ্ধ পানের পিপাসা নিবারণ করে, অবশিষ্ট এক পোয়া দুধে আধসের জল মিশাইয়া তাহা রাত্রে দেবরকে পান করিতে দেয়। লোকনাথ একদিন বলিয়াছিল— 'দামিনী ঘোষাণীর দুধও যে এর চেয়ে ভালো, বউ!' আর কোথায় যাবে! বধু-ঠাকুরানী ঝঙ্কার দিয়া বলিলেন – 'যেমন গরু কিনেছ, তেমনই দুধ! গরুকে খোল-ভুমি না দিলে কি তার দুধ মিষ্টি হয়?'—অগত্যা লোকনাথকে তাহার 'উপরি' উপার্জন হইতে খোল, ভুসি, ঘাস, বিচালি সংগ্রহ করিতে হইল। কিন্তু একপোয়া দুধে আধসের জলের মাত্রা আর কমিল না।

লোকনাথের স্ত্রী একবার পিত্রালয়ে গিয়া পিতার নিকট একজোড়া সোনা-বাঁধানো চুড়ি আদায় করিয়াছিল। সে স্বামীগৃহে ফিরিলে গদাই পণ্ডিত তাহার প্রকোষ্ঠে সেই চুড়ি দেখিয়া প্রমাদ গণিলেন বিস্ফারিত নেত্রে বলিলেন— এই যে। ভায়া উপরি উপার্জনের টাকা ভাঙিয়া পরিবারকে গহনা দিতে আরম্ভ করিয়াছে। বাপের তো টাকা রাখিবার জায়গা নাই, তাই সে মেয়েকে সোনা-বাঁধানো চুড়ি দেবে। গদাই পণ্ডিতের স্ত্রী মন্দাকিনী আবদার ধরিলেন— 'আমাকে একজোড়া ঐ রকম চুড়ি দাও।'— কিন্তু দশ টাকা বেতনের চাকরি করিয়া সোনার চুড়ি দেওয়া সম্ভব নহে ; এদিকে মা-ষষ্ঠীর কৃপায় সংসারে বৎসরান্তে একটি করিয়া আগন্তুকের আবির্ভাব হইতে লাগিল। দেখিয়া শুনিয়া আয়-বৃদ্ধির সঙ্কল্পে গদাই পণ্ডিত 'প্রাইভেট টিউশানি' আরম্ভ করিলেন। কিছুদিনের মধ্যে দুইটি 'টিউশানি' জুটিল। একটি ছেলেকে তিনি সকালে পড়াইতেন, আর একটি ভদ্রলোকের ছেলেকে রাত্রে পড়াইতেন। প্রত্যূষে উঠিয়া তিনি গাড়ু-হস্তে গ্রাম-প্রান্তবর্তী কোনও একটা বাগানে প্রবেশ করিতেন এবং কোনোদিন একটি কাঁঠালের জালি (ইচড়) কোনোদিন বা দুইটি লেবু সংগ্রহ করিয়া গৃহে প্রত্যাগমন করিতেন; প্রায় কোনোদিনই তিনি রিক্ত হস্তে ফিরিতেন না। প্রাতঃকৃত্য শেষ করিয়া আসিয়া পণ্ডিত মহাশয় তাঁহার দশবৎসর বয়স্ক বড়ো ছেলেটিকে সঙ্গে লইয়া 'টিউশানি' করিতে যাইতেন। তাহার একটি প্রতিবেশী-গৃহে এই 'টিউশানি'। পণ্ডিত মহাশয় পুস্তক খুলিয়া তাঁহার ছাত্রকে 'পড় পড়'—'লেখ লেখ' বলিয়া এমন ধমক দিতেন যে, বাড়ির সকলেই মনে করিত পণ্ডিত খুব যত্নের সহিত ছেলেকে লেখাপড়া শিখাইতেছেন; কিন্তু কার্যত তখন তিনি নিজের ছেলেটির শিক্ষাদান কার্যেই ব্যস্ত থাকিতেন। তাঁহার পুত্র ও ছাত্র উভয়েই এক শ্রেণীতে পড়িত। অঙ্ক বুঝাইবার সময় নিজের ছেলেকে বুঝাইতেন; ছাত্রটিকে বলিতেন— 'আমি যাহা বুঝাইয়া দিই দেখিয়া যা।' অনেকদিন এমনও হইত, একটি অঙ্ক তাঁহার পুত্র কষিয়া ঠিক উত্তর লিখিয়াছে, কিন্তু ছাত্রটি ভুল করিয়াছে; তখন তিনি গর্জন করিয়া বলিতেন- 'তোর কিছু হবে না, এই সোজা আঁক পারলি নে? আচ্ছা, আর একটা কষ। ইতিমধ্যে পণ্ডিত মহাশয়ের দ্বিতীয় পুত্র নফরা একটা কাঁচা পেয়ারা চিবাইতে- চিবাইতে ছাত্র-গৃহে উপস্থিত। পণ্ডিত মহাশয় কেতাব বন্ধ করিয়া বলিলেন— 'কী রে নফরা! তুই কী করতে এলি?'—নফরা অর্ধ-ভক্ষিত পেয়ারাটা অদূরবর্তী আটচালার ‘মটকায়' নিক্ষেপ করিয়া বলিল – ' মালো বউ মাছ বিক্রি করতে এসেচে, মাছ কিনবে? মা ডাকচে এসো।"

পণ্ডিত মহাশয় তৎক্ষণাৎ মৎস্যানুসন্ধানে চলিলেন। সেদিনের মতো টিউশানি শেষ হইল।

মাসের মধ্যে ঊনত্রিশ দিন এইভাবে তিনি 'টিউশানি করিতেন। কোনোদিন যদি ছাত্রের পিতা বলিতেন— 'পণ্ডিত মশায় এলেন আর চল্লেন যে। পণ্ডিত মহাশয় অসংকোচে উত্তর দিতেন— আপনার ছেলে বড়ো বুদ্ধিমান মশায় ; আর যে- রকম উহার স্মরণ শক্তি, গাধা ছেলের মতো উহার অধিকক্ষণ পড়াইবার আবশ্যক হয় না।' ছেলে বুদ্ধিমান ও স্মৃতিধর, একথা শুনিয়া ছেলের বাপের আনন্দ ধরিত না।

গদাই পণ্ডিত


দীনেন্দ্রকুমার রায় লিখিত 
সেকালের চিত্র চরিত্র

সংকলন, সম্পাদনা, টীকা ও ভূমিকা : শতঞ্জীব রাহা
প্রচ্ছদ ও অলংকরণ : সৌজন্য চক্রবর্তী 

মুদ্রিত মূল্য : ৪৯০ টাকা 
#সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।